×

অর্থনীতি

একগুচ্ছ শর্ত আইএমএফের

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২২, ০৮:৪৯ এএম

ভর্তুকি কমানোয় জোর, ব্যয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, অর্থনৈতিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা

রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতিসহ অর্থনীতিতে ভর্তুকির বোঝা কমানো, খেলাপিঋণ কমিয়ে আনা, ব্যাংক ঋণের সুদের উপরিসীমা কয়েকটি খাতে বাড়ানো, সরকারের ব্যয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, অর্থনৈতিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার তাগিদসহ একগুচ্ছ সংস্কারের শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। সরকার এসব শর্ত পরামর্শ হিসেবে মেনে নিলেও এ বিষয়ে সুষ্পষ্ট দিকনির্দেশনা চায় সংস্থাটি। তবে এ ঋণ পেতে আইএমএফের সব শর্ত মানার পক্ষে নন দেশের শীর্ষ স্থানীয় অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেছেন, ভর্তুকি প্রত্যাহার ও গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে আইএমএফ যেসব শর্ত দিচ্ছে- এগুলো বাংলাদেশের বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না। এসব বিষয়ে আলোচনা করতে গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের সঙ্গে বৈঠকে বসে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। আজ বুধবার দুপুর ২টায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গেও বৈঠকে বসবে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। বিকাল ৪টায় যৌথ সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ মিশন শেষ হবে তাদের।

আইএমএফে বাংলাদেশের কোটা অনুযায়ী ৫৫০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার সক্ষমতা রাখে। তবে সরকার চেয়েছে কম। চলতি বছরের ২৪ জুলাই লেনদেনে ভারসাম্য, বাজেট সহায়তা ও অবকাঠামো খাতের জন্য ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়ে আইএমএফের কাছে সরকারের পক্ষ থেকে চিঠি পাঠানো হয়। পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক বোর্ড সভার ফাঁকে আইএমএফের সঙ্গে বৈঠক করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। সেই বৈঠকে ঋণ পাওয়ার বিষয়ে মৌখিকভাবে আশ্বাস পাওয়া যায়। ওই ঋণের ব্যাপারে আলোচনা করতে আইএমএফের দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল গত ২৬ অক্টোবর ঢাকায় আসে। ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জ্বালানি মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিএআরসি), পেট্রোবাংলা, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক করেছে প্রতিনিধিদলটি। ওইসব বৈঠকে দেশের সার্বিক অর্থনীতির অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হয়ে বেশ কিছু শর্ত বা সংস্কারের পরামর্শ চূড়ান্ত করে আইএমএফ। শর্তগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও একটি প্রতিবেদন তৈরি করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এতে আইএমএফের কোন কোন শর্ত মানা সম্ভব এবং কীভাবে মানা হবে- সে বিষয়ে একটি প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়েছে। ঋণ পেতে হলে কোন শর্ত কতদিনে বাস্তবায়ন করবে তার অঙ্গীকার চায় আইএমএফ। মিশন শেষ করে তারা ওয়াশিংটনে ফিরে গিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে তা তাদের প্রধান কার্যালয়ের উচ্চপর্যায়ে উপস্থাপন করবে। এর আলোকে নির্বাহী বোর্ডের সভা হবে। ওই সভায় ঋণ অনুমোদনের প্রক্রিয়াটি চূড়ান্ত হবে।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আইএমএফের সব শর্ত মানা উচিত হবে না। তবে কিছু শর্ত তো নিজস্ব উদ্যোগেই বাস্তবায়ন করা উচিত। শুধু যে আইএমএফ বলছে এ কারণেই নয়। আইএমএফের শর্তে ভর্তুকি একেবারে সব খাতেই তুলে দেয়া ঠিক হবে না। কিছু খাতে দিতে হবে। বিশেষ করে দরিদ্র মানুষ যেসব সেবা পায় সেগুলোতে ভর্তুকি দিতে হবে। তবে ধীরে ধীরে ভর্তুকি কমিয়ে আনতে হবে। একই খাতে বেশিদিন ভর্তুকি দেয়া ঠিক হবে না বলে মনে করেন তিনি।

