×

মুক্তচিন্তা

প্রাযুক্তিক ছুরি ও একটি জাতির আত্মহত্যা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২২, ১২:২৬ এএম

প্রাযুক্তিক ছুরি ও একটি জাতির আত্মহত্যা

বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় ‘অ্যাপেল’ কোম্পানির ‘আধখাওয়া আপেল’-এর কথা বলছি না; যদিও এর সঙ্গে আমার আলোচনার বিষয়ের বেশ যোগাযোগ রয়েছে; আমি বলছি আপেল কাটার ছুরির কথা; আর সে ছুরি কোনো ঝকঝকে ধারালো ইস্পাতের ছুরি নয়; সে ছুরি এমন এক জনপ্রিয় কিন্তু ভয়ানক আর মোহময় ও ঐন্দ্রজালিক ছুরি, যা প্রায় সবার হাতেই রয়েছে; আর যে ছুরি দিয়ে ইচ্ছা করলেই নিজেকে অথবা অন্য কাউকে খুব সহজেই অদৃশ্যভাবে আর রক্তপাতহীনভাবে হত্যা করা যায়। আপেল কাটতে গিয়ে অসাবধানতাবশত হাত কেটে যাওয়া একটি নির্দোষ ও সাধারণ ঘটনা, যা কষ্ট হলেও মেনে নেয়া যায়; কিন্তু‘ আপেল কাটার ছুরি দিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনা কোনোক্রমেই কেউ মেনে নিতে পারেন না; এটি একটি সচেতন অপরাধ; অথচ আমরা একেকজন এই ছুরি দিয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ হত্যার মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটিয়ে চলেছি প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে নির্বিচারে। এই হত্যাযজ্ঞটি ঘটে চলেছে অতি ধীরে; খুবই সঙ্গোপনে এবং অতি সন্তর্পণে; সবার চোখের সম্মুখে অথচ কাউকে না জানিয়ে; এমনকি কোনো ধরনের ভয়ভীতি প্রদর্শন ব্যতিরেকেই; বলা চলে স্কোপোলামিন বা ডেভিলস ব্রিদ নামক এক ধরনের ভয়ংকর মাদক যেভাবে নীরবে নির্দ্বিধায় নিজের নিয়ন্ত্রণ অন্যের হাতে তুলে দেয়; তেমনিভাবে এসব স্বীয় হত্যাকারী এবং ক্রমান্বয়ে নিহত হতে যাওয়া ব্যক্তিরাও তাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণ তুলে দিচ্ছে অন্যের হাতে তাদের নিজেরই অজান্তে; আর এই ভয়ংকর মাদক গ্রহণ না করেই এর চেয়েও ভয়াবহ রকম নেশায় আসক্তদের কেউই বুঝতে পারছেন না যে তারা নীরবে প্রতি মুহূর্তে এই হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করছেন; আর এভাবে এই হত্যাকাণ্ড একটি সুস্থ সবল তেজোদ্দীপ্ত জাতিকে ধীরে ধীরে ঠেলে দিচ্ছে অপরিণামদর্শী আত্মহত্যার দিকে! পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো দেশে কোনো কালে এমন জাতিগত আর মর্মান্তিক আত্মহত্যার উদাহরণ বোধ করি আর নেই! এই ভয়াবহতম মারণাত্মক নেশাটি এখন গ্রাস করে চলেছে এমনকি শিশু থেকে শুরু করে বয়োবৃদ্ধ সব মানুষকে; এর কোনো জাত-ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদ নেই; এমনকি এর কোনো নির্দিষ্ট দেশ-কাল-সীমানাও নেই; এর এমনকি কোনো শিক্ষিত-অশিক্ষিত বিচার-বিবেচনাও নেই; এ এক অন্ধ আর শীতল মাদক; এর ভয়ংকর থাবা থেকে যেন কারোরই মুক্তি নেই। পতঙ্গ যেমন মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও ঝাঁপ দেয় অগ্নিশিখায়; তেমনি আমরা পুরো একটি জাতি পতঙ্গের মতোই ঝাঁপ দিয়েছি এক লেলিহান অগ্নিশিখায় এবং প্রতি মুহূর্তেই আমরা এক অজানা আনন্দে আর অচেনা আগ্রহে ঝাঁপ দিয়ে চলেছি পরম মমতায় অমোঘ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে। সবাই