×

অর্থনীতি

টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তায় নজর

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২২, ০৮:৫০ এএম

দেশীয় গ্যাস-কয়লা উত্তোলন, তেলের মজুত ও পরিশোধন সক্ষমতা বাড়ানো, পাইপলাইনে ডিজেল আমদানি

ভবিষ্যতে জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় ‘দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি নিরাপত্তা কৌশল’ নিয়ে কাজ শুরু করেছে সরকার। ভবিষ্যতে জ্বালানি সংকট নিরসনে তেল ও গ্যাস আমদানির জন্য বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে ইতোমধ্যেই। ভারত থেকে পাইপলাইনে ডিজেল আনার কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। একইসঙ্গে দেশীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনের লক্ষ্যে কাজ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন বাড়ানোর জন্য নতুন নতুন উদ্যোগ নিয়েও কাজ চলছে। শিগগিরই একাধিক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম এ প্রসঙ্গে বলেন, দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি নিরাপত্তায় সরকারকে জোরাল কৌশল নিতে হবে। জ্বালানির অভাবেই বর্তমান বিদ্যুৎ সংকট। বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য স্থানীয় গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে হবে, প্রয়োজনে কিছু গ্যাস আমদানিও করতে হবে। ভোলার গ্যাস শতভাগ ব্যবহারের জন্য দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কয়লা মাটির নিচে রেখে দিলে সুফল আসবে না। কয়লা তুলে ব্যবহারেই সুফল। কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কয়লা উত্তোলন হলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানি আমদানির প্রয়োজন নেই। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি আমদানিনির্ভর না হয়ে স্থানীয় উৎসগুলোর ওপর নির্ভরতাও বাড়াতে হবে।

গ্যাস: দেরিতে হলেও দেশীয় ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলনে সরকার কাজ শুরু করেছে। পেট্রোবাংলা ২০২২ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৬টি অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও ওয়ার্কওভার গ্যাস কূপ খননের পরিকল্পনা নিয়েছে। ভোলায় ইলিশা-১ ও ভোলা নর্থ-২ কূপ জুনের মধ্যে খননকাজ শুরু হবে। এই দুইটি কূপ থেকে আগামী ২ বছরের মধ্যে ৫ কোটি ৫০ লাখ ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাবে। ভোলার শাহবাজপুরের টবগী-১ গ্যাস কূপ থেকে প্রতিদিন ২ কোটি ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাবে। আগামী ৩-৪ বছরের মধ্যে এসব গ্যাসকূপ থেকে ৭০-৮০ কোটি ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাবে। ভোলা থেকে পাওয়া গ্যাস বিকল্প উপায়ে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। একটি বিদেশি কোম্পানি পাইপলাইন স্থাপনের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন জানান, চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইকে স্বপ্রণোদিত হয়ে গ্যাস দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। কারণ ব্রুনাই, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কাতারসহ বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। তারা প্রত্যেকে আমাদের এলপিজি (তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস) গ্যাস দিতে চেয়েছে। এখন আমাদের সোর্স কান্ট্রি অনেক থাকায় জ্বালানি তেল নিয়ে আমরা খুব বেশি চিন্তিত নই।

তেল: ভবিষ্যতে জ্বালানি তেলের সংকট মোকাবিলায় নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ৬০ দিনের জ্বালানি তেলের মজুত রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সরকার অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিশোধনের জন্য নতুন রিফাইনারি স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। ইস্টার্ন রিফাইনারির ১৫ লাখ মেট্রিক টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল (ক্রুড অয়েল) পরিশোধনের সক্ষমতা রয়েছে। ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য সক্ষমতা দ্বিগুণ করে ৩০ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এজন্য একটি ‘পরামর্শক প্রতিষ্ঠান’ কাজ করছে। এছাড়া বিপিসির নিজস্ব অর্থায়নে আরো একটি রিফাইনারি স্থাপনে সরকারকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। বর্তমানে দেশে ৪৫ দিনের জ্বালানি তেল মজুতের সক্ষমতা রয়েছে।

জ্বালানি সচিব মাহবুব হোসেন জানান, অল্প সময়ের মধ্যেই নতুন রিফাইনারি প্রস্তুত হবে। তাছাড়া জ্বালানি তেলের মজুত বাড়ানোর বিষয়েও কাজ শুরু হয়েছে। ৬০ দিনের তেল মজুতের সক্ষমতা অর্জনের জন্য ডিপো স্থাপনের কাজ চলছে। এটা হলে আমরা আরো নিশ্চিন্ত হতে পারব।

এদিকে ভারত থেকে পাইপলাইনে ডিজেল আমদানির উদ্যোগ জোরাল হয়েছে। ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন প্রকল্পে’র মাধ্যমে আগামী বছরের মার্চ মাস থেকে দেশে ডিজেল আমদানি শুরু হবে। ২০২০ সালে পাইপলাইন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ভারতের নুলাইবাড়ি রিফাইনারি লিমিটেড থেকে দিনাজপুরের পার্বতীপুর তেল ডিপো পর্যন্ত ১৩১ দশমিক ৫০ কিলোমিটার পাইপলাইন বসানোর কাজ চলছে। এর মধ্যে ভারতের অংশে রয়েছে ৫ কিলোমিটার। বাংলাদেশের অংশে ১২৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার। প্রতি বছর প্রায় ৩৬ লাখ টন ডিজেল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। পাইপলাইন চালুর পর কম খরচে ভারত থেকে জ্বালানি তেল আমদানি শুরু হলে জ্বালানি সংকট অনেকটাই কেটে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

এদিকে গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরকালে হায়দরাবাদ হাউসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে ভারত থেকে বাংলাদেশে জ্বালানি তেল আমদানির বিষয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। ভারত থেকে তেল আমদানি করতে পারবে বাংলাদেশ।

