×

জাতীয়

বাস্তবে রূপ নিচ্ছে ‘ওয়ান সিটি টু টাউনের’ স্বপ্ন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২২, ১০:২৭ এএম

বাস্তবে রূপ নিচ্ছে ‘ওয়ান সিটি টু টাউনের’ স্বপ্ন

ছবি: সংগৃহীত

‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ এখন আর বাংলাদেশের জন্য স্বপ্ন নয়। কর্ণফুলী নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনার কাছে নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত এই ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’টি শুধু বাংলাদেশ নয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম টানেল। এই টানেলটি চালু হলেই চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’-এ পরিণত হচ্ছে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। আজ শনিবার সকালে টানেলের ‘দক্ষিণ টিউবের পূর্ত কাজ সমাপ্তির উদযাপন’ অনুষ্ঠান করবে টানেল কর্তৃপক্ষ। অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথি থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশাপাশি টানেলস্থলেও অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এতে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিকসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত থাকবেন। এই টানেলের মধ্য দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু হলে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য তথা যোগাযোগের

ক্ষেত্রে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। তবে টানেলের পুরো কাজ শেষ হয়নি। সম্পূর্ণ কাজ শেষ করতে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। এরপর যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। টানেলের প্রবেশপথে স্ক্যানিং মেশিনসহ আরো নতুন নতুন কিছু বিষয় সংযুক্ত করায় প্রকল্প ব্যয় আরো ৫০০ কোটি টাকা বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী হারুন অর রশীদ।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের দক্ষিণ টিউবের কাজ শেষ হয়েছে। এই টানেলের দুটি টিউবের অন্যটির বাকি কাজও ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে। সব কাজ শেষ করে টানেল প্রস্তুত হতে আগামী বছর জানুয়ারি পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। সব ঠিক থাকলে আগামী ফেব্রুয়ারিতে টানেল দিয়ে যান চলাচল করতে পারবে।

প্রসঙ্গত, কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণের জন্য সর্বপ্রথম দাবি তুলেছিলেন চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। পলিমাটি ও চট্টগ্রাম নগরীর নানা বর্জ্য জমে কর্ণফুলী নদীর নাব্য কমে যাওয়াতে কর্র্ণফুলী নদীতে পিলার দিয়ে সেতু না করে হয় ঝুলন্ত সেতু, অথবা নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণের দাবিতে চট্টগ্রামে ব্যাপক আন্দোলনও গড়ে তুলেছিলেন তিনি। টানেল নির্মাণের জন্য মহিউদ্দিন চৌধুরীই যে প্রথম দাবি তুলেছিলেন তা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ২০১৬ সালে চট্টগ্রামে চেম্বারের শতবর্ষ উদযাপন ও ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উল্লেখ করেছিলেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ২০০৮ সালে চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দানের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর পরই শুরু হয়েছিল নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের সম্ভাব্য সমীক্ষাসহ সব ধরনের কর্মকাণ্ড। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু টানেলের নির্মাণকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রকল্প বাস্তবায়ন বা সম্পাদনের সময় ধরা হয়েছে পাঁচ বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।

২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দ্বিতীয় টিউবের কাজ উদ্বোধন করেন। টানেল প্রকল্পে রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায় করবে চীনা কোম্পানি। গত ১৮ মে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় এ কাজের জন্য চায়না কমিউনিকেশন্স কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডকে নিয়োগের প্রস্তাব নীতিগতভাবে অনুমোদন দেয়া হয়।

