×

অর্থনীতি

শর্তগুলো কঠিন হলেও যৌক্তিক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২২, ০৮:৫০ এএম

আইএমএফের শর্ত মেনেই ঋণ নেয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের, ব্যাংক ঋণের সুদ বাড়ানোর প্রস্তাবে ব্যবসায়ীদের আপত্তি

দেশের অর্থনীতিতে চাপ বাড়ছে। প্রায় সব সূচকই ভোক্তা স্বার্থের প্রতিকূলে। নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতি। রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে ভাটার টান। আগে থেকেই চলছে ডলার আর রিজার্ভ সংকট।

জ্বালানি সংকটও প্রকট। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আরো চাপে পড়বে অর্থনীতি। পরিস্থিতি সামাল দিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে সরকার। এরকম এক পরিস্থিতিতে ঋণ সহায়তার বিষয়ে আলোচনা করতে ঢাকায় এসেছে আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল। ঋণের নানা শর্ত নিয়ে চলছে আলোচনা। জানা গেছে, বাজেট সহায়তায় আইএমএফের শর্ত মেনেই ঋণ নিচ্ছে বাংলাদেশ। তবে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে- ঋণ পেতে আইএমএফের শর্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য কতটা অনুকূলে! অনেকের মতে, এসব শর্তের কোনো কোনোটি বাস্তবায়ন কঠিন হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের অর্থনীতিতে যে সংকট তৈরি হয়েছে, সেটি কাটাতে আইএমএফসহ দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণ নেয়ার কোনো বিকল্প নেই। ঋণপ্রাপ্তিতে যত দেরি হবে, বৈদেশিক মুদ্রার সংকটও তত গভীর হবে। আর আইএমএফের প্রস্তাবগুলোও যৌক্তিক বলে মনে করেন তারা। তবে ঋণের সুদ বাড়ানোর প্রস্তাবে এরই মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ব্যবসায়ী মহল। তাদের আশঙ্কা, এর ফলে শিল্প খাত বিপাকে পড়বে। এছাড়া ভর্তুকি তুলে নিলে সাধারণ মানুষের দুর্দশা বাড়বে বলে মনে করেন কেউ কেউ।

ঋণ সহায়তা দিতে আইএমএফের এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল গত ২৬ অক্টোবর ঢাকায় এসেছেন। আগামী ৯ নভেম্বর পর্যন্ত অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করবে দলটি। বাংলাদেশ সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ চাওয়ার পর আনুষ্ঠানিক আলোচনার জন্য এ মিশন ঢাকায় এসেছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ৪৫০ কোটি ডলারের মধ্যে লেনদেনের ভারসাম্য বাবদ ১৫০ কোটি ডলার ও বাজেট সহায়তা বাবদ ১৫০ কোটি ডলার পাওয়া যেতে পারে। বাকি ১৫০ কোটি ডলার পাওয়া পেতে পারে আইএমএফের নতুন উদ্যোগ, সহনশীলতা ও টেকসই সহায়তা তহবিল থেকে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ মিলিয়ে বাংলাদেশের চাওয়া হচ্ছে এ বছরের মধ্যেই অন্তত ৩০০ কোটি ডলার ঋণ।

ঋণ সহায়তা পেতে আইএমএফ থেকে দেয়া শর্তগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যৌক্তিক বলে মনে করেন আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। জানতে চাইলে তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় আইএমএফ ঋণের বিকল্প নেই। সেক্ষেত্রে আইএমএফ থেকে দেয়া আনুমানিক শর্তগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যৌক্তিক বলে মনে করি। তিনি বলেন, যেসব শর্ত আইএমএফ দেবে বলে শোনা যাচ্ছে, সেগুলো এমনিতেই সরকারের করা উচিত। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিশ্বের প্রায় সব দেশ সুদের হার বাড়িয়েছে। উচ্চ সুদের সঙ্গে বিনিয়োগের কোনো সম্পর্ক নেই। সুদের হার বেশি থাকার সময় যে বিনিয়োগ পরিস্থিতি ছিল, এখন তো তা আরো কম।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, আইএমএফ থেকে ঋণ পাওয়া খুব সহজ নয়। ‘ইজ নট এ ম্যাটার অব জোক’। যদি দুই পক্ষের মধ্যে কোনো দ্বিমত থাকে সেক্ষেত্রে একবারে ঋণ পাব কিনা- সেটাও দেখার বিষয়। আমি নিজেও অনেক নেগোশিয়েট করেছি। আমি জানি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২-৩ বারও লাগে। আবার প্রস্তুতি ঠিক থাকলে, দুই পক্ষের মানসিকতা ঠিক থাকলে একবারেও হয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, ওয়াশিংটনে যদি ফলপ্রসূ আলোচনা হয়ে থাকে, সে অনুযায়ী এখন শর্ত দিলে, তা অযৌক্তিক হবে না। আর যদি ওয়াশিংটনে ফলপ্রসূ আলোচনা না হয়, তবে এখানে ভালোভাবে আলোচনা করতে হবে, তাদের বোঝাতে হবে। এজন্য সময় লাগতেই পারে। তিনি আরো বলেন, ব্যবসায়ী মহল ইতোমধ্যে শর্ত নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। তারা তো চাইবেই ব্যাংক ঋণের সুদহার কমানোর জন্য। কারণ একমাত্র তারাই এর সুবিধাভোগী। কিন্তু সরকারকে দেশ ও জাতির স্বার্থে কাজ করতে হবে।

সিপিডির সিনিয়র রিসোর্চ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আইএমএফ নতুন করে কিছু বলছে না। তারা যা বলছে সেগুলো আমরা কয়েক বছর ধরেই বলে আসছি। তিনি বলেন, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার চাপ সৃষ্টি হয়েছে অনেক আগে থেকে। তবে হ্যাঁ, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এর মাত্রা আরো উসকে দিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার চাপ সামলাতে এখন আইএমএফের দ্বারস্থ হতে হয়েছে ঠিকই; কিন্তু অনেক আগেই আর্থিক সংস্কার করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। এ কারণে এখন আইএমএফ ঋণের শর্ত হিসেবে আর্থিক সংস্কারের বিষয়টি এনেছে। যা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবে।

টিআইবি মহাপরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আইএমএফের ঋণ পেতে গেলে কিছু শর্ত দেবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গণমাধ্যমের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি কিছু কিছু শর্ত আছে, যেগুলো কৌশলগতভাবে যদি এড়িয়ে যেতে না পারে- তাহলে দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষ, যারা ইতোমধ্যে খারাপ অবস্থায় আছে- তাদের ওপর বোঝা আরো বাড়বে। তাই এসব শর্তাবলির কোনো কোনো বিষয় আমাদের কাছে বৈষম্যমূলক হতে পারে বলে মনে হয়েছে। তিনি বলেন, শর্তের পুরো প্যাকেজ এমনভাবে সাজানো উচিত যাতে ইতোমধ্যে অতিরিক্ত চাপে থাকা সাধারণ মানুষের ওপর বৈষম্যমূলক প্রভাব আরো বেড়ে না যায়। ড. ইফতেখারুজ্জামান আরো বলেন, দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে আইএমএফের যে নীতিমালা আছে, সেখানে দুর্নীতিবিরোধী, অর্থ পাচারবিরোধী বিষয়গুলোকে সংযুক্ত করার কথা। এ বিষয়গুলো নিয়ে এখনো কোনো ইঙ্গিত দেখতে পাইনি। এ বিষয়গুলো যদি শর্তে সংযুক্ত করা না হয় তবে অন্য শর্তগুলোর কোনোটারই প্রত্যাশিত লক্ষ্য পূরণ করা যাবে না। কারণ এ বিষয়গুলোই অর্থনীতির মূল চ্যালেঞ্জ।

তবে আইএমএফের শর্ত মানলে দেশের শিল্প খাতের অবস্থা আরো খারাপ হবে বলে মনে করেন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। নিজের অভিমত ব্যক্ত করে ব্যবসায়ী এ নেতা বলেন, আইএমএফ ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে শর্ত দেবেই। বৈদেশিক মুদ্রা ঘাটতি মেটাতে তাদের কাছ থেকে ঋণ নেয়াও প্রয়োজন। তার মানে এই নয়, সবকিছু জলাঞ্জলি দিতে হবে। বাংলাদেশের অবস্থা এতটা বেগতিক নয় যে তাদের সব শর্ত মেনে ঋণ নিতে হবে। জসিম উদ্দিন বলেন, দেশে বিনিয়োগ স¤প্রসারণ ও শিল্প সচল রাখতে ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ানো যাবে না। সুদহার ৯ শতাংশ তুলে দিলে শিল্প তার সক্ষমতা হারাবে। সুদহার না