×

মুক্তচিন্তা

এ নির্লজ্জ নির্দয়তার শেষ কোথায়?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০২২, ১২:৩২ এএম

৫৫ হাজার বর্গমাইলের দেশে শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিপুল জাহাজটি ডুবতে ডুবতে যে কোনোভাবে ভেসে আছে, তা যদি অস্বীকার করি তবে মিথ্যা বলা হবে। বিগত ইতিহাসে শিক্ষাসংক্রান্ত সবচেয়ে সাহসী অবলম্বনের একটি নিশ্চয়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যা ক্রমেই ঘুণে জর্জরিত হয়েছে এবং যার মর্ম আমরা এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। রাজনৈতিক শক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কবজা করার জন্য তাদের প্রকল্প অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশ আজ সেই দেশে পরিণত হয়েছে, যেখানে সাধারণ মানুষের আর্তনাদ করে বলার সময় এসেছে- আমরা সবার আগে চাই শিক্ষকের শিক্ষা। আর ১০টা সামাজিক অবক্ষয়ের জায়গার মতো শিক্ষাব্যবস্থারও কোনো উন্নত হলো না কেন? প্রশ্নের উত্তরটি কিন্তু সহজেই দেয়া যায়। স্বাধীন দেশে হাত কচলানো সংস্কৃতি যে স্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছে। এ দেশে শিক্ষা সংস্কারের ধুয়া ঠিকই উঠে, পাঠক্রমে পরিবর্তন ঠিকই আসে; কিন্তু তার কোথাও নতুন ভাবনার দুয়ার খোলার সুযোগ থাকে না। কোনো পরিবর্তন কিংবা সংস্কারেই শিক্ষাবিদদের মধ্যে কোনো বিতর্কের ব্যবস্থা হয় না। শিক্ষকদের প্রতি এবং ছাত্রছাত্রীদের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা ও মমতা না থাকলে প্রাইমারি স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পাঠদান কীভাবে পঙ্গু হয়ে যায়, তার উদাহরণ আমরা প্রতিদিন দেখছি। ইতোমধ্যেই আমরা যা খোয়াতে বসেছি, সেটি হচ্ছে শিক্ষার মধ্যে শ্রদ্ধার বিষয়টি। শিক্ষা, শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী- এসবই এখন দৃশ্যমান। আমরা দেখতে পাই, এর অতলে তলিয়ে যাওয়াটা বুঝতে পারি। কিন্তু কিছু সমস্যা আছে, যা আমরা সাদা চোখে অনেক সময় হয়তো দেখতে পাই না, বুঝতে পারি না। বর্তমান বিশ্বে মানুষের তৈরি যতগুলো সমস্যা পৃথিবীর সংকট বাড়াচ্ছে, সেগুলোর অন্যতম একটি সমস্যা সমুদ্র দূষণ। সমুদ্র নিয়ে মানুষের জ্ঞান বেড়েছে, এমনকি সমুদ্রের তলদেশ নিয়েও মানুষের গবেষণার কমতি নেই। এসব সত্ত্বেও সমুদ্র সম্পর্কে মানুষের উদাসীনতার শেষ নেই। মানুষ প্রতিদিনই সমুদ্রকে ক্রমাগত দূষিত করে চলেছে। বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ১৪০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য পৃথিবীর নানা সমুদ্রে গিয়ে মিশে। যদিও ওই বর্জ্যরে সবটুকু সরাসরি সমুদ্রে ফেলা হয় না। যত্রতত্র ফেলে দেয়া প্লাস্টিকের বোতল ও ব্যাগের বড় একটা অংশ আশপাশের পয়ঃপ্রণালি থেকে পানিতে ভাসতে ভাসতে নদী-নালা হয়ে শেষ পর্যন্ত সমুদ্রে গিয়ে জায়গা করে নেয়। এর বাইরে মাছ ধরার নৌকা, প্রমোদতরী, তেলবাহী জাহা জ ও অন্যান্য জলযান সমুদ্রে আবার সরাসরি বর্জ্য ফেলে তৈরি করছে সমুদ্র দূষণের আরো একটি কারণ। তবে আধুনিক জীবনে আমাদের নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রের মধ্যে মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে প্লাস্টিক। প্লাস্টিক দূষণ ইতোমধ্যে বৈশ্বিক রূপ লাভ করেছে। পৃথিবীতে প্লাস্টিক দূষণের দ্বারা প্রভাবিত নয় এমন জনপদ খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে সমুদ্রের বুকে প্লাস্টিকের উপস্থিতি নিঃসন্দেহে আরো ভয়ানক। সমুদ্রের পানি দূষিত করার সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য জলজ প্রাণীর মৃত্যু ডেকে আনে এ প্লাস্টিক। আমরা জানি, নদী দূষণের শেষ পরিণতি সমুদ্র দূষণ। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি শহরই কোনো না কোনো নদীর তীরে অবস্থিত। প্রাচীনকাল থেকেই সেই শহরগুলোর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার একমাত্র ভরসার স্থল ছিল সেই নদীগুলো। যুগের পরিবর্তনে শহরগুলোতে উৎপাদিত বর্জ্যরে পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েক হাজার গুণ। অন্যদিকে কৃষি খাতে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন রাসায়নিক সার ও নানারকম কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। আর সেচ ব্যবস্থাপনা, অতিবৃষ্টি ও বন্যার দরুন সেসব ক্ষতিকর পদার্থ নদী-নালায় মিশে শেষ মুহূর্তে সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। এর ফলে সমুদ্রে তৈরি হচ্ছে মৃত্যু অঞ্চল বা ডেড জোন এলাকা। এটি সমুদ্রের এমন একটি এলাকা যেখানে অক্সিজেনের ঘাটতি হয় এবং সেখানে কোনো ধরনের জলজ প্রাণী বাঁচতে পারে না। সমুদ্রে ডেড জোনের মতো ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তেলের কারণেও। সৌভাগ্যবশত সমুদ্র এখনো পরিপূর্ণভাবে ভাগাড়ে পরিণত হয়নি। তবে এভাবে চলতে থাকলে সেদিন আর বেশি দূরে নয়। ইতোমধ্যেই সামুদ্রিক মাছের শরীরে বিজ্ঞানীরা মাইক্রো প্লাস্টিকের উপস্থিতির প্রমাণ পেয়েছেন। মানুষের রক্তেও পাওয়া গেছে প্লাস্টিকের নমুনা। এবার ঘরের কথা বলা যাক। গত ২০ বছরে সুন্দরবন বাস্তুজগতে ম্যানগ্রোভ বন, পলিতট আর চাষের জমি- এর একটি বড় অংশই চিংড়ির ভেড়িতে পরিবর্তিত হয়েছে। বিশ্ববাজারে চিংড়ির চাহিদা বৃদ্ধি আর চাষিদের চটজলদি লাভের তাগিদ এভাবে অরণ্য আর চাষের জমিকে ভেড়িতে পরিণত করেছে। সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্র তাই এখন জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে বিপন্ন। চিংড়ি চাষে এখন চীন, বাংলাদেশ, ভারত, ভিয়েতনাম সামনের সারিতে। আঠারো শতকের শেষ থেকেই প্রথমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, পরে ব্রিটিশ সরকার বাঘ ও ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংস করে সুন্দরবনে কৃষির পত্তন ও জনপদ বিস্তার করার চেষ্টা করে। এরপর থেকে ম্যানগ্রোভ ধ্বংস কমবেশি চলতেই থাকে। কখনো চাষের জমি, কখনো ছিন্নমূল মানুষের বাস্তুজমি, কখনো মাছের ভেড়ি তৈরি হয় অরণ্য দখল করে। এ শতাব্দীর শুরু থেকে ছবিটা আরো পাল্টাতে থাকে। বাড়ছে উত্তাপ, সমুদ্রের স্তর বাড়ছে বছরে পাঁচ মিলিমিটারেরও বেশি। ২০০৯-এর সাইক্লোন ‘আয়লা’র নোনা বন্যায় লাখ লাখ হেক্টর চাষের জমি লবণাক্ত হলো, চাষে ব্যাঘাত ঘটল। আর তাতেই ধানি জমিতে ভেড়ি বেঁধে চিংড়ি চাষ বাড়তে থাকল লাফিয়ে লাফিয়ে। অন্যদিকে দ্রুত কমেছে ম্যানগ্রোভ আর চাষের জমি। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রযুক্তিনির্ভর চিংড়ি চাষ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বাড়িয়ে তুলেছে বহুগুণ। বর্তমান হারে ভূরূপান্তর চলতে থাকলে সামনের দিনগুলোতে আরো কৃষিজমি, জলা-জঙ্গল ভেড়ি চাষের আওতায় চলে আসবে। কিন্তু রাষ্ট্রকে তো এগিয়ে চলতেই হবে উন্নয়নের পথে। প্রতিটি রাষ্ট্রই তেমন করে ভাবে। তাতে পরিবেশের ভারসাম্য কতটা বিঘিœত হলো, কতটা বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হলো তা কি আর রাষ্ট্র চিন্তা করার সুযোগ পায়? রাষ্ট্র ভাবে- দেশে প্রাকৃতিক কাঁচামালের প্রাচুর্য নিজেদের কাজে লাগিয়ে তার থেকে কিছু লাভ করতে না পারলে এগুলো থেকে লাভ কী? ভাবে- আমাদের হাতে বিরাট পাহাড় আছে, ঘন জঙ্গল আছে, প্রকাণ্ড নদী আছে, মাটির নিচে আকরিক সম্পত্তি আছে। এসব ব্যবহার করে লাভ করতে না পারলে এগুলো থেকে লাভ কী? প্রকৃত সত্য হলো- এগুলো আমাদের সম্পত্তি নয়, এগুলো প্রাকৃতিক সম্পদ। পৃথিবীর সব প্রাণীর, এমনকি খোদ পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার জন্য এগুলো যথাযথ রাখা প্রয়োজন। পরিবেশের এসব কথা যে সত্য, তা আজ হাতেনাতে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। মানুষের মাথায় তাই আজ নতুন চিন্তা ঘুরছে- তাহলে আমরা কীভাবে বাঁচব? প্রকৃতিকে রক্ষা করেও নিজেদের জীবন কাটানোর উপায় নিয়ে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। মানুষের আর অন্যান্য প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য অরণ্য থাকতেই হবে। অরণ্য না থাকলে তাপ বাড়বে, বৃষ্টিপাতের শৃঙ্খলা নষ্ট হবে। তাই অরণ্যকে বাঁচাতে হবে, সমুদ্রকে বাঁচাতে হবে। সমুদ্রে প্লাস্টিক জমা কমাতে হবে। এটা করতে ব্যর্থ হলে একদিন আমাদের চারপাশের সবুজ শেষ হয়ে যাবে, সূর্যের খরতাপ মাটিকে পুড়িয়ে দেবে, সমুদ্রে ডেড জোন বাড়তেই থাকবে। ফলে মানুষের এবং অন্যান্য প্রাণীর বেঁচে থাকার এ নির্ভরযোগ্য পৃথিবী একদিন হয়ে উঠবে সবার জন্য মৃত্যু উপত্যকার হাতছানি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় তাই হয়তো সত্য হয়ে দেখা- আজি হতে শতবর্ষ পরে। হ্যাঁ, তাই হয়েছে। ইতিহাসের আধুনিক কালখণ্ডে নিয়ন্ত্রণবাদী রাষ্ট্র ও তার সহযোগী সমাজের মুষ্টিমেয় শক্তিশালীরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে প্রকৃতি আর পরিবেশকে স্বার্থসিদ্ধির কাজে লাগাচ্ছে এখন। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ, বিনষ্ট হয়েছে ভারসাম্য। প্রাকৃতিক আর দুর্বল মানুষদের এর মাশুল গুনতে হচ্ছে এখন। এ ঐতিহাসিক সত্য বুঝি রবীন্দ্রনাথ সেই শতবর্ষ আগেই বুঝে গিয়েছিলেন। কবির সেদিনের সচেতন, সংবেদনশীল ও অনুভূতিপ্রবণ মনন সম্ভবত আমাদের চিন্তাকে ততখানি আলোড়িত-আলোকিত করতে পারেনি। তাই আজ আমরা এক অসহায় পৃথিবীর ক্রান্তিলগ্নে পৌঁছে গিয়েছি। হয়তো এখনো সময় আছে, হয়তো নেই। তবে পরিবেশ নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়ে আজ যেন একটু ভড়কে গেছে। পথ কি হারিয়ে গেছে তাকে ফিরিয়ে আনার? হয়তো এখনো সুযোগ আছে। ভেবে দেখতে হবে রাষ্ট্রগুলোকে গভীরভাবে। ভেবে দেখতে হবে পৃথিবীর মানুষকে নতুন করে।

সুধীর সাহা : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App