×

শিক্ষা

চট্টগ্রাম বোর্ডে এইচএসসির ৪০ নম্বরের প্রশ্নে ৪১ ভুল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২২, ০৮:৪২ এএম

চট্টগ্রাম বোর্ডে এইচএসসির ৪০ নম্বরের প্রশ্নে ৪১ ভুল

ছবি: সংগৃহীত

চলমান এইচএসসি পরীক্ষার চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের বাংলা প্রথমপত্রের ৪০ নম্বরের সৃজনশীল প্রশ্নে ৪১টি ভুল পাওয়া গেছে। এই ভুল নিয়ে চট্টগ্রাম বোর্ড নীরব থাকলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ব্যাপক হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে। গত রবিবার পরীক্ষাটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। নানা অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথ গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, এত ভুল কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আমরা এখন বাংলা প্রথমপত্রের প্রশ্ন প্রণয়নকারী ও পরিশোধনকারীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেব। তার মতে, ভুল প্রশ্ন প্রণয়নকারী ও পরিশোধনকারীরা যেন ভবিষ্যতে বোর্ডের কোনো কাজে সম্পৃক্ত হতে না পারে সে বিষয়ে আন্তঃশিক্ষাবোর্ড ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হবে।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, সৃজনশীল প্রশ্নপ্রণয়ন পদ্ধতি না বোঝার কারণেই এমন ঘটনা ঘটছে। গত রবিবার ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বাংলা প্রথমপত্রের প্রশ্নে সৃজনশীলতার নামে সাম্প্রদায়িকতার উসকানি থাকার অভিযোগে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। পাশাপাশি কারিগরি বোর্ডে ভুল প্রশ্ন বিতরণ করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়েও বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে কোনো পাবলিক পরীক্ষার আগে শতভাগ প্রস্তুতির পাশাপাশি সর্বাত্মক সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। তাদের মতে, পরীক্ষা উপলক্ষে পর্যাপ্ত সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে বলে মনে হয় না। এ ধরনের ঘটনার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের কোনো ঘটনা না ঘটে তার জন্য সর্বাত্মক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

জানতে চাইলে প্রফেসর ইমেরিটাস সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, প্রশ্নপত্রে এমন ভুল বিস্ময়কর ব্যাপার! একটি পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন। কে করল এমন প্রশ্ন? মডারেটর কী করলেন? এই প্রশ্নগুলোর তো জবাব পাওয়া দরকার। তার মতে, সৃজনশীল প্রশ্নপত্র নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠছে। শিক্ষকরা প্রশ্ন করার সময় এমন উদ্ভট প্রশ্ন করছেন। শিক্ষার্থীরাও উদ্ভট উত্তর দিচ্ছে।

হাস্যকর করে ফেলেছে এই সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা। সব মিলিয়ে না বোঝার কারণে সৃজনশীল প্রশ্ন শিক্ষার বড় ক্ষতি করেছে। এই পদ্ধতি শিক্ষকরাও বোঝেন না, শিক্ষার্থী-অভিভাবকরাও বোঝেন না। একটি ধারা প্রতিষ্ঠা করতে হলে আগে তা বোঝার সক্ষমতা রাখতে হয়। আমাদের এখানে তা হয় না। এ কারণেই প্রশ্নপত্রে বারবার এমন হচ্ছে।

এদিকে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি পরীক্ষার একটি প্রশ্নপত্রে লেখক ও সাংবাদিক আনিসুল হককে হেয় করার অভিযোগ উঠেছে। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের বাংলা-২-এর একটি সৃজনশীল প্রশ্নের উদ্দীপকে লেখক আনিসুল হকের নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘২১শে বইমেলায় তাড়াহুড়ো করে তিনি বই প্রকাশ করেন। পাঠকদের কাছে তার লেখা খাপছাড়া মনে হয়। ফলে পাঠকদের কাছে তিনি সমাদৃত হন না।’ এরপর প্রশ্ন করা হয়েছে, ‘‘(ক) ‘যশ’ শব্দের অর্থ কী? (খ) ‘লেখা ভালো হইলে সুনাম আপনি আসিবে।’ উক্তিটি ব্যাখ্যা কর। (গ) আনিসুল হক কোন কারণে ব্যর্থ, তা ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ রচনার আলোকে ব্যাখ্যা কর। (ঘ) সাহিত্যের উন্নতিকল্পে ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ রচনায় লেখকের পরামর্শ বিশ্লেষণ কর।’’ গত রবিবার হয়ে যাওয়া এ পরীক্ষায় কারিগরি বোর্ডের প্রশ্ন নিয়ে এরইমধ্যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