চট্টগ্রামে পতেঙ্গার নেভাল একাডেমি প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে নদীর তলদেশ দিয়ে টানেলটি চলে গেছে আনোয়ারার চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড এবং কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার লিমিটেড কারখানার মাঝামাঝি স্থানে। এরই মধ্যে টানেলের অবকাঠামো (পূর্ত) নির্মাণ প্রায় শেষের পথে। দক্ষিণ টিউবের পূর্ত কাজ শেষ এবং উত্তর টিউবের ৯৯ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। টানেল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, টানেলের দক্ষিণ টিউবের পূর্ত কাজ সম্পন্ন হয়েছে। দক্ষিণ টিউবের মাধ্যমে আনোয়ারা থেকে শহরমুখী যানবাহন আসবে। এছাড়া উত্তর টিউবের পূর্ত কাজ ৯৯ শতাংশ শেষ হয়েছে। উত্তর টিউবের মাধ্যমে শহর থেকে আনোয়ারামুখী যানবাহন যাবে। ইতোমধ্যে পুরো প্রকল্পের ৯৪ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের প্রকল্প পরিচালক মো. হারুর অর রশিদ বলেন, দুটি টিউবের মধ্যে একটি টিউবের সিভিল কাজ শেষ হয়েছে। অন্য টিউবের সিভিল কাজ এখনো চলছে। সেই সঙ্গে গাড়ি চলাচলের জন্য সড়কের কাজও সম্পন্ন হয়েছে। পূর্ত কাজ শেষ হলেও শুরুতে প্রকল্পে না থাকা বেশকিছু কাজ যুক্ত করতে হচ্ছে। ফলে প্রকল্পের মেয়াদ আরো এক বছর বাড়ানোর জন্য আবেদন করা হয়েছে। তার মতে, প্রকল্পের উদ্বোধন শেষেও কিছু কিছু কাজ বাকি থাকে, এই কারণে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর ফলে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে, বিষয়টি এমন নয়।

প্রথমে টানেলটি নির্মাণে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ৪ হাজার ৪৬১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। বাকি ৫ হাজার ৯১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা দিচ্ছে চীন সরকার। চীনের এক্সিম ব্যাংক ২ শতাংশ হারে ২০ বছর মেয়াদি এ ঋণ দিয়েছে। চীনের কমিউনিকেশন ও কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) টানেল নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। এদিকে টানেলের নিরাপত্তায় নতুন করে স্ক্যানার মেশিন বসানো হচ্ছে। এছাড়া আরো কিছু নতুন সংযোজন আনতে হয়েছে বলেও প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এসব কারণে ব্যয় বাড়ছে আরো প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।

দুই টিউব সংবলিত মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। নদীর পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাশের সংযোগ সড়কসহ এই প্রকল্পের সর্বমোট দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৯ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার। নদীর নিচে সুড়ঙ্গের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে ১০ দশমিক ৮০ মিটার ব্যাসের দুটি টিউব। টানেলের প্রতিটি টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। টানেলে টিউব দুটি থাকলেও সংযোগ পথ আছে তিনটি।

এর মধ্যে একটি বিকল্প পথ হিসেবে প্রথম দুটির সঙ্গে যুক্ত থাকবে। দুই সুড়ঙ্গের মধ্যে প্রথম সংযোগ পথের দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ১৪ মিটার। দ্বিতীয় বা মধ্যবর্তী সংযোগ পথের দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ৩৪ মিটার। শেষটির দৈর্ঘ্য ১০ দশমিক ৭৪ মিটার। প্রতিটির ব্যাস গড়ে সাড়ে চার মিটার। কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে ১৮ থেকে ৩৬ মিটার গভীরতায় সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছে। নদীর মাঝ পয়েন্টে এই গভীরতা প্রায় ১৫০ ফুট। প্রতিটি ৩৫ ফুট প্রশস্ত ও ১৬ ফুট উচ্চতার।

টানেলকে ঘিরে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম নগরীর এবং পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সড়ক যোগাযোগে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। ইতোমধ্যে আনোয়ারা উপজেলা প্রান্তে সংযোগ সড়কের দুই পাশে গড়ে উঠছে ছোট-বড় অসংখ্য শিল্প-কারখানা। টানেলকে ঘিরে পর্যটন, শিল্পায়নসহ অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে নতুন মাত্রা। টানেল চালু হলে কর্ণফুলী নদী পাড়ি দিতে সময় লাগবে মাত্র ৫ থেকে ৬ মিনিট। সময় বেঁচে যাওয়ায় অর্থনীতি গতি পাবে।

আনোয়ারা প্রান্তে ৭০০ মিটারের একটি উড়াল সড়ক বা ফ্লাইওভারসহ পাঁচ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে চার লেন সড়ক নির্মিত হয়েছে, যা আনোয়ারা চাতরি চৌমুহনীতে এসে চট্টগ্রাম আনোয়ারা বাঁশখালী পিএবি সড়কের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। অন্যপ্রান্তে দশমিক ৫৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক মিলিত হয়েছে নগরীর পতেঙ্গা নেভাল অ্যাকাডেমি পয়েন্ট দিয়ে মূল সড়কের সঙ্গে। চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও নগরীর পতেঙ্গা প্রান্তে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে ৩৮৩ একর। যৌথভাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সেতু ও সড়ক বিভাগ এবং চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App