সূত্র জানায়, আইএমএফের ঋণ পেতে সরকার তাদের প্রধান শর্তগুলো আলোচনা শুরুর আগেই বাস্তবায়ন করেছে। ইতোমধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে ৪৯ থেকে ৫২ শতাংশ। সার ও গ্যাসের দামও বাড়ানো হয়েছে। ভর্তুকি কমানোই হচ্ছে আইএমএফের প্রধান শর্ত। এসব ক্ষেত্রে দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কমানো হয়েছে। এর আগে গত রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করে ভর্তুকি বাজেটে বরাদ্দ অর্থের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। এর মাধ্যমেও বার্তা দেয়া হয়েছে সরকার ভর্তুকি খুব বেশি বাড়াবে না। সূত্র জানায়, এবার আইএমএফ অর্থনীতির তিনটি মৌলিক সূচক নিয়ে জোর আপত্তি তুলেছে। এগুলো নিয়ে তাদের আগেও আপত্তি ছিল। এগুলো হচ্ছে- রিজার্ভের নিট হিসাব প্রকাশ, জিডিপি ও মূল্যস্ফীতির হিসাব পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা, খেলাপি ঋণের নীতিমালায় ছাড় বন্ধ করা। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জিডিপি ও মূল্যস্ফীতির হিসাব পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে পরিসংখ্যান ব্যুরো কাজ করছে। এটি এখনই করা সম্ভব নয়। রিজার্ভ পদ্ধতির হিসাবের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, তারা এখনই রিজার্ভের দুটি হিসাব করে। এর মধ্যে একটি গ্রস ও অন্যটি নিট। এখন গ্রস হিসাবটি প্রকাশ করা হয়, নিট হিসাবটি প্রকাশ করা হয় না। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিট হিসাব করতে কোনো আপত্তি নেই। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক মানের করতে বলেছে আইএমএফ। বর্তমানে কোনো ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় শেষ হওয়ার ছয় মাস পর তা খেলাপি করা হয়। আন্তর্জাতিক মানে তা তিন মাস করতে হবে। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, করোনার কারণে এ ছাড় দেয়া হয়েছিল। করোনার প্রভাবের পর বৈশ্বিক মন্দার কারণে এ খাতে ছাড় দেয়া হচ্ছে। এর প্রভাব কেটে গেলে তা তুলে নেয়া হবে। আগে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক মানেই ছিল। ২০২০ সালে তা শিথিল করা হয়। ডলারের বিনিময় হার ইতোমধ্যেই বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ফলে আইএমএফের তিনটি প্রধান শর্ত বাস্তবায়ন করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, আইএমএফ ঋণের উপরিভাগ সুদের হার বাড়ানোর ব্যাপারে যে শর্ত দিয়েছে তা আপাতত মেনে নেয়া হতে পারে। বর্তমানে ঋণের হার উপরিভাগের সর্বোচ্চ ৯ শতাংশের পাশাপাশি কয়েকটি খাতে ১২ শতাংশ করার চিন্তাভাবনা রয়েছে। তবে সব খাতের জন্য না হলেও কয়েকটি খাতের জন্য বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে। বাংলাদেশের কিছু পণ্য আমদানিতে শুল্ক হার কমানোর ব্যাপারে আইএমএফের প্রস্তাবে সরকারের পক্ষ থেকে নমনীয় মনোভাব দেখানো হয়েছে। বর্তমান ট্যারিফ হার বেশি বলে মনে করছে আইএমএফ। রাজস্ব বাড়াতে একদিকে যেমন করের আওতা বাড়াতে বলা হয়েছে; তেমনি করের হার বাড়ানোর কথাও এসেছে আইএমএফের কাছ থেকে। এই দুটো ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি উঠেনি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। পুঁজিবাজার সংস্কার আর্থিক সংস্কারের একটি গুরত্বপূর্ণ অংশ। সরকারের ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ব্যাপারটিও আর্থিক খাতের আরো একটি অন্যতম অনুষঙ্গ। যে কারণে আইএমএফের এই শর্ত নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে তেমন কোনো আপত্তি উঠেনি। বরং সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এই কার্যক্রম চলমান। সূত্র জানায়, আইএমএফের আরো একটি প্রধান শর্ত হচ্ছে, রাজস্ব আয় বাড়ানো। বর্তমানে বাংলাদেশের কর জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশের নিচে। আইএমএফ এটিকে ১৪ শতাংশে উন্নীত করতে বলেছে। এজন্য বিভিন্ন খাতে করহার বাড়াতে হবে। এদিকে আমদানি পর্যায়ে শুল্ক কমাতে বলেছে। এ বিষয়ে সরকার কাজ করছে বলে জানানো হয়েছে। এটি রাতারাতি সম্ভব নয়।

সূত্র জানায়, আইএমএফ বলেছে, পেট্রোবাংলা লোকসানি প্রতিষ্ঠান। তারা গ্যাসের দাম বাড়ানোর জন্য বিইআরসিতে আবেদন করেছে। কিন্তু বাড়ানো হচ্ছে না। একইভাবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডও লোকসানি প্রতিষ্ঠান। তারা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আবেদন করেছে। কিন্তু বাড়ানো হচ্ছে না। এর কারণ জানতে চেয়েছে আইএমএফ। এ প্রসঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো সম্ভব নয়। কারণ এতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাবে। আইএমএফ এ বিষয়ে নমনীয় বলে জানা গেছে। এছাড়া তারা কৃষি খাতে ভর্তুকির ব্যাপারেও এবার নমনীয়। এ নিয়ে কিছুই বলেনি। যদিও অন্য সময় এ খাতের ভর্তুকিও তুলে দেয়ার শর্ত দিত। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, আইএমএফের এ যুক্তি সব দেশের জন্য সব সময়ে সঠিক নয়। এখন জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ালে মূল্যস্ফীতির হার লাফ দিয়ে বেড়ে যাবে। ফলে এগুলোর দাম এখন বাড়ানো ঠিক হবে না। কারণ এখন মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণই মূল লক্ষ্য। আর বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশকে দরিদ্র মানুষকে সহায়তা দিতে জ্বালানি, বিদ্যুৎ, সার- এগুলোতে ভর্তুকি দিতে হয়। ভর্তুকি না দিলে জীবনযাত্রার ব্যয় বেশিমাত্রায় বেড়ে যাবে। যেটি সাধারণ মানুষ সহ্য করতে পারবে না। তবে এই ভর্তুকির যাতে কোনো অপব্যবহার না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App