×

মুক্তচিন্তা

ভাসানী বিদ্বেষের খণ্ডচিত্র

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২২, ১২:৪৯ এএম

পাকিস্তানি শাসনামলে চীনপন্থিদের বক্তব্যকে তখনকার শাসনকর্তারা কতটা গুরুত্ব দিত তার কৌতূহলোদ্দীপক পরিচয় পাওয়া যায় চীনপন্থি এক রাজনৈতিক নেতার একটি উক্তি নিয়ে সামরিক কর্মকর্তাদের ব্যতিব্যস্ততায়। ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের একটি ক্রান্তিমুহূর্ত ছিল আসাদের মৃত্যু। চীনপন্থি ছাত্র ইউনিয়ন তখন আওয়াজ তোলে, ‘আসাদের মন্ত্র জনগণতন্ত্র’ এবং ‘শ্রমিক কৃষক অস্ত্র ধরো পূর্ববাংলা স্বাধীন করো’। সোহরাওয়ার্দীপন্থিরা এসব বক্তব্য সমর্থন করেননি। রাশেদ খান মেনন স্মরণ করেছেন যে ইত্তেফাক-এর রাজনৈতিক মঞ্চে এক বিস্তারিত প্রবন্ধে বলা হয়- কিছু ‘পিকিংপন্থি যুবক পাকিস্তানের ধ্বংস সাধনের’ কথা বলছে, ‘সামরিক সরকারের দায়িত্ব হবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া।’ সামরিক কর্তৃপক্ষ যে উদাসীন ছিল তা নয়। তারা সব খবর রাখছিল। কয়েক মাস পরে পল্টনের এক জনসভায় চীনপন্থি নেতাদের একজন তাদের আশা ও উদ্দীপনার কথা ঘোষণা করতে গিয়ে বলেছিলেন সবুজ পূর্ববঙ্গকে লাল রঙে রঞ্জিত করতে হবে। রাও ফরমান আলী তার ডায়েরিতে উক্তিটি টুকে রেখেছিলেন। যুদ্ধশেষে এই ডায়েরি বাংলাদেশ সরকারের হাতে যায় এবং তারা ওই উদ্ধৃতিটির ব্যাখ্যা করেন এই ভাবে যে, এতে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা ঘটানোর সংকল্পের কথা লেখা রয়েছে। রাও ফরমান আলী যা বলেন সেটা এরকমের : ‘পূর্ব পাকিস্তানের সবুজ লাল রক্তে রঞ্জিত করতে হবে কথাটি একজন ন্যাপ নেতা ১৯৭০ সালের জুন মাসে পল্টন ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা করেছিলেন। সামরিক আইন প্রশাসনের হেডকোয়ার্টার্স মনে করে যে কথাটি উচ্চারণ করেছিলেন ন্যাপ নেতা মোহাম্মদ তোয়াহা। ফরমান আলীকে বলা হয়েছিল তিনি যেন এ ব্যাপারে তোয়াহার কাছ থেকে ব্যাখ্যা দাবি করেন এবং জনগণের শান্তি বিঘিœত করে এমন বক্তব্য রাখতে নিষেধ করে দেন। […] মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর লে. জেনারেল ইয়াকুব টেলিফোন করলে ফরমান আলী তার টেবিল ডায়েরির পেছনে বাক্যটি লিখে রাখেন। পরবর্তীকালে তোয়াহা এমন কথা বলেছেন বলে অস্বীকার করেন এবং বলেন যে কাজী জাফর কিংবা রাশেদ খান মেনন তা বলে থাকতে পারেন। শেষোক্ত দুজন আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকায় তাৎক্ষণিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে আর কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায়নি। ফরমান আলী আরো ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, তোয়াহা ও তার অনুসারীরা কমিউনিস্টপন্থি হওয়ায় কথাগুলো দিয়ে তারা নিজেদের প্রতিশ্রæতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন যে পূর্ব পাকিস্তানকে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত করা হবে, লাল রং দিয়ে রক্তপাত বোঝানো হয়নি।’ মওলানা ভাসানীকে সর্বাধিক আক্রমণ সহ্য করতে হয়েছে মৌলবাদীদের, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর লোকদের কাছ থেকে। জামায়াত তো চরিত্রগতভাবেই সমাজতন্ত্রবিরোধী। সমাজতন্ত্রের কর্মীদের তারা পারলে হত্যা করত, যেমনটা একাত্তরে তাদের আলবদর বাহিনী করেছে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পরপরই মওলানা ভাসানী গিয়েছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে; পাঞ্জাবের শাহিওয়াল রেল স্টেশনে জামায়াতীরা তার ওপর হামলে পড়েছিল, হয়তো হত্যাই করত বাধা না পেলে। জামায়াতের তুলনায় নেজামে ইসলামকে মনে হতো নরমসরম; কিন্তু ভাসানী-বিরোধিতার বেলাতে তারাও কম পারঙ্গম ছিল না। অনেকটা ভুঁইফোঁড় নেজামে ইসলামের সারা পাকিস্তানি নেতা ছিলেন দুর্দান্ত কৌশলী সাবেক পাঞ্জাবি আমলা চৌধুরী মোহাম্মদ আলি, যিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছিলেন, পূর্ববঙ্গীয় নেতাদের মধ্যে ছিলেন ফরিদ আহমদ, যিনি সংসদীয় বক্তৃতাতে তুখোড় ছিলেন, প্রথম জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের, ছাত্রজীবনে তার ঝোঁকটা ছিল বামদিকেই, কিন্তু পরে সুবিধা হবে বুঝে নেজামে ইসলামে যোগ দিয়েছিলেন। একাত্তরে তিনি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন এবং যুদ্ধশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হন। চুয়ান্নতে নেজামে ইসলাম আসলে সংগঠিত কোনো রাজনৈতিক দলই ছিল না, ফজলুল হক সাহেবের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে দল হিসেবে খাড়া হয় এবং নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন আলেম বলে কথিত মওলানা আতাহার আলী। নেজামে ইসলাম নির্বাচনের সময় যুক্তফ্রন্টে কেবল যুক্তই হয়নি, শর্ত দিয়ে রেখেছিল কমিউনিস্ট পার্টিকে ফ্রন্টে নেয়া যাবে না, এমনকি একটি তালিকাও দিয়েছিল যাদের মনোনয়ন দেয়া চলবে না, কারণ তারা কমিউনিস্ট। ফলে যুক্তফ্রন্ট গঠনে সর্বাধিক আগ্রহ উৎসাহ ছিল যে কমিউনিস্ট পার্টির, যুক্তফ্রন্টে তাদের জায়গা হলো না এবং কমিউনিস্ট বলে কথিত যারা মনোনয়ন পেলেন তাদেরও মনোনয়ন পেতে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হলো; এলাকাতে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও প্রায় অপ্রতিদ্ব›দ্বী হওয়া সত্ত্বেও কেউ কেউ মনোনয়ন পানই-নি, যেমন যশোরের কমরেড আবদুল হক। জোড়াতালি দিয়ে দাঁড়ানো সেই নেজামে ইসলাম দল কিন্তু খুবই মুখর ছিল ১৯৫৭-তে, ন্যাপ যখন গঠিত হয় সেই সময়টাতে। মওলানা আতাহার আলী, যুক্তফ্রন্ট থেকে যিনি সংসদ সদস্য হয়েছিলেন, তিনি ন্যাপ গঠনে-উদ্যোগী মওলানা ভাসানীর সমালোচনা করেন এই ভাবে : ‘জনাব ভাসানী পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের মধ্যে বিদ্বেষ ও তিক্ততা প্রচারণা চালাইয়া ও পূর্ব পাকিস্তানের এছলামী জামহুরিয়াত হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া যাওয়ার ভয় দেখাইয়া ক্লান্ত হন নাই, লেনিন গেট, গান্ধী গেট, সুভাষ গেট প্রভৃতি নামে তোরণ নির্মাণ করিয়া পাকিস্তানকে কি ধাঁচে গড়িয়া তুলিতে চান তাহারও প্রমাণ দিয়াছেন। […] পাকিস্তান এছলামী জামহুরিয়াতকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ না বলিয়া প্রয়োজন হইলে ভাসানী সাহেবকে আসসালামু আলাইকুম জানাইবার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাইতেছি।’ আতাহার আলী সাহেবের এই বিবৃতিটিকে স্বাধীনতার ৫০ বছরের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা হিসেবে উদ্ধৃত করেছেন লেখক ড. মোহাম্মদ হাননান, তার ‘স্বাধীনতার ৫০ বছর’ বইতে। ইনি ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস রচনা করে মশহুর হয়েছেন এবং এক সময়ে বাম ঘরানার লোক বলেই পরিচিত ছিলেন। তার আরো একটি বই সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে, যার নাম ‘মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে আলেম সমাজের ভূমিকা’, যাতে তিনি বলেছেন : ‘আমাদের অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে একথা জানাতে হবে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অসম্ভব হতো, যদি ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত না হতো। অর্থাৎ ভারত-বিভক্তিই হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তি। আর ভারত-বিভক্তির ক্ষেত্রে ওই সময়ে উলামায়ে কেরামের অবদান ছিল অনেক বেশি।’ অথচ এতকাল ধরে আমরা জেনে এসেছি যে, জমিয়তে উলেমায়ে হিন্দ ভারতবিভাজন মোটেই সমর্থন করেনি এবং জামায়াতে ইসলামী ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ঘোর বিরোধী। এবং অন্যদিকে বিভাজনের জন্য সবচেয়ে অধিক আগ্রহী ছিল হিন্দু মহাসভা ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে অবস্থানকারী হিন্দু মহাসভাপন্থিরা। হাননান সাহেবরা মনে হয় আমাদেরকে সর্বজনবিদিত ইতিহাস না ভুলিয়ে ছাড়বেন না। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সম্বন্ধেও চমকপ্রদ একটি বক্তব্য রয়েছে হাননানের ‘স্বাধীনতার ৫০ বছর, শত ঘটনা শত কাহিনী’ বইটিতে। তাতে বলা হচ্ছে যে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়টি ছিল ‘তাৎক্ষণিক’। অর্থাৎ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন এবং ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান তেমন কোনো ঘটনাই নয়, হয়তো বলতে চাইছেন এগুলো দুর্ঘটনা বৈ নয়, কারণ এদের দরুন মওলানা আতাহার আলী সাহেবের স্বপ্নের এছলামিয়া জামহুরিয়াত টিকে থাকতে পারেনি। হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছে এবং ভাঙার সময় ত্রিশ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, দুই লাখ নারীর ইজ্জত হরণ করেছে। ভাসানীবিদ্বেষী ও সমাজতন্ত্রবিরোধী মহলটির চাঞ্চল্যকর বক্তব্য আরও আছে। যেমন- ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তাদের আদর্শ জাতীয় স্বাধীনতা থাকলেও ক্ষমতার মসনদের আকাক্সক্ষা ছিল প্রবল ও স্পষ্ট। সেই সঙ্গে নাস্তিক, ধর্মদ্রোহী ও আলেমবিদ্বেষী বিরাট একটি দল তাদের ঘিরে রেখেছিল অক্টোপাসের মতো।’ আলেম সমাজের এই ধরনের মুখপাত্রদের মস্তিষ্কে আর যারই অভাব থাকুক কল্পনাশক্তির এবং ইহজাগতিকতার প্রতি প্রায়-পেশাগত বিদ্বেষের যে অভাব নেই ওপরের ওই উক্তিতেই তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। তবে অত্যন্ত রোমহর্ষক আবিষ্কার সাধন করাও যে তাদের পক্ষে সম্ভব তার প্রমাণও আছে। যেমন এই আবিষ্কারটি; ‘ন্যাপের চীনপন্থিরা পঞ্চাশের দশকেই বাংলাদেশ স্বাধীন করে ফেলতে চেয়েছিলেন। প্রচার চালালেও তারা জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের সমর্থক বনে যান এবং আইয়ুব খানকে দিয়ে তারা সমাজতন্ত্র কায়েমের স্বপ্নও দেখতে থাকেন। কিন্তু এসবই ছিল শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগকে কোণঠাসা করে রাখতে এক ঘৃণ্য রাজনীতি। ন্যাপের চীনপন্থি অংশ কার্যত পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল।’ একটু পরেই আবারো বলা হচ্ছে, ‘আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের পরে ভাসানী ন্যাপ আইয়ুবকে সমর্থনের অনুকূলে তাদের তৎপরতা শুরু করে’। হাননান সাহেবের বইয়ের একটি শিরোনামও বেশ চমকপ্রদ : ‘স্বাধীন বাংলা আন্দোলনের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী’। সবাই জানে ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের সূত্রপাত ঘটে ৭ ডিসেম্বর ১৯৬৮-তে। ডাক দিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী এবং তার অনুসারীরা। হাননান’রা যে সেটা স্বীকার করবেন তা আশা করা অন্যায়। স্বীকার তিনি করেনও-নি। তিনি আবিষ্কার করেছেন যে ‘কোনো রাজনৈতিক দলের ডাক ছাড়াই প্রায় স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয় ১৯৬৮-এর ৭ই ডিসেম্বর’। তাও ভালো বলেননি যে হরতালটা আলেম সমাজের পক্ষে মওলানা আতাহার আলী ডেকেছিলেন। দৈব অনুপ্রেরণাতে। নেজামে ইসলামের এই সমর্থকের সঙ্গে কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদের ঐকমত্যের কোনো ক্ষেত্র থাকবার কথা নয়। রাত্রি ও দিনের ব্যবধান। হাননান সাহেবরা সমাজতন্ত্রবিরোধী; কমরেড ফরহাদ অঙ্গীকারবদ্ধ সমাজতন্ত্রী। তবু আশ্চর্য মিল দেখা যাচ্ছে ভাসানীবিদ্বেষের বেলাতে। হাননান সাহেবরা ভাসানীকে পছন্দ করবেন না এটা খুবই স্বাভাবিক; কিন্তু কমরেড ফরহাদরাও যে ভাসানীকে অসহ্য মনে করবেন আপাতদৃষ্টিতে সেটা অপ্রত্যাশিত, কেননা আনুষ্ঠানিকভাবে কমিউনিস্ট না হলেও মওলানা ভাসানীও কমিউনিস্টদের কাক্সিক্ষত সামাজিক বিপ্লবের পক্ষেই জীবনভর কাজ করেছেন। তবে পার্থক্য ঘটেছিল এবং সেটা বিপ্লবের পথ নিয়ে। কমরেড ফরহাদরা দীক্ষিত হয়ে পড়েছিলেন ‘গণতান্ত্রিক’ পথে আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার রাজনীতিতে; আর ভাসানী ছিলেন বলপ্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা মেহনতিদের হাতে আনবার পথের পথিক। অমীমাংসেয় ব্যবধান। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App