×

মুক্তচিন্তা

কর্ণফুলীর দূষণ রোধে করণীয়

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২২, ১২:৩১ এএম

চট্টগ্রামের প্রাণ কর্ণফুলী নদী এখন শিল্প-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে মারাত্মক দূষণের শিকার। নদীর পাড় ও আশপাশে গড়ে ওঠা অসংখ্য অবৈধ বসতি এবং শিল্প-কারখানার বর্জ্য নদীতে পড়ায় কর্ণফুলীর পানি মারাত্মক দূষিত হয়ে পড়ছে। নদীর দু’পাড়ে গড়ে ওঠা তিন শতাধিক কলকারখানা আর মহানগরীর ময়লা-আবর্জনা দূষণের অন্যতম কারণ। নদী গবেষকরা বলছেন, দূষণের কারণে হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য। হারিয়ে গেছে অন্তত ৩০ প্রজাতির মাছ। মৎস্য বিশেষজ্ঞের মতে, এক সময় কর্ণফুলী নদীতে প্রায় ১৪০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। এর মধ্যে মিঠা পানির ৬০, মিশ্র পানির ৫৯ এবং সামুদ্রিক ১৫ প্রজাতির। কিন্তু দূষণের কারণে ইতোমধ্যে মিঠা পানির মাছ বিলুপ্তপ্রায়। অবশিষ্ট মাছের মধ্যে ১০ থেকে ২০ প্রজাতি ছাড়া অন্য প্রজাতির মাছ এখন পাওয়া যায় না। মূলত শিল্প-কারখানার বর্জ্যে মারাত্মক দূষণের কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে কর্ণফুলী নদী। নাব্য হ্রাস এবং নদীর শাখা খাল ও কাপ্তাই লেকের সøুইস গেটের পানি প্রবাহে বাধা পেয়ে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ কমে গেছে। এছাড়া নির্বিচারে গৃহস্থালি ও শিল্পবর্জ্য ফেলা, অনিয়ন্ত্রিত পরিবেশ দূষণ এবং নিরবচ্ছিন্ন দখলের কারণে ধীরে ধীরে শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কর্ণফুলী নদী। একসময় কর্ণফুলী নদীতে ডলফিন লাফালাফি করত, এখন সেই ডলফিনের দেখা মেলে না। অন্যদিকে শাহ আমানত সেতুর উত্তর অংশে ৪৭৬ মিটার নদী ভরাট হয়ে গেছে। ২০১৬ সালে নদী ভরাট করে গড়ে তোলা মাছবাজার, বরফকল, অবৈধ দখল ও ভেড়া মার্কেটের কারণে চাক্তাই খালের মোহনা এলাকায় কর্ণফুলী নদীর প্রবহমান ধারা কমে দাঁড়ায় ৪৬১ মিটারে। মূলত কর্ণফুলী নদী অবৈধ দখলের কারণে এর প্রশস্ততা কমছে বলে অভিযোগ বিশেষজ্ঞদের। চট্টগ্রাম নগরের ৩৬টি খাল দিয়ে দিনে প্রায় ৫ হাজার টন পয়ঃবর্জ্য ও গৃহস্থালির বর্জ্য পড়েছে কর্ণফুলীতে। পাশাপাশি রয়েছে শিল্প ও চিকিৎসা বর্জ্য। এর বাইরে নদীতে চলাচলকারী নৌযানগুলোর পোড়া তেলে কর্ণফুলীর দূষণ চরমে পৌঁছেছে। এছাড়া জাহাজের তেল, কর্ণফুলী পেপার মিলের বর্জ্য, সিটি করপোরেশনের আবর্জনা ও কলকারখানার বর্জ্যে কর্ণফুলীর দূষণ বাড়ছে। তাছাড়া নদীপাড়ের শৌচাগারের মলমূত্র ও মরা জীবজন্তু এবং পলিথিন এসে মিশছে নদীতে। নদী গবেষকের মতে, দূষণের কারণে হারিয়ে গেছে অন্তত ২০ থেকে ২৫ প্রজাতির মাছ। ইউনিভার্সিটি অব হংকং, আরএমআইটি ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউটের এক যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর্ণফুলীতে কেবল সার কারখানাগুলোই প্রতিদিন ১৪৫ ঘনমিটার দূষিত পানি, ৩৫ টন চায়না মাটি, ৪ টন সেলুলোজ এবং সোডিয়াম হাইড্রোঅক্সাইড ফেলে। গবেষণায় দেখা গেছে, গত ৩০ বছর ধরে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ক্রোমিয়াম, তামা, নিকেল, সিসা ও দস্তার মতো ভারী ধাতু জমে নদীর গভীরতা তীব্রভাবে হ্রাস পেয়েছে। পানিতে ক্রোমিয়াম, তামা ও সিসার উপস্থিতি নিরাপদ সীমা অতিক্রম করায় নদীর বাস্তুসংস্থান ও আশপাশের জনজীবনে বিপর্যয় ঘটেছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তাই কর্ণফুলী নদী বাঁচাতে হলে দুই পাড়ের অবৈধ দখল অবশ্যই উচ্ছেদ করতে হবে। চট্টগ্রাম শহরের খালগুলো পুনরুদ্ধার করা জরুরি। শিল্প কারখানার বর্জ্য, গৃহস্থালি এবং পয়ঃবর্জ্য নদীতে না ফেলা। যেখানে-সেখানে প্লাস্টিকের বর্জ্য না ফেলা এবং এর ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসন ও কর্ণফুলীর নাব্য ফিরে পেতে গত পাঁচ বছরে যে চারটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে সরকার, তার যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। কর্ণফুলীকে রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি প্ল্যান করতে হবে এবং নদীর দখলদারদের দ্রুত উচ্ছেদ করতে হবে। কারণ দখলের কারণেই নদীর প্রশস্ততা কমে গেছে। পাশাপাশি নদীর দূষণ কমাতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। আদালতের রায় অনুযায়ী কর্ণফুলী নদী রক্ষা করতে হবে। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। নদী দখল ও দূষণের সঙ্গে জড়িতদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। দেশের সব নদনদী রক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। নদী দখল ও নাব্য হারানো যেমন বছরের পর বছর অব্যবস্থাপনার কারণে সৃষ্টি হয়েছে, ঠিক তেমনি উচ্ছেদ অভিযান ও ড্রেজিং পদ্ধতি সারা বছর চলমান থাকা জরুরি। কেবল যৌথভাবে ও কঠোর পদক্ষেপ নিলেই কর্ণফুলী নদী তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে।

আবির হাসান সুজন : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App