একমত হবেন যে, বর্তমান সময়টি প্রযুক্তির উৎকর্ষের সময় শুধু নয়; বলা চলে পৃথিবী এখন মানবসভ্যতার ইতিহাসের চরমতম উৎকর্ষের এক সোনালি সময় অতিক্রম করছে। ইতিহাসের কোনো সময়েই প্রযুক্তির এত বিস্ময়কর উৎকর্ষের ঘটনা ঘটেনি। বিশেষ করে ইন্টারনেটের আবিষ্কার বিশ্বের প্রায় ৮০০ কোটি মানুষের সামনে প্রযুক্তির এক আশ্চর্য দুয়ার উন্মোচন করে দিয়েছে; বিপুল জনবহুল এই পৃথিবীকে পরিণত করেছে এক বিশ্বগ্রামে; মানুষ দূরতিক্রম্য দূরত্বকে জয় করতে সক্ষম হয়েছে; ঘরে বসে বাইরের বিশ্বকে এখন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে এই বিস্ময়কর প্রযুক্তির কল্যাণে। এই প্রযুক্তি এখন পৃথিবীর এক প্রান্তের মানুষের সঙ্গে অপর প্রান্তের চির অপরিচিত মানুষের মেলবন্ধন ঘটিয়েছে এবং তাদের পরস্পরের মাঝে গড়ে তুলেছে গভীর সখ্য; তথ্য আদান-প্রদান থেকে শুরু করে বহু কিছুই; যেটি একসময় আমাদের কল্পনায়ও ছিল না; বস্তুজগতের এমন প্রায় সব কিছুর আদান-প্রদানই সম্ভব ও বাস্তব করে তুলেছে এই তথ্যপ্রযুক্তি; অল্প সময়ের ভেতর শুধু নয়; অল্পমূল্যেও; এমনকি ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার সাধ্যের মধ্যেই। এমন বিস্ময় নিয়ে যার সগর্ব উত্থান ঘটেছে এই পৃথিবীতে আধুনিক সভ্যতার এই অনন্য সাধারণ সময়ে; তার হাত ধরেই আরো অন্যান্য অনেক বিস্ময়ের সঙ্গে সদ্য প্রস্ফুটিত গোলাপের কলিতে কীটের মতোই যেন চলে এসেছে সে; যেটিকে আমি তুলনা করতে চাই খাবার টেবিলের আপেল কাটার সেই ঝকঝকে ধারালো সুদর্শন ছুরিটির সঙ্গেই; যেটি দিয়ে আপেল কাটা যায় অত্যন্ত চমৎকারভাবে; কিংবা অসাবধানে আর অসচেতনভাবে কেটে ফেলা যায় নিজের বহুমূল্য আর অনবদ্য আঙুলটিও; অথবা চাইলে তার চেয়েও নির্মমভাবে হত্যা করা যায় কোনো সুস্থ-সবল সতেজ মানুষকে; কিংবা করা যায় মর্মান্তিক আত্মহত্যাও। আপনার চারপাশে পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিতে তাকালেই আপনি পরিষ্কারভাবে অনুধাবন পারবেন কীভাবে একজন-দুজন মানুষ শুধু নয়; গোটা একটি জাতি কীভাবে একই সঙ্গে ধীরে ধীরে আত্মহত্যা করে চলেছে। পৃথিবীর সব প্রান্তের মানুষে মানুষে মেলবন্ধন ঘটানোর লক্ষ্যে অভূতপূর্ব যোগাযোগ স্থাপনসহ তথ্য আদানপ্রদান ও অন্যান্য আনন্দ-বিনোদনের উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছে যে ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম; বিশেষ করে বহুলব্যবহৃত ফেসবুক ও ইউটিউব; সেটি আজ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে ডেভিলস ব্রিদের চেয়েও ভয়ানক, তীব্র আর মারাত্মক এক নেশা; আর এই মারাত্মক নেশায় আসক্ত হয়ে আমরা হয়ে পড়েছি এক কাল্পনিক জগতের বাসিন্দা। এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের পরস্পরের সঙ্গে পরস্পরকে যুক্ত করে দিয়েছে ঠিকই; কিন্তু‘ তার চেয়েও যেন অধিকতরভাবে আমরা পরস্পরের থেকে বিযুক্ত হয়ে পড়েছি ধীরে ধীরে এবং আশ্চর্যজনকভাবে নিজেদের অজান্তেই; আমরা হয়ে পড়েছি আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর। লক্ষ্য করলে দেখবেন, দশজন কিশোর-কিশোরী কিংবা দশজন তরণ-তরুণী একসঙ্গে বসে আছে এক চমৎকার রোদেলা