×

পুরনো খবর

মিরসরাইয়ে হরিণ খামারে গড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২২, ১০:৩১ এএম

মিরসরাইয়ে হরিণ খামারে গড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র

ছবি: সংগৃহীত

শুরুটা হয়েছিল ২০১৩ সালে। শখের বসে রংপুর চিড়িয়াখানা থেকে ১১টি হরিণ ক্রয় করে যাত্রা শুরু করেন প্রবাসী মঈন। এখন বাণিজ্যিকভাবে হরিণের খামার গড়ে তুলেছেন তিনি। মিরসরাই উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের অলিনগর এলাকায় হিলসডেল মাল্টি ফার্ম ও মধুরিমা রিসোর্টে এ দৃষ্টিনন্দন হরিণের খামার অবস্থিত। খামার ঘিরে গড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র।

প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে এখানে ছুটে আসছেন নানা বয়সি ভ্রমণপ্রিয় মানুষ। শুধু হরিণ নয়, নানা প্রজাতির গাছ দিয়ে সাজানো প্রকৃতির মাঝে হরেক রকমের পাখি আর জীবজন্তুর এক অপরূপ বিচরণ ক্ষেত্র এই খামার। ৩১ একর জায়গার পাহাড়ের বাঁকে টুকরো টুকরো সমতল। চারপাশে সবুজ গাছের সমারোহ। এমন প্রকৃতির মাঝে বেড়ে উঠছে হরিণের পাল।

জানা গেছে, উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নে ৩১ একর জায়গায় প্রায় চল্লিশ হাজার নানা প্রজাতির গাছ দিয়ে সাজানো এই খামার। তবে এখানকার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো হরিণ। সরকারি নিয়মনীতি এবং প্রাণিসম্পদ বিভাগের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে বেড়ে উঠছে এখানকার হরিণগুলো। হরিণের বিচরণ আর প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে প্রতিদিনই এখানে ভিড় করেন দর্শনার্থীরা। হরিণগুলোর স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা ও রোগবালাই থেকে মুক্ত রাখতে তদারকি করছে স্থানীয় প্রাণিসম্পদ বিভাগ।

প্রবাসে উড়াল দিলেও মন থেকে মুছতে পারেননি আঁকাবাঁকা সবুজ-শ্যামল মেঠোপথের মায়া, বাড়ির ছায়া। লাজুক প্রাণী চিত্রা হরিণের প্রেমে মজেছেন তিনি। ব্যক্তি পর্যায়ে হরিণ পালন করতে চাইলে নিতে হয় সরকারের অনুমোদন।

এ ব্যাপারে খামারের উদ্যোক্তা অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী মঈন উদ্দিন ভোরের কাগজকে বলেন, ১৯৮৬ সাল থেকে ৩৬ বছর প্রবাস জীবনযাপন করলেও হরিণ প্রেমের কারণে দেশেই হরিণের খামারটি গড়ে তুলেছি। অলিনগরে হরিণ খামার ছাড়াও পশুপাখির অভয়াশ্রম তৈরি করার পরিকল্পনা রয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে খুব বেশি লাভজনক না হলেও শুধু ভালোবাসা থেকেই হরিণ পালন করে যাচ্ছি। হরিণ খামারটি এখন দর্শনার্থীদের কাছেও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এখানে হরিণ ছাড়াও গড়াল, ঘোড়া, খরগোশ, ময়ূর, রাজহাঁস, দেশি-বিদেশি হাঁস, কালিম পাখি, ঘুঘু, বন মোরগসহ নানা প্রজাতির পাখিও রয়েছে। চারিদিকে বন উজাড় হয়ে যাওয়ার কারণে এখানে নানা ধরনের পাখি উন্মুক্ত বিচরণ করে।

তিনি আরও বলেন, হরিণ খামারের লাইসেন্স পেতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। ২০১৩ সালে বাণিজ্যিক খামারের লাইসেন্স পাওয়ার পর খামার শুরু করেছি। প্রথমে রংপুর চিড়িয়াখানা থেকে ২৫ হাজার টাকা করে ১১টি হরিণ ক্রয় করে নিয়ে আসি। এরপর একটা পর্যায়ে সেখান থেকে বংশ বিস্তার করে ২৬টি হরিণ হয়েছিল। এক বছর আগে বজ্রপাতে তিনটি হরিণ মারা যায়। হরিণ বিক্রিতে ক্রেতাকে অবশ্যই বনবিভাগ থেকে লাইসেন্স ও পজেশন নিতে হবে। একটা সময় জবাই করে খাওয়া গেলেও ২০১৮ সালে নতুন নীতিমালার কারণে জবাই করা নিষিদ্ধ। হরিণের তেমন রোগবালাই হয় না। তবে কখনো কখনো ডিয়ার টোবাকুলাস হয়। আমাদের দেশে এই রোগের ভ্যাকসিন নেই।

মূলত পুরুষ হরিণের সিংয়ের গুঁতোয় আহত হয়ে অনেক সময় হরিণের মৃত্যু হয় এবং ছোট বাচ্চা ঠাণ্ডাজনিত কারণে মারা যায়। নিয়মিত কৃমিমুক্ত ও ভালো মানের খাবার এবং মিনারেল দিলে হরিণের অসুখ খুব একটা হয় না। উপজেলা মিরসরাই প্রাণী সম্পদ অফিস নিয়মিত তদারকি করেন। হরিণ সব ধরনের টক জাতীয় ফল পছন্দ করে। এজন্য বাগানে রয়েছে আমলকি, বহেরা, হর্তুকি, আরজু, কামরাঙ্গা, জলপাই, বেলম্বু ,আম, জাম তেঁতুলসহ বিভিন্ন গাছ।