পাইপলাইনের প্রস্তাব: এই মুহূর্তে ভোলা থেকে গ্যাস পাওয়ার আশা জেগেছে। কিন্তু সরাসরি সঞ্চালন ব্যবস্থার অভাবে ভোলার গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। সরকার ভোলার গ্যাস মূল ভূখন্ডে আনার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। পাইপলাইন স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে। একটি বিদেশি কোম্পানি পাইপলাইন স্থাপনে আগ্রহ দেখিয়েছে। প্রস্তাবটি নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকরা কাজ করছেন। এছাড়া সিলিন্ডারের মাধ্যমে ভোলা থেকে গ্যাস এনে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা যায় কিনা তার সম্ভাব্যতা নিয়ে কাজ চলছে। তবে এই প্রক্রিয়া কিছুটা ব্যয়বহুল।

বিদ্যুৎ: বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী দেশের মানুষের চাহিদা মেটাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে জ্বালানির প্রয়োজন, তা না পাওয়ায় উৎপাদনে ঘাটতি হয় এবং সংকটের সূচনা হয়। আগামী দিনগুলোতে বিদ্যুতে সুখবর আছে। বর্তমানে ৭ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। এর মধ্যে মাতারবাড়ীতে নির্মাণাধীন ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট, রামপালে ১ হাজার ৩২০, চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটসহ আরো অনেক ছোট ও মাঝারি ধরনের বিদ্যুৎ প্রকল্প উৎপাদনে এলেই বিদ্যুৎ সংকট এতটা থাকবে না।

বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছেন, গ্যাস না পাওয়া গেলেও আমাদের বিকল্প জ্বালানির বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসতে শুরু করেছে। কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে আগামী গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে।

কয়লা: বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী দেশে বর্তমানে ৭ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণাধীন রয়েছে। এতে বিপুল পরিমাণ কয়লার প্রয়োজন হবে। ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা কয়লায় রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে। তাই ভবিষ্যৎ জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় দেশীয় কয়লা উত্তোলনে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) গবেষণায় দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া, দীঘিপাড়া ও ফুলবাড়ী, জয়পুরহাটের জামালগঞ্জ ও রংপুরের খালাসপীরসহ ৫টি খনিতে মোট ৭ হাজার ৮০০ মিলিয়ন টন কয়লার মজুত রয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, দিনাজপুরের দীঘিপাড়া খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এই খনির সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। ২০১৭ সালে জার্মানভিত্তিক মিবরাগ কনসাল্টিং ইন্টারন্যাশনাল, নেদারল্যান্ডসভিত্তিক ফুগরো এবং অস্ট্রেলিয়ার রাঞ্জ পিনকক মিনারকোর যৌথ কনসোর্টিয়াম গঠনের পর বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড (বিসিএমসিএল) চুক্তি করে। এই কনসোর্টিয়াম ২০২০ সালের শুরুতে পেট্রোবাংলার কাছে তাদের প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদনে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের পক্ষে মতামত জানায়। কিন্তু কনসোর্টিয়াম যে পরিমাণ ব্যয়ের কথা বলছে, তা সত্যিকার অর্থে অনেক বেশি। এ কয়লা উত্তোলন করতে ব্যয় হবে প্রতি টনে ১৬০ ডলার। এ কারণে কনসোর্টিয়ামের প্রতিবেদনটি এখন ব্রিটিশ কোম্পানি ডিএমটির মাধ্যমে পর্যালোচনা করানোর কাজ চলছে।

বিসিএমসিএলের একটি সূত্র জানায়, জয়পুরহাটের জামালগঞ্জের খনিতে সবচেয়ে বেশি ৫৪৫ কোটি টন কয়লা মজুত আছে। এছাড়া দীঘিপাড়ায় সাড়ে ৮৬ কোটি, বড়পুকুরিয়ায় ৩৯ কোটি, ফুলবাড়ীতে ৫৭ কোটি ২০ লাখ ও খালাসপীরে সাড়ে ৬৮ কোটি টন কয়লা মজুত রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেছেন, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে আমরা দেশের কয়লা উত্তোলনে যাব না। পরিবেশগত কারণেই এই পদ্ধতি আমাদের জন্য ভালো হবে না। এটা করা হলে অনেক মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হবে। বিকল্প উপায়ে কয়লা উত্তোলনের ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে।

বিদেশ: ভবিষ্যতে সংকট মোকাবিলায় নিজস্ব তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের পাশাপাশি বিদেশ থেকে আমদানির লক্ষ্যেও সরকার যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি রয়েছে। রাশিয়ার কাছ থেকেও অপরিশোধিত জ্বালানি তেল কেনার প্রস্তাব এসেছিল। রিফাইনারি সমস্যার কারণেই তেল কেনা সম্ভব হয়নি। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিদ্যুৎ খাতে বিতরণ ও সঞ্চালন অবকাঠামো গড়ে তুলতে জাপানের আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা জাইকাকে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন। গত মাসে ঢাকায় জাইকার নবনিযুক্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর তমুহিদে ইচিগুচির সঙ্গে মন্ত্রণালয়ে সাক্ষাৎকালে প্রতিমন্ত্রী এই আহ্বান জানান। বাংলাদেশের গ্যাস ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন এবং বিতরণ ব্যবস্থা আধুনিকায়নেও জাইকার কাজ করার সুযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, বিদ্যুতের ঘাটতি মেটাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে আমরা কাজ করছি। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানি প্রয়োজন। জ্বালানির সাপ্লাই চেইনে সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটেছে। দুই তিন মাসের মধ্যে কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্ল্যান্ট উৎপাদনে এলে ঘাটতি কমবে। একইসঙ্গে সঞ্চালন লাইনের কাজও চলছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App