লেখক আনিসুল হককে হেয় করে প্রশ্ন করার বিষয়ে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান আলী আকবর খান বলেন, প্রশ্ন পড়ে আমি কষ্ট পেয়েছি। একজন শিক্ষক কীভাবে এমন প্রশ্ন করতে পারেন, তা বোধগম্য নয়। এ প্রশ্নপত্র তৈরিতে যুক্ত শিক্ষককে খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ভাষাবিদ ড. মোহাম্মদ আমীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন, চট্টগ্রাম বোর্ডের বাংলা (আবশ্যিক) সৃজনশীল (প্রথমপত্র) ৪০ নম্বরের প্রশ্নপত্রে ৪১টি ভুল/অসঙ্গতি পাওয়া গেছে। ‘বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান’ (বাএআবাঅ) এবং বাংলা একাডেমি প্রণীত ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ (বাএপ্রবাবানি) পুস্তিকা অনুসারে ভুল/অসংগতিসমূহ চিহ্নিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, মাতৃভাষার প্রতি এমন অবহেলা পৃথিবীর আর কোনো জাতির মধ্যে দেখা যায় না। শিক্ষকরা যদি এমন আচরণ করেন তো সাধারণ বাঙালির কী অবস্থা হবে তা ভাবতেই লজ্জা আর শঙ্কায় নত শিউরে উঠতে হয়।

