×

মুক্তচিন্তা

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সুবর্ণজয়ন্তী : স্মৃতি, আনন্দ ও প্রেরণা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২২, ১২:৪৯ এএম

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সুবর্ণজয়ন্তী : স্মৃতি, আনন্দ ও প্রেরণা
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ এ বছর তার গৌরব ও ঐতিহ্যের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করতে যাচ্ছে। বিভাগের ১৫ ব্যাচের শিক্ষার্থী ও সাবেক ছাত্রনেতা মো. জাহাঙ্গীর আলমকে আহ্বায়ক এবং বিভাগীয় চেয়ারম্যান ও ইতিহাস বিভাগ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ মোজাহিদুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে ইতিহাস বিভাগের সুবর্ণজয়ন্তী ও তৃতীয় পুনর্মিলনী উদযাপন কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির পক্ষ থেকে থাকছে ১৭ নভেম্বর ২০২২ থেকে ১৭ ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত এক মাসব্যাপী নানা অনুষ্ঠান। ১৯৭২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন জাতীয় অধ্যাপক ড. এ এফ সালাহ্উদ্দীন আহমদ। সে সময়ের প্রখ্যাত স্কলার অধ্যাপক আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ, অধ্যাপক মফিজউল্লাহ কবীর, অধ্যাপক আবদুল করিম, অধ্যাপক আবু ইমাম এবং ভারতের অধ্যাপক বরুণ দে-কে নিয়ে একটি কমিটি অব কোর্সেস গঠন করা হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগেই প্রথমবারের মতো কোর কোর্স হিসেবে সভ্যতার ইতিহাসকে তিনটি অনার্স বর্ষে বাধ্যতামূলক পাঠ্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় বিভাগটি শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে পরিণত হয়নি, এটি সারাদেশের মধ্যে শিক্ষা ও গবেষণায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এমফিল কোর্স হিসেবে পরিচিত যে উচ্চশিক্ষার কার্যক্রমটি দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন বহুল পরিচিত তার সূতিকাগার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ। অধ্যাপক ড. আবদুল মাবুদ খান প্রথম এই ডিগ্রি লাভ করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ব^বিদ্যালয়ের প্রতœতত্ত্ব ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এই দুটো বিভাগ প্রতিষ্ঠার পেছনেও রয়েছে ইতিহাস বিভাগের শিক্ষকদের সক্রিয় ভূমিকা। জাতীয় অধ্যাপক ড. এ এফ সালাহ্উদ্দীন আহমদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ব^বিদ্যালয়ের প্রথম প্রফেসর ইমেরিটাস, বাংলাদেশে প্রথম রাষ্ট্রদূত ও সাবেক অর্থমন্ত্রী ড. আজিজুর রহমান মল্লিক, দর্শন গুরু অধ্যাপক সরদার ফজজুল করিম, গবেষক ও বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ঘনিষ্ঠ মিত্র ড. সফর আলী আখন্দ, আর্কিওলজিস্ট অধ্যাপক আবু ইমাম, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দিলীপ কুমার চক্রবর্তী, ড. কাজী এহ্তেশাম দীন মোহাম্মদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের উদ্যোক্তা অধ্যাপক ড. আতাউর রহমান খান, অধ্যাপক বজলুর রহমান খান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান, অধ্যাপক প্রীতি কুমার মিত্র, সাবেক প্রো-ভিসি অধ্যাপক এনামুল হক খান, অধ্যাপক ড. শিরীন আখতার, অধ্যাপক রতন লাল চক্রবর্তী, জাতীয় আর্কাইভসের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক তাইবুল হাসান খান, অধ্যাপক হাসিনা মতীন, অধ্যাপক লুৎফুল হাই জামী, অধ্যাপক মনজুর আহসান, অধ্যাপক মো. নাসির উদ্দিন, অধ্যাপক ও ইতিহাস বিষয়ক জনপ্রিয় লেখক এ কে এম শাহনাওয়াজ, অধ্যাপক গোলাম সাকলায়েন সাকীসহ অসংখ্য শিক্ষকের পদচারণায় বিভাগটি যেমন আলোকিত হয়েছে তেমনি এখনো জ্যেষ্ঠ শিক্ষক অধ্যাপক নূরুল ইসলাম মনজুর, বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতির বর্তমান সহ-সভাপতি অধ্যাপক এ টি এম আতিকুর রহমান, অধ্যাপক আরিফা সুলতানা, ফুড সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞ ও বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ মোজাহিদুল ইসলাম, অধ্যাপক মো. এমরান জাহান, অধ্যাপক এ কে এম জসীম উদ্দীনের পাশাপাশি অধ্যাপক হোসনে আরা, ড. পিংকি সাহা, নাসিমা হামিদের মতো কয়েকজন তরুণ শিক্ষক সেই পরম্পরা ধরে রেখেছেন। