×

মুক্তচিন্তা

আদালত চত্বর থেকে জঙ্গি ছিনতাই একটি ক্ষুদ্র ‘মহড়া’ মাত্র

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২২, ১২:৩৮ এএম

আদালত চত্বর থেকে জঙ্গি ছিনতাই একটি ক্ষুদ্র ‘মহড়া’ মাত্র

বর্তমানে এটি সারাদেশে সর্বাধিক আলোচিত বিষয় যে, কীভাবে গত ২০ নভেম্বর ঢাকার সিএমএম আদালত চত্বর থেকে প্রকাশ্য দিবালোকে বহু মানুষের সামনে সিনেমাটিক স্টাইলে পুলিশের ওপর হামলা ও তাদের চোখে-মুখে স্প্রে করে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে পুলিশ হেফাজত থেকে মুক্ত করে তাদের নিয়ে মোটরসাইকেলে নিরাপদে পালিয়ে গেছে জঙ্গিদের সহযোগীরা। ঘটনাটি পুরো জাতিকে শুধু বিস্ময়ে হতবাক করেছে, এটি বললে ঘটনাটির আকস্মিকতা ও ভবিষ্যৎ ভয়াবহতার সম্পূর্ণটুকু বলা হয় না; বরং বলা যায় আমাদের প্রিয় স্বদেশ এবং জনগণের নিরাপত্তার প্রতি যারা সবচেয়ে বড় হুমকি, সেই জঙ্গিদের পুনরুত্থানের একটি অশুভ এবং প্রায় অবিশ্বাস্য ঘটনা পুরো জাতিকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে এবং একই সঙ্গে আতঙ্কিত করে তুলেছে; যদিও আমরা ভেবেছিলাম ২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশাল ও ভালুকার মাঝামাঝি স্থানে পুলিশের প্রিজন ভ্যানে অতর্কিত হামলা চালিয়ে এক পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে ফাঁসির দণ্ড ও যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামিকে ছিনিয়ে নেয়ার পর পুলিশ এ ধরনের ভয়ংকর ও সুসংগঠিত আসামিদের কারাগার থেকে আদালতে আনা-নেয়ার ব্যাপারে সচেতন হবে এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কিন্তু একই ধরনের দুঃসাহসিক ঘটনা ঢাকার সিএমএম আদালতের মতো জনাকীর্ণ প্রাঙ্গণে প্রকাশ্যে এবং অবলীলায় ঘটে যাওয়ায় এ কথা ভাবার যথেষ্ট ও যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে যে, জঙ্গিদের হিংস্রতার ভয়াল থাবা থেকে এদেশ ও দেশের মানুষ এখনো নিরাপদ নয়; আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান আরো জোরদার করতে হবে। আমরা পত্র-পত্রিকায় মাঝেমধ্যে দেখতে পাই যে, বিভিন্ন স্থানে জঙ্গিরা নাশকতার উদ্দেশ্যে গোপনে পরিকল্পনা করার সময় কিংবা নাশকতা ঘটানোর সময় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে পুলিশ-র‌্যাব সদস্যরা সন্দেহভাজন জঙ্গিদের অবস্থানরত বাড়ি ঘেরাও করে জঙ্গিদের অস্ত্র-বোমা ইত্যাদিসহ গ্রেপ্তার করেছে এমন খবরও আমরা পত্র-পত্রিকা কিংবা টেলিভিশনে দেখেছি। এসব ঘটনায় জঙ্গিদের গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে আমাদের গোয়েন্দারাও বিভিন্ন সময়ে বেশ দক্ষতা ও কুশলতার পরিচয় দিয়ে এসেছেন। কিন্তু আলোচিত ঘটনাটি অপ্রত্যাশিত, আকস্মিক ও চাঞ্চল্যকর হওয়ার কারণে তিনটি বিষয় আবারো আমাদের সামনে চলে এসেছে যে; প্রথমত, গোপনে গোপনে জঙ্গিরা নিয়মিতভাবেই সংগঠিত হচ্ছে এবং ধীরে ধীরে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করছে; দ্বিতীয়ত, গোয়েন্দারা আগের মতো যথাযথ তথ্যপ্রাপ্ত হচ্ছেন না এবং কেন হচ্ছেন না সেটা তাদের ভেবে দেখতে হবে; আর তৃতীয়ত, জঙ্গি এবং ভয়ংকর আসামিদের কারাগার থেকে