চট্টগ্রাম বোর্ডের প্রশ্ন ঘেঁটে দেখা গেছে, ৪ পৃষ্ঠার প্রশ্নের পূর্ণমান ৪০। ‘হালদা’ নামের প্রশ্নের এক নম্বর পৃষ্ঠায় ৫টি ভুল। এর মধ্যে প্রশ্নের শুরুতেই ১. ‘যে কোনো’ লেখা আছে। প্রকৃতপক্ষে এটি ‘যে-কোনো অথবা যেকোনো’ এভাবে লেখা উচিত। ২. দাবী> দাবি, ৩. আকাশ ছোঁয়া> আকাশ-ছোঁয়া, ৪. সঙ্গতিপূর্ণ> সংগতিপূর্ণ, [(সংগতি+পূর্ণ) বাএআবাঅ, পৃষ্ঠা: ১২৬৫], ৫. নেয়না> নেয় না [না-বাচক না এবং নি-এর প্রথমটি (না) স্বতন্ত্র পদ হিসেবে এবং দ্বিতীয়টি (নি) সমাসবদ্ধ হিসেবে ব্যবহৃত হবে। বাএপ্রবাবানি, অনুচ্ছেদ: ৩.৩]। দ্বিতীয় পৃষ্ঠার প্রশ্নের ভুলগুলোর মধ্যে রয়েছে, ৬. মুক্তি বাহিনীতে> মুক্তিবাহিনীতে (বাএআবাঅ, পৃষ্ঠা: ১১১৮)। একবার লেখা হয়েছে ‘মুক্তি বাহিনী’ আরেকবার লেখা হয়েছে ‘মুক্তিবাহিনী’। ৭. তাকে> তাঁকে [একই ব্যক্তির জন্য পরের সর্বনামসমূহে চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার করা হয়েছে।] ৮. দেননা> দেন না [না সংশ্লিষ্ট পদ হতে ফাঁক রেখে বসে; বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম, অনুচ্ছেদ: ৩.৩, প্রাগুক্ত: ৫] ৯. লাগবেনা> লাগবে না [প্রাগুক্ত: ৫], ১০. গার্মেন্টস কর্মী> গার্মেন্টসকর্মী [বাএপ্রবাবানি, অনুচ্ছেদ: ৩.১], ১১. নানা-নানীর> নানা-নানির [বাএআবাঅ, পৃষ্ঠা: ৭২৬], ১২. গরীব> গরিব [বাএআবাঅ, পৃষ্ঠা: ৩৯০], ১৩. নানা-নানী> নানা-নানি [বাএআবাঅ, পৃষ্ঠা: ৭২৬], ১৪. সাধ্যমত> সাধ্যমতো [বাএআবাঅ, পৃষ্ঠা: ১৩১৮], ১৫. হলনা> হলো না [বাএআবাঅ, পৃষ্ঠা: ১৩৮৫, বাএপ্রবাবানি, অনুচ্ছেদ: ৩.৩], ১৬. নানা-নানীর> নানা-নানির [বাএআবাঅ, পৃষ্ঠা: ৭২৬], ১৭. নানা-নানী> নানা-নানি [বাএআবাঅ, পৃষ্ঠা: ৭২৬], ১৮. নানা-নানীর> নানা-নানির [বাএআবাঅ, পৃষ্ঠা: ৭২৬], ১৯. ছেলে- মেয়েরা > ছেলে-মেয়েরা [হাইফেনের পর ফাঁক হয় না।], ২০. নেয়ার> নেওয়ার [নেয়ার অর্থ খাটের পৃষ্ঠদেশে বুননের জন্য (কাঠের পাটাতনের পরিবর্তে) ব্যবহৃত মোটা সুতোয় বোনা চওড়া ফিতে (বাএআবাঅ, পৃষ্ঠা: ৭৬০)। ‘নেয়া’ শব্দটি ‘লওয়া’ অর্থে আঞ্চলিক ভাষায় ব্যবহৃত হতে পারে।]। তৃতীয় পৃষ্ঠার ভুলগুলো হচ্ছে, ২১. হৈচৈ> হইচই [বাএআবাঅ, পৃষ্ঠা: ১৩৭৯], ২২. গরীব ঘরের> গরিব ঘরের [বাএআবাঅ, পৃষ্ঠা: ৩৯০], ২৩. বয়সী> বয়সি [বাএআবাঅ, পৃষ্ঠা: ৯১৯], ২৪. বয়সী> বয়সি [বাএআবাঅ, পৃষ্ঠা: ৯১৯], ২৫. চায়না> চায় না [চায়না একটি দেশ ও ভাষার নাম; প্রাগুক্ত: ৫], ২৬. ভেংচি> ভ্যাংচি [ভ্যাংচানো থেকে ভেংচি; বাএআবাঅ, পৃষ্ঠা: ১০৬১], ২৭. শাড়ীর> শাড়ির [বাএআবাঅ, পৃষ্ঠা: ১২২৯], ২৮. সঙ্গতিপূর্ণ> সংগতিপূর্ণ (সংগতি+পূর্ণ; বাএআবাঅ, পৃষ্ঠা: ১২৬৫]। চার নম্বর পৃষ্ঠার ভুলগুলো হচ্ছে, ২৯. বড়> বড়ো [বাএআবাঅ, পৃষ্ঠা: ৯১২], ৩০. উচ্চ শিক্ষা> উচ্চশিক্ষা [বাএআবাঅ এবং বাএপ্রমবাবানি, অনুচ্ছেদ: ৩.১], ৩১. পাঠায়> পাঠান [একই ব্যক্তির জন্য এর আগে সম্মানসূচক ক্রিয়া ব্যবহার করা হয়েছে।], ৩২. অসহায়, দুস্থ রোগীদের> অসহায় ও দুস্থ রোগীদের [বাক্য বিন্যাস অনুযায়ী কমা-চিহ্ন সমীচীন হয়নি।], ৩৩. তাবিজ কবজ> তাবিজ-কবজ/তাবিজকবজ [বাএপ্রবাবানি, অনুচ্ছেদ ৩.১], ৩৪. ঝাড় ফুঁক> ঝাড়ফুঁক [বাএআবাঅ, পৃষ্ঠা: ৫৪০], ৩৫. অন্ধ বিশ্বাস> অন্ধবিশ্বাস [বাএআবাঅ, পৃষ্ঠা: ৫৬], ৩৬. পারেনা> পারে না [প্রাগুক্ত: ৫], ৩৭. কোন> কোনো [বাংলা কোন (উচ্চারণ: কোন্) অর্থ (সর্বনামে) কী, কে, কোনটি (কোন বছর, কোন লোক, কোন জিনিস); (ক্রিয়াবিশেষণে) কী প্রকারে, কীভাবে, কীসে (তুমিই বা কোন লাট বাহাদুর)। এটি কোনো বা কোনও শব্দের সমার্থক নয়। যেমন: “তুমি কোন জামাটি চাও” বাক্যে একই অর্থ প্রকাশে ‘কোনও’ বা ‘কোনো’ ব্যবহার বিধেয় নয়। ৩৮. কোন দিকে> কোনোদিকে, ৩৯. শিকর> শিকড় [বাএআবাঅ, পৃষ্ঠা: ১২৩৩], ৪০. বড়>বড়ো [বাএআবাঅ, পৃষ্ঠা: ৯১২] এবং ৪১. সঙ্গতিপূর্ণ> সংগতিপূর্ণ (সংগতি+পূর্ণ; বাএআবাঅ, পৃষ্ঠা: ১২৬৫)।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App