×

মুক্তচিন্তা

কাগজের মূল্যবৃদ্ধি ও মুদ্রণ শিল্পে সংকট

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২২, ০৭:৫৮ এএম

কাগজের জনপ্রিয়তা ও ব্যবহার ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী হলেও আজ কাগজ নির্মাণ শিল্প বেশ কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি। কাগজকে ৪টি প্রধান শ্রেণিতে ভাগ করা হয়- লেখার কাগজ, ছাপার কাগজ, নিউজপ্রিন্ট এবং প্যাকেজিং জাতীয় কাগজ। তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে ১৫ শতাংশ লেখার কাগজ, ৩৫ শতাংশ ছাপার কাগজ, ৪০ শতাংশ নিউজপ্রিন্ট এবং ১০ শতাংশ প্যাকেজিংয়ের কাগজ উৎপাদিত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে আমদানিকৃত মণ্ড, বর্জ্য কাগজ, লেখার কাগজ, কাগজের বোর্ড ইত্যাদির ব্যয় বার্ষিক প্রায় ৪ বিলিয়ন টাকা। নিউজপ্রিন্ট সবচেয়ে সস্তা এবং কম টেকসই। বই এই কাগজে ছাপানো হয় না। এই মুহূর্তে কাগজের বাজারে দেখা দিয়েছে তীব্র সংকট। গত ৫ মাসের মধ্যে পাইকারিতে প্রতি টনে দাম বেড়েছে ৩৫-৩৭ হাজার টাকা। কাগজ পাচ্ছেন না মুদ্রণশিল্পের মালিকরা। পাইকাররা দোষ চাপাচ্ছেন কাগজকল মালিকদের ওপর। মিল মালিকরা বলছেন, ডলার ও বিশ্ববাজারে কাগজ তৈরির মণ্ড বা ভার্জিন পাল্পের দর বাড়ার কারণে কাগজের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। করোনা পরিস্থিতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশে কাগজ উৎপাদন কম হওয়া, ভার্জিন পাল্পের সংকট ও কাগজের আকাশছোঁয়া দরের কারণে পাঠ্যবই ছাপার কাজ থমকে গিয়েছে। এবার আসি ভারতের বাজারে। টাকার নিরিখে ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়েই চলেছে। ফলে আপাতত কমছে না কাগজের দাম। কাগজ ব্যবসায়ীদের সংগঠন ক্যালকাটা পেপার ট্রেডার্স এসোসিয়েশন জানিয়েছে, ডলারের দাম বৃৃদ্ধির ফলে কাঁচামালের আমদানির খরচও বেড়ে চলেছে। সে কারণেই এই পরিস্থিতি। লেখা, ছাপা, প্যাকেজিংসহ সব ধরনের কাগজই এর মধ্যে রয়েছে। কাগজ তৈরির ৫০ শতাংশ কাঁচামালই আমদানি করতে হয়। ডলারের দাম বাড়ত শুরু করেছে অনেক আগে। সে কারণেই কাঁচামাল কেনার খরচ দ্রুত বেড়ে গিয়েছে। ফলে অন্যান্য বারের মতো এ বছর মার্চের পরে কাগজের দাম কমানো সম্ভব হয়নি। এদিকে গত ১ অক্টোবর থেকে ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় দেশের কাগজ শিল্পের ডাম্পিং সমস্যা সমাধানে নিউজপ্রিন্টসহ অন্যান্য কাগজ আমদানি সীমিত করার ঘোষণা করেছে। ফলে ভারত ও বাংলাদেশে মুদ্রণ শিল্প এই মুহূর্তে তুমুল সংকটে। অন্যদিকে আর্থিক সংকটের জেরে ব্যাপক কাগজ সংকট এসে উপস্থিত হয়েছে পাকিস্তানে। পরিস্থিতি এমনই যে পাকিস্তানে কাগজের অভাবে বই ছাপানো আটকে গিয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। পাকিস্তানি কাগজ ব্যবসায়ী সংগঠনের তরফ থেকে জানানো হচ্ছে, কাগজের দাম এত বেড়ে গেছে যে ব্যবসায়ীরা তা কিনতে পারছেন না। ফলে বই, খাতাও তৈরি হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত কোনো টেক্সট বুক ছাপানো শুরু হয়নি সেখানে। তাই মনে করা হচ্ছে, পাকিস্তানের পড়–য়ারা আগামী সেশনে কোনো বই খাতা পাবে না। এই মুহূর্তে ভয়ংকর আর্থিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কায় কাগজ মূলত আমদানি করেই আনা হয়ে থাকে। আমদানি করা হয় কালিও। সেই প্রসঙ্গে শিক্ষা দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেছেন, যারা প্রশ্নপত্র ছাপায় তাদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে বিদেশি মুদ্রা না থাকায় কাগজ এবং কালির জোগান মজুত করতে পারছেন না তারা। ফলে পরীক্ষা পিছিয়ে দেয়া ছাড়া আপাতত উপায় নেই। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে জনসংখ্যার অনুপাতে বই ও কাগজের ব্যবহার বেশি হয় বাংলাদেশে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সব অগ্রগতিতে এবং সব ক্ষেত্রে বই বিশেষ ও বড় ভূমিকা পালন করেছে। আর সব সময়ই এ দেশের মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রের যা কিছু ভালো ও সাফল্য তার সবকিছুই দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে সংবাদপত্র, বিভিন্ন পত্রিকা ও বই। অথচ সংবাদপত্রের ওপর আরোপিত করপোরেট কর এখন ৩০ শতাংশ। আবার কাস্টমস প্রসিডিউর কোড তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকায় নিউজপ্রিন্টের আমদানির ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হচ্ছে। নিউজপ্রিন্টের ওপর বর্তমানে ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক দিতে হচ্ছে। এর সঙ্গে মূল্য সংযোজন কর (১৫ শতাংশ) এবং অগ্রিম আয়করসহ (৫ শতাংশ) সব মিলিয়ে কর দিতে হয় প্রায় ১২৭ শতাংশ। তাই আমদানি শুল্ককে শূন্য করা উচিত। আবার সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন আয়ের ওপর উৎসে কর (টিডিএস) ৪ শতাংশ। উৎসস্থলে কাঁচামালের ওপরও ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি) দিতে হয়। অথচ অধিকাংশ সংবাদপত্রের মোট আয়ের ৯ শতাংশ লভ্যাংশই থাকে না। এসব গেল সংবাদপত্রের কথা। পশ্চিমবঙ্গের চিত্র একই রকমের। এই মুহূর্তে সাহিত্য মুদ্রণ নিয়ে প্রকাশকরা একই বিবৃতি দিচ্ছেন। নতুন বই ছাপব না। নিজের পয়সায় ছেপে নিজে বিক্রি করুন। নবীন লেখকদের সাহিত্যচর্চা বিমুখ করার সফল উদ্যোগ। কিন্তু তাদের কিছুই করার নেই। তাদের রুটি রুজি আজ সংকটে। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দেশের মুদ্রণ ও প্রকাশনা জগৎ দুই বছরে চূড়ান্ত ক্ষতির সামনে পড়ে এই বছর যখন সবে মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করেছিল তখনই এসেছে কাগজের আকাল। ৩ মাস আগে যে কাগজ রিম প্রতি ১ হাজার ৫০০ টাকা ছিল তা বর্তমানে ৩ হাজার ১০০ টাকা। ১ হাজার ৯৫০ টাকা দামের কাগজ এখন ৪ হাজার ৫০০ টাকা। কাগজসহ প্রতিটি কাঁচামালের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি এবং লোডশেডিংয়ের কারণে গ্রাহক চাহিদা ৩০-৪০ শতাংশ কমে গেছে। প্রায় প্রতিদিনই দাম একটু-আধটু বেড়ে ৩ মাসে কাগজের দাম প্রায় দ্বিগুণে পৌঁছেছে। এর পরও থামছে না। লাগামহীন কাগজের দর বাড়ার পেছনে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধসহ ডলার, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও এলসি খুলতে না পারার কথা জানিয়েছেন কাগজ ব্যবসায়ীরা। তবে প্রকাশক ও কাগজ বিক্রেতাদের দাবি কাগজ প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সিন্ডিকেট কাগজের দাম বাড়াচ্ছে। নানামুখী সংকটে মুখ থুবড়ে পড়ছে মুদ্রণ শিল্প। পাশাপাশি হোঁচট খাচ্ছে সাহিত্য চর্চাও। কিন্তু সরকার এখনো গভীর নিদ্রায়। গেøাবাল ইংলিশ এডিটিং নামের একটি সংস্থা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের পাঠাভ্যাস নিয়ে জরিপ পরিচালনা করে জানিয়েছে যে বইপড়ুয়া জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে স্থান করে নিতে চলেছে ভারতীয়রা। গত বছর ভারতের মানুষ সপ্তাহে ১০ ঘণ্টা ৪২ মিনিট ব্যয় করেছে বই পড়ার পেছনে। গত বছর সবচেয়ে বেশি বই ছেপেছে চীন। এক বছরে ছেপেছে ৪ লাখ ৪০ হাজার বই। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা ছেপেছে ৩ লাখ ৪ হাজার ৯১২টি বই। তৃতীয় অবস্থানে আছে যুক্তরাজ্য, ছেপেছে ১ লাখ ৮৪ হাজার বই। ভারতের মানুষ বই পড়ার দিক থেকে এগিয়ে থাকলেও বই ছাপার দিক থেকে খানিকটা পিছিয়েই আছে। তালিকায় ভারতের অবস্থান সপ্তম। তারা গত বছর বই ছেপেছে ৯০ হাজার। এক সময় সবাই ভেবেছিল করোনাকালে ই-বুকের বিক্রি বাড়বে। কিন্তু ঘটনা ঘটেছে উল্টো। বরং ছাপা বই-ই বেশি বিক্রি হয়েছে। ছাপা বই থেকে গত বছর বিশ্বের বইয়ের বাজার আয় করেছে ১৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ই-বুক বিক্রি হয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ। আর ছাপা বইয়ের মধ্যে ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল হার্ড কভার ও ৩২ দশমিক ৬ শতাংশ ছিল পেপারব্যাক। বিস্ময়করভাবে অনলাইন বইয়ের দোকান থেকে বই কেনার হার বেড়েছে। গত বছর সারা বিশ্বে যতগুলো বই বিক্রি হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে রোমাঞ্চ ঘরানার বই। গেøাবাল ইংলিশ এডিটিংয়ের জরিপে উঠে এসেছে, মোট বিক্রীত বইয়ের এক-তৃতীয়াংশই ছিল রোমাঞ্চ উপন্যাস। জরিপই সর্বশেষ কথা নয়; তবু একটা ধারণা তো পাওয়া গেল! জানা গেল, ছাপা বই খুব সহজে হারিয়ে যাচ্ছে না, দেশের মানুষের পাঠাভ্যাস কমলেও বৈশ্বিক পরিসরে তরুণদের পাঠাভ্যাস বাড়ছে, ছাপা বই, ই-বুক, অডিও বুক ইত্যাদি মিলিয়ে আন্তর্জাতিক বইয়ের বাজার বাড়তে বাড়তে ১১৯ বিলিয়ন ডলার আয়তনে ঠেকেছে। এসবই সুড়ঙ্গের শেষে আশার আলো। কাজেই সরকারকে ভাবতে হবে মুদ্রণ শিল্পের এই শ্বাসরোধী অবস্থা থেকে মুক্ত করার উপায়। কারণ বইয়ের প্রসার জাতির অগ্রগতির জন্য একান্ত প্রয়োজন। অমিত গোস্বামী : কবি ও লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App