বিকালে; কিন্তু কোনো কথা নেই তাদের পরস্পর-পরস্পরের সঙ্গে; কোনো গল্প নেই তাদের পরস্পরের ভেতরে; তারুণ্যের কোনো উচ্ছ¡াস নেই; হাসি-আনন্দ কিছুই নেই; তবে যা আছে তার সব তারা ঢেলে দিয়েছে মোবাইলের নেশাতুর রঙিন পর্দায়; সবার হাতেহাতে দামি মোবাইল ফোন আর তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ সেই মহামূল্যবান বস্তুটিতে; তারা একসঙ্গে থেকেও বড্ড একা আর নিঃসঙ্গ ভেতরে ভেতরে! এক ভোগসর্বস্ব প্রজন্ম বোধহীন আর স্বপ্নহীনভাবে বেড়ে উঠছে দিনে দিনে; তারা তো ভবিষ্যতের বোঝা ছাড়া আর কিছু নয়! ফেসবুক কিংবা ইউটিউবের কন্টেন্টে নিয়ন্ত্রণ না থাকায় কোমলমতি কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে যে কোনো বয়সের নারী-পুরুষের মোবাইল কিংবা টিভির পর্দায় চলে আসছে অনাকাক্সিক্ষত আপত্তিকর ভিডিও ক্লিপ; যা দর্শন করে অনেক কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী আজ বিপথগামী হয়ে পড়ছে। কিংবা টিকটকের নামে দেশে-বিদেশে তৈরি হচ্ছে অশ্লীল ও আপত্তিকর ভিডিও আর এসব ভিডিও অযাচিত ও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে প্রদর্শিত হচ্ছে তাদের মোবাইল কিংবা টিভির পর্দায়। তরুণ-তরুণীরা পড়াশোনার বদলে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠছে অবাধ যৌনতার হাতছানিতে; এমনকি বিবাহিত-অবিবাহিত পুরুষ-রমণীরা লিপ্ত হয়ে পড়ছে পরকীয়া নামক অনিয়ন্ত্রিত ও সামাজিকভাবে অস্বীকৃত এক অসুস্থ সম্পর্কে; ফলত বহু দম্পতির মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস এবং দাম্পত্য কলহ; স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততির সুন্দর ভবিষ্যৎ হারিয়ে যাচ্ছে গভীর অন্ধকারে; আর প্রযুক্তির এই নেতিবাচকতার প্রবল প্লাবনে আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের স্বপ্নের ভবিষ্যৎ। বিচ্ছিন্নতাই শুধু অর্জিত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এমনটি আপাত সত্য হতে পারে; কিন্তু‘ পুরোপুরি সত্য নয়; কেননা এর বিপুল উপকারী ও ইতিবাচক দিক রয়েছে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য ও অপরিহার্য বিষয় হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে; কারণ পৃথিবীর সব মানুষই এগুলোকে গ্রহণ করেছে। কিন্তু‘ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে অর্জিত ইতিবাচক বিষয়গুলো যেন ক্রমেই হেরে যাচ্ছে তার ভয়ংকর আর নেতিবাচক প্রভাবের কাছে। ফেসবুক ও ইউটিউবের প্রতি আমাদের অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত আসক্তি যে কোনোভাবেই হোক না কেন কাটিয়ে উঠতে হবে আর গ্রহণ করতে হবে তার ইতিবাচক বিষয়গুলো এবং সেজন্য আমাদের টেবিলের আপেল কাটার ছুরি দিয়ে আমাদের আপেলই কাটতে হবে এবং তা কাটতে হবে অবশ্যই সচেতনতা ও সতর্কতার সঙ্গে; আর তা না হলে ঘটে যেতে পারে আঙুল কেটে যাওয়ার মতো দুর্ঘটনা; এমনকি অপব্যবহারের কারণে বর্ণিতভাবে ক্রমেই বেড়ে যেতে পারে হত্যা কিংবা আত্মহত্যার মতো মারাত্মক ঘটনাও।

ড. মো. মামুন আশরাফী : কবি, রাষ্ট্রচিন্তক ও পর্যটন বিশেষজ্ঞ। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App