হরিণের চাহিদা মিটিয়ে বাকি ফল বাজারে বিক্রি করা হয়। শীত মৌসুমে সবজি চাষ করে হরিণের খাদ্য চাহিদা পূরণ করা যায়। এবার ৩০ শতক জমিতে বেগুন চাষ করেছি। সবুজ ঘাসের চাহিদা পূরণে হাইব্রিড ঘাস ও কলমি চাষ করেছি। নিয়মিত ভুট্টা ভাঙা ও গমের ভুষি দিতে হয়, সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে দানাদার খাবার ও রকসল্ট দিতে হয়।

হরিণ দেখাশুনা করার জন্য মাসিক বেতনের ভিত্তিতে একজনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কোনো হরিণ মারা গেলে কিংবা জন্ম নিলে ১৫ দিনের মধ্যে সার্টিফিকেটসহ বন অধিদপ্তরে জানাতে হবে। প্রতি বছর সরকারকে হিসাব দিতে হয় এবং হরিণপ্রতি ১ হাজার টাকা ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। প্রতি বছর লাইসেন্স নবায়ন ও পজেশন সার্টিফিকেট নেয়া লাগে। নতুন খামারির কাছে আমরা একটি হরিণ ৭৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে থাকি। নতুন করে কোনো উদ্যোক্তা হরিণের খামার করতে চাইলে আমরা সর্বোচ্চ সহযোগিতা করে থাকি।

জানা গেছে, সরকারি বন থেকে ৮ কিলোমিটারের মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে হরিণ লালন-পালন করা যায় না। আবার খামার করতে হয় লোকালয় থেকে দূরে কোথাও। কোনো হরিণ জন্ম নিলে সেই তথ্য জানাতে হয় সরকারকে। কোনো হরিণ মারা গেলে কিংবা বিক্রি করলে সেই খবরটাও ১৫ দিনের মধ্যে জানাতে হয় বন বিভাগকে। বাণিজ্যিকভাবে হরিণ লালন-পালন করতে হলে মানতে হয় সরকারের সুনির্দিষ্ট এমন কিছু কঠিন শর্ত। সরকারের বেঁধে দেয়া কঠিন এসব শর্ত মেনেই হরিণ পালন করছেন মঈন।

ভুট্টার পেছনে বছরে ৫-৬ লাখ টাকা খরচ হয়। এছাড়া ঘাস ও টক ফলের পেছনেও অনেক টাকা খরচ করতে হচ্ছে মঈনকে। বছরে একবার বাচ্চা দেয় এসব হরিণ। দেড় বছর পর থেকে বাচ্চা প্রসব শুরু করে স্ত্রী হরিণ।

জন্মের পর বাচ্চার শরীরে হাত দিলে হরিণ সে বাচ্চাকে সহজে দুধ দেয় না। ছয় মাস পর একটি হরিণের ওজন হয়ে থাকে প্রায় ২০ কেজির বেশি। দেশে এক সময় ৫ প্রজাতির হরিণের দেখা মিললেও এখন শুধু চিত্রা ও মায়া জাতটি চোখে পড়ে।

পরিবার নিয়ে এখানে ঘুরতে আসা শিক্ষিকা হামিদা আবেদীন পলি বলেন, প্রথমে পাহাড়ি অঁকাবাঁকা উঁচু নিচু, ভাঙা-চোরা রাস্তা দিয়ে আসতে খুব বিরক্ত হয়েছি। কিন্তু হিসলডেল মাল্টি ফার্মে প্রবেশ করে হরিণের খামার দেখে মুহূর্তে সব কষ্ট ভুলে গেছি। অনেক সুন্দর একটি জায়গা। মিরসরাইয়ে এত সুন্দর পর্যটন স্পট আছে আগে জানতাম না।

করেরহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন নয়ন বলেন, মঈন ভাইয়ের গড়ে তোলা হরিণ খামারটি এলাকাবাসীর কাছে বিনোদন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। প্রতিদিনই দর্শনার্থীর ভিড় থাকে খামারটিতে। চট্টগ্রাম, ফেনী, মিরসরাই, কুমিল্লা থেকে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ হরিণ দেখতে আসছেন।

এ ব্যাপারে মিরসরাই উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. জাকিরুল ফরিদ ভোরের কাগজকে বলেন, আমি এখানে নতুন দায়িত্বে এসেছি। অলিনগরে অবস্থিত হরিণের খামারে যাওয়া হয়নি। তবে অফিসের স্টাফদের কাছ থেকে বিস্তারিত খোঁজখবর নিয়েছি। প্রাণিসম্পদ কার্যালয় থেকে আগের মতো সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।

প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন জানান, মিরসরাই উপজেলার অলিনগরে অবস্থিত হরিণ খামারটি নিয়মিত আমরা পরিদর্শন করি। জায়গাটি অনেক সুন্দর। খামারের মালিক আইন মেনেই হরিণ লালন-পালন করছেন। হরিণের অনেক প্রজাতির বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, তাই এভাবে হরিণ পালন ইতিবাচক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App