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলায় আন্তঃবিভাগীয় পর্যায় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থীরা তাদের সাফল্য ধরে রেখেছেন। ফুটবল, ক্রিকেট, জিমন্যাস্টসহ বিভিন্ন বিষয়ে শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সেরা বিভাগ হিসেবে পরিচিতি পেয়ে এসেছে। জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় ও সাবেক অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম, জাতীয় দলের ক্রিকেটার সানোয়ার হোসেন, সাকিব আল হাসানদের কোচ হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন, সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ পরিচালনা করে আলোচিত আইসিসি আম্পায়ার মাসুদুর রহমান মুকুল, ফিফা ফুটবল রেফারি জয়া চাকমা, আন্তর্জাতিক পুরস্কারজয়ী সাঁতারু মো. মাহফিজুর রহমান সাগর, অসংখ্য পদকজয়ী টেবিল টেনিস খেলোয়াড় খন্দকার আল-মোস্তফা বিল্লাহসহ ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থীদের এমন অনেক নাম স্পোর্টস অঙ্গনে পরিচিত। পানিসম্পদ উপমন্ত্রী, ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি ও জাকসু ভিপি এ কে এম এনামুল হক শামীম, নেতৃস্থানীয় এনজিও নারী উদ্যোগ কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা মাশহুদা খাতুন শেফালী, উয়ারী বটেশ্বরে খনন কাজে আলোচিত অধ্যাপক প্রতœতাত্ত্বিক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান, জাতীয় পুরস্কারজয়ী নির্মাতা ভুবন মাঝি, গণ্ডি মুভি পরিচালক ফাখরুল আরেফিন খান- ইতিহাসের অ্যালামনাইদের এমন অনেক নাম জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে গিয়েছে। দুই. একজন ভালো মানুষ এবং ভদ্রলোক কেমন হওয়া উচিত প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ড. এ এফ সালাহ্উদ্দীন আহমদ তার বড় উদাহরণ হতে পারেন। সরাসরি তার ক্লাস না পেলেও পরবর্তী সময়ে স্যারের সঙ্গে যোগাযোগটা ছিল নিয়মিত। তিনি আমার শিক্ষকদের শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু তার মমতা থেকে কখনো বঞ্চিত হইনি। তার সঙ্গে যতবার দেখা করতে বনানীর ফ্ল্যাটে গিয়েছি, ততবারই দেখতাম তিনি প্রস্তুত হয়ে বসে আছেন। তিনি খুবই ফর্মাল ছিলেন। প্রয়োজনীয় কথা শেষ করে তিনি বেডরুমে যেতেন। ম্যাডামকে খবর দিয়ে আসতেন। তার স্ত্রী অধ্যাপক হামিদা খানম ছিলেন ঢাকার হোম ইকোনমিক্স কলেজের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল। ম্যাডাম ইস্ত্রি করা পাটভাঙা শাড়ি পরে বেরিয়ে আসতেন। তারপর স্যার আমাকে ডাইনিং টেবিলে ডেকে নিয়ে যেতেন। টেবিলে বসে ম্যাডামের কুশল জিজ্ঞাসার পর খাওয়া পর্ব শুরু হতো। এরপর চা পর্ব। এটা সালাহ্উদ্দীন স্যার নিজের হাতে করতেন। তিনজনের জন্য চা তৈরি করতেন। তারপর অনুচ্চ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করতেন, চায়ের পানি গরম আছে তো? তিন. বাংলাদেশের কিংবদন্তি জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক স্যারের প্রতি আগ্রহ জন্মানোর পেছনে অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম স্যার নিজে এবং তার লেখা বইটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সরদার স্যার যখন আমাদের ক্লাস নিতেন সেই ক্লাসের বড় সময়জুড়ে থাকত রাজ্জাক স্যার প্রসঙ্গ। আহমদ ছফার যদ্যপি আমার গুরু বইটি নিজে অনেকবার পড়েছি। অধ্যাপক ড. আতাউর রহমান খান (ড. এ আর খান) স্যারের কাছে রাজ্জাক স্যার সম্পর্কে অনেক তথ্য পেয়েছি। লন্ডনে রাজ্জাক স্যারের অসমাপ্ত পিএইচডি থিসিসের ফটোকপি, লেখা চিঠিসহ বেশ কিছু দুর্লভ জিনিস দেখার সুুযোগ হয়েছে ড. এ আর খানের মাধ্যমে। রাজ্জাক স্যারকে দেখার প্রবল আগ্রহের কারণে ড. এ আর খান আমাকে রাজ্জাক স্যারের সঙ্গে পরিচয় করাতে গুলশানে আবুল খায়ের লিটুর বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন। নতুন একটি ফিল্ম রোল কিনে নিলেও অতি আবেগ এবং ড. এ আর খানের সতর্ক নির্দেশনার কারণে মাত্র ১০/১২টি ছবি তুলতে পেরেছিলাম! ড. এ আর খানের সঙ্গে প্রায় দুই দশক পর আড্ডা দেয়ার সুযোগ হয় সম্প্রতি। মনে হলো দুই দশক নয়, দুদিন পর কথা হচ্ছে স্যারের সঙ্গে! টানা চার ঘণ্টা কথা বলার পর স্যারকে একটু বিশ্রাম নেয়ার কথা বলাতে তিনি বললেন, আরে তোমরা এসেছো, দিনটাকে একটু সেলিব্রেট করতে দাও! ফেরার পথে আগের মতো বিশাল এক খামে দুর্লভ পেপার কাটিং, বই এবং বিভিন্ন লেখার ফটোকপি ভরে এগিয়ে দিলেন পড়ার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে শিক্ষকদের এমন স্মৃতি আছে অনেক। আমরা সৌভাগ্যবান অসাধারণ সব শিক্ষককে পেয়েছি। ক্ষুদ্র জীবনে এই দীর্ঘ ছায়া সারা জীবনের প্রেরণা হয়ে কাজ করে। মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান : সাংবাদিক ও গবেষক; সাবেক শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App