×

মুক্তচিন্তা

জাকাত তহবিল ব্যবস্থাপনা বিল ২০২২ : দেশের দারিদ্র্য দূরীকরণে ভূমিকা রাখবে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২২, ১২:৩৮ এএম

জাকাত তহবিল ব্যবস্থাপনা বিল ২০২২ : দেশের দারিদ্র্য দূরীকরণে ভূমিকা রাখবে

বিশ্বমানবতার মহান মুক্তিদূত মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) পবিত্র ইসলামের মূল ভিত্তি বা স্তম্ভ হিসেবে পাঁচটি বিষয়কে উল্লেখ করেছেন। বুখারি ও মুসলিম শরিফে বিবৃত রাসুল (সা.)-এর বাণী- ‘বুনিয়াল ইসলামা আলা খামসিন’ অর্থাৎ ইসলাম পাঁচটি ভিত্তিমূলের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ইসলামের সেই পাঁচ ভিত্তির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জাকাত; পবিত্র হাদিসে যা পঞ্চম স্থানে বিবৃত হয়েছে। হাদিসের ভাষ্যমতে, দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে নামাজ- যা মানুষকে যাবতীয় অশ্লীল ও পাপাচার থেকে নিবৃত করে। কুরআনে কারিমে অন্তত বিরাশি জায়গায় ‘আক্বিমুস সালাত ওয়া আতুয্যাকাত’ অর্থাৎ নামাজ কায়েম করো এবং জাকাত দান করো (২:৪৩) বলে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জাকাতের পরই হজের স্থান- যা পরিশুদ্ধ আত্মার ঐকান্তিক প্রত্যাশার ইবাদত। নামাজ, জাকাত এবং হজব্রত পালন- এ তিনটি বিষয়কে শক্ত ভিত্তিমূলের ওপর দাঁড় করাতে প্রথমেই যাকে স্থান দেয়া হয়েছে সেটি হলো মহান সত্তার একত্ববাদের ঘোষণা এবং তার প্রেরিত রাসুলের সত্যায়ন। তাওহিদ ও রেসালতের স্বীকৃতি দিয়ে বান্দাহ নামাজের মাধ্যমে নিজের শারীরিক ও আত্মিক উন্নয়ন ঘটায় এবং জাকাত প্রদানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক পরিশুদ্ধি ও প্রবৃদ্ধি আনয়ন করে। ইসলামে জাকাতের বিধান প্রবর্তন করা হয়েছিল মূলত দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে। জেহালতের যুগে পুঁজিপতি অর্থনৈতিক নীতি-নির্ধারকদের তৈরি করা সম্পদের বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে একটি সুষম অর্থনৈতিক ব্যবস্থার শক্ত ভীত গড়ে দিয়েছিল জাকাতভিত্তিক অর্থনীতির মানবতাবাদী এই পদ্ধতি; যা তৎকালীন সমাজে দৃশ্যমান পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। ন্যায়সঙ্গত, আইনানুগ ও নীতিনিষ্ঠ পন্থায় সম্পদের উপার্জনকে ইসলাম নিরুৎসাহিত করে না, বরং সম্পদশালীরা যেন সেই অর্জিত ও অধিকারে থাকা সম্পদের হিসাব অনুযায়ী অভাবী ও দরিদ্র মানুষের মাঝে জাকাতের অর্থ প্রদান করে সে ব্যাপারে ইসলাম আবশ্যকীয় করণীয় নির্ধারণ করে দিয়েছে। সমাজ, রাষ্ট্র বা সরকারি ব্যবস্থাপনায় যদি সঠিকভাবে জাকাতের অর্থ উত্তোলন ও বিতরণ করা সম্ভব হয় তবে তা দেশ ও জাতির জন্য বৃহত্তর কল্যাণ বয়ে আনবে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে যাদের উপরে জাকাতের বিধান ফরজ রয়েছে তারা যদি বিধান অনুযায়ী জাকাতের অর্থ প্রদান করে এবং সেই সমুদয় অর্থ যদি প্রকৃত হকদারদের মাঝে বণ্টন করা যায়, তবে এ দেশে দারিদ্র্য বিমোচন সময়ের ব্যাপার মাত্র। বর্তমান সরকার সম্প্রতি এ বিষয়ে একটি শুভ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে- যা বাস্তবায়িত হলে দেশের অর্থনীতির সমৃদ্ধি আসার পাশাপাশি ধনী-নির্ধনের বৈষম্যও কমে আসবে। সরকারিভাবে জাকাত আদায় ও বিতরণের বিধান রেখে গত ৬ নভেম্বর ‘জাকাত তহবিল ব্যবস্থাপনা বিল ২০২২’ মহান জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হয়েছে। বিলের প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে- ‘জাকাত সংগ্রহ, বিতরণ, ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা সংক্রান্ত নীতিমালা তৈরির ক্ষমতা বোর্ডের থাকবে। স্থানীয়ভাবে জাকাত সংগ্রহ ও বিতরণে কেন্দ্রীয়, সিটি করপোরেশন, বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক কমিটি গঠন করতে পারবে। দেশের অভ্যন্তরে সংগৃহীত জাকাত, প্রবাসী বাংলাদেশি মুসলিম নাগরিক, কোনো বিদেশি মুসলিম ব্যক্তি বা কোনো সংস্থায় জমাকৃত জাকাতের অর্থ থেকে পাওয়া জাকাত এবং শরিয়াসম্মত অন্য কোনো উৎস থেকে পাওয়া জাকাত থেকে তহবিল গঠন হবে। শরিয়াসম্মত খাত ছাড়া জাকাতের অর্থ অন্য কোনো খাতে জাকাতের অর্থ ব্যয় বা বিতরণ করা যাবে না।’ ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান আশা প্রকাশ করেছেন যে, জাকাতের মাধ্যমে একসময় পুরো মুসলিম বিশ্বে যেমন দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব হয়েছিল, এ বিল পাস ও কার্যকর করা হলে আমাদের দেশেও তা দারিদ্র্য দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বিপন্ন মানবতার স্বার্থে কুরআনে কারিমের বাণী- ‘ওয়াফি আমওয়ালিহিম হাক্কুল্ লিস্সাইলি ওয়াল মাহরুম’ অর্থাৎ তোমাদের সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে (৫১:১৯)। এই অধিকার হচ্ছে জাকাত, দান, সাদকা, ফেতরা বা অন্য কোনো উপায়ে প্রদত্ত আর্থিক সহযোগিতা। জাকাতের সঙ্গে সম্পদে বরকত এবং প্রবৃত্তির পরিশুদ্ধতার বিষয়টি জড়িত। আর্তমানবতার সেবা, অভাবীদের পাশে থাকা ও তাদের শরিয়া নির্ধারিত জাকাত দিয়ে সহযোগিতা করা এবং সমাজে সাম্য-মৈত্রীর অবস্থান তৈরিতে ভূমিকা রাখা প্রতিটি মুসলিম সম্পদশালীর নৈতিক ও ধর্মীয় আবশ্যিক দায়িত্ব; আর এ দায়িত্ববোধ না থাকলে তাকে মহান আল্লাহর কাছে কঠিন জবাবদিহি করতে হবে এবং এর মর্মান্তিক পরিণতিও ভোগ করতে হবে। জাকাত প্রদানের মাধ্যমে অভাবী, প্রার্থী, ফকির-মিসকিন ও বঞ্চিতদের প্রতি সম্পদশালীদের পুরোপুরি মমত্ববোধ ও সহানভূতি প্রকাশের বিষয়টিও সার্থক রূপ লাভ করে। পবিত্র কুরআনের নির্দেশনার বাস্তবায়ন প্রতিটি মুসলিমের ওপরই অবধারিত; সে মতে, জাকাতের এই পদ্ধতিকে আবশ্যিক ইবাদত হিসেবে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে এর উত্তোলন ও সুষ্ঠু বিতরণে ভূমিকা পালন এবং এ বিষয়ে সরকারকে সহযোগিতা করা আমাদের দায়িত্ব। সরকার এ মহান প্রয়াসে যদি সফল হয় তবে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং দারিদ্র্য বিমোচনে অনেকখানি এগিয়ে যাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। পবিত্র কুরআনে মানবসম্পদের বণ্টন-প্রক্রিয়ার মূলনীতি ঘোষিত হয়েছে এভাবে- ‘লায়াকুনা দওলাতাম বাইনাল আগনিয়াই মিনকুম’ অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তবান, ঐশ্বর্য বা সম্পদ কেবল তাদের মধ্যেই যেন আবর্তিত না হয় (৫৫:৭)। এখানে অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার এক মানবতাবাদী পদ্ধতি নির্দেশ করা হয়েছে; জাকাতের হক আদায় করে যা সম্পন্ন করা যায়। বুখারি ও মুসলিম শরিফে বিবৃত এক হাদিসে কুদসিতে রয়েছে- ‘হে আদম সন্তান! তুমি দান করতে থাকো, আমিও তোমায় দান করব।’ মহানবী (সা.)-এর একটি বাণী এখানে প্রণিধানযোগ্য- ‘ইবাদতে মশগুল কৃপণ ব্যক্তির চেয়ে মূর্খ দানশীল ব্যক্তি আল্লাহর কাছে অনেক বেশি প্রিয়পাত্র।’ আল্লাহর বাণী- ‘খুয্ মিন আমওয়ালিহিম সাদাকাতান তুতাহ্হিরুহুম ওয়া তুযাক্কিহিম বিহা’ অর্থাৎ সম্পদশালীদের সম্পদ থেকে জাকাত গ্রহণ করো, যেন তুমি এর মাধ্যমে তাদের সম্পদকে পবিত্র ও পরিশোধিত করতে পারো (৯:১০৩)। ‘ওয়ামা আতাইতুম মিন যাকাতিন তুরিদুনা ওযাজহাল্লাহি ফাউলাইকা হুমুল মুযইফুন’ অর্থাৎ প্রভুর সন্তুষ্টি বিধানে যে জাকাত প্রদান করা হয়ে থাকে তাতে সম্পদের বৃদ্ধি পায় এবং তারাই সমৃদ্ধশালী হয় (৩০:৩৯)। এসব ঐশী নির্দেশনার বিশ্লেষণে আমরা যদি মহানবী (সা.)-এর বক্তব্যের সমন্বয় ঘটাই তবে আরো পরিষ্কাররূপে যা দেখতে পাব- ‘যদি কেউ তার সম্পদের জাকাত আদায় করে তবে নিশ্চিতরূপে তার সম্পদ হতে যাবতীয় অকল্যাণ দূরীভূত হবে এবং সম্পদে প্রবৃদ্ধি আসবে।’ আর সেই প্রবৃদ্ধির ভাগ ও বরকত সমগ্র দেশ ও জাতি লাভ করবে।

ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন : চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক; ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App