আদালতে আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে পুলিশ পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। জঙ্গি সংগঠনকে প্রতিহত করতে গেলে এই বিষয়গুলোর আগা-গোড়া পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিবেচনায় নিতে হবে। জঙ্গিদের পুনরুত্থান যে এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত প্রদান করছে এবং এটিকে হালকাভাবে গ্রহণ করা উচিত হবে না, এটি বলার আর অপেক্ষা রাখে না। এই জঙ্গিবাদকে যে কোনোভাবেই হোক না কেন নির্মূল করতেই হবে; আর তা না করলে আমাদের বরণ করতে হবে এক ভয়ংকর এক অন্ধকার ভবিষ্যৎ, যা আমাদের কারোরই কাম্য নয়। তাই আমাদের নজর দিতে হবে এর উৎসের দিকে এবং একে কৌশলে শেকড়শুদ্ধ উপড়ে ফেলতে হবে। আমাদের এ কথা মানতেই হবে যে, একটি দালানে অজান্তে অবহেলায় বেড়ে ওঠা পরগাছা যদি আমরা চারা অবস্থায়ই উপড়ে ফেলতে না পারি, তাহলে ভবিষ্যতে তা বড় হয়ে উঠলে এবং চারদিকে এর শেকড় ছড়িয়ে দিলে একে আর সহজে নির্মূল করা সম্ভবপর নয়; বরং একে নির্মূল করতে গেলে দালানের পুরো কাঠামোটিই ভেঙে পড়ার উপক্রম হতে পারে। আমাদের দেশে জঙ্গিবাদের অস্তিত্ব আবিষ্কারের পর থেকে বিভিন্ন বই-পুস্তক ও গণমাধ্যমে এ পর্যন্ত প্রকাশিত বিভিন্ন রকম তথ্য আমরা বিভিন্ন সময়ে জ্ঞাত হয়েছি এবং এর মাধ্যমে এই ধারণা করতে পারি যে, ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতা, ধর্মের অপব্যাখ্যা, সাধারণ মানুষের ধর্মভীরুতা এবং অশিক্ষার সুযোগ নিয়েই ক্রমশ এ দেশে ডালপালা ছড়িয়েছে জঙ্গিবাদ; যদিও অনেক তথাকথিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষও এর ধারক এবং বাহক এমনকি সরাসরি জঙ্গি কার্যক্রমে যুক্ত; তবু এ কথা অনস্বীকার্য যে, এর মূল আরো অনেক গভীরে। আমাদের দেশে জঙ্গিবাদ ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে মূলত ধর্মান্ধতাকে পুঁজি করেই এবং এর পেছনে এক দূরদর্শী দীর্ঘমেয়াদি ও সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যও; এমনকি অন্যান্য অনেক বিদেশি শক্তির সঙ্গে একাত্তরের পরাজিত শক্তির প্রত্যক্ষ পৃৃৃষ্ঠপোষকতা যার মধ্যে প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছে; আর তাই এর মূলোৎপাটন খুব সহজ কাজ নয়। তাছাড়া এই জঙ্গিবাদ কিংবা ধর্মীয় উগ্রবাদ কিংবা সন্ত্রাসবাদ, আমরা যে নামেই তাকে ডাকি না কেন, সে আজ শুধু বাংলাদেশের একার সমস্যা নয়; এ সমস্যা এখন বৈশ্বিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর দেশে দেশে আজ এই জঙ্গিবাদ কিংবা ধর্মীয় উগ্রবাদ কিংবা সন্ত্রাসবাদ আজ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এবং এই পৃথিবীর কোনো কোনো অঞ্চলকে ইতোমধ্যে নরকে পরিণত করে ফেলেছে। বাংলাদেশকেও জঙ্গিবাদের মাধ্যমে নরকে পরিণত করার এই উন্মাদনা থেকে যে কোনোভাবে মুক্ত রাখতে হবে এবং এটি অন্যান্য অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যে আমাদের জন্য এই মুহূর্তে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোরে উদীচীর সম্মেলনে বোমা হামলা; ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল (বাংলা ১৪০৮ সালের ১ বৈশাখ) রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা; ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে ভয়ংকর গ্রেনেড হামলা; ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারা বাংলাদেশের ৬৩টি জেলায় একই সময়ে একযোগে বোমা হামলা, যা স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে দৃঢ় সংগঠিত হামলা; ২০১৬ সালের জুলাই মাসে মর্মান্তিক হলি আর্টিজান হত্যাকাণ্ডসহ আরো অনেক ছোটবড় নৃশংস ঘটনায় নিহত ও আহত শত শত মানুষ; সারা বাংলার মানুষের হৃদয়বিদারক আহাজারির কথা কি কেউ কোনোদিন ভুলতে পারবেন? তাহলে, এত এত নৃশংস ঘটনার সঙ্গে যেসব জঙ্গিরা জড়িত এবং এদের মধ্যে যারা আদালত কর্তৃক মৃৃত্যুদণ্ডের মতো সর্বোচ্চ শাস্তিতে দণ্ডিত; সেসব ভয়ংকর জঙ্গিদের কারাগার থেকে আদালতে আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে পুলিশ কেন এমন ঢিলেঢালা নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তার চেয়েও ভয়ংকর ব্যাপার হলো এদের ছাড়িয়ে নিতে যারা এরকম সিনেমার দৃশ্য বাস্তবে ঘটানোর মতো সক্ষমতা রাখে তারা কি উপরে উল্লেখিত ঘটনার চেয়ে আরো অধিক ভয়াবহতম ঘটনার জন্ম দিতে পারে না? এই আশঙ্কা কি অমূলক? যে কোনো বড় ঘটনা ঘটানোর আগে যেরকম মহড়া করতে হয়; আমি মনে করি গত ২০ নভেম্বর ঢাকার সিএমএম আদালত চত্বরে পুলিশের ওপর সিনেমাটিক হামলা করে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনাটি হতে পারে জঙ্গিদের একটি সুসংগঠিত মহড়া; আর এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের শক্তিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে জঙ্গিরা এবং এই দুঃসাহসিক ঘটনায় তাদের সফলতা প্রমাণ করে যে আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী এবং গোয়েন্দা বাহিনী জঙ্গিদের থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। প্রগতির পথে অভিযাত্রা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াশীল ও পরাজিত গোষ্ঠীর চরমতম অপছন্দের একটি ব্যাপার আর এই প্রগতির অভিযাত্রাকে স্তব্ধ করে দিতে স্বাধীনতার পর থেকেই দেশি-বিদেশি বিভিন্নরকম পরাজিত শক্তির চক্রান্ত ও আস্ফালন শুরু হয়ে এখনো গোপনে কাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই জঙ্গিবাদ দিন দিন আরো বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে এবং বিভিন্নভাবে বারবার হামলার মাধ্যমে ক্রমেই অনিরাপদ করে তুলছে আমাদের দেশ ও জনগণের নিরাপত্তা; একটি স্বাধীন দেশকে বারবার কেন মোকাবিলা করতে হচ্ছে এই ভয়ংকর জঙ্গিবাদের অভিশাপ; সেটি চিহ্নিত করা এবং এই জঙ্গিবাদ পুরোপুরি নির্মূলে যে কোনো ধরনের কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণের সময় বোধকরি পার হয়ে যাচ্ছে। জঙ্গিদের ‘মহড়া’ ঠেকানো যায়নি বটে; কিন্তু তাদের পরিকল্পিত ভবিষ্যতের চূড়ান্ত নির্মমতার ঘটনা নস্যাৎ করা শুধু নয়; তাদের সমূলে উৎপাটন করার জন্য এক মুহূর্তও আর বসে থাকার সময় নেই।

ড. মো. মামুন আশরাফী : কবি, রাষ্ট্রচিন্তক ও পর্যটন বিশেষজ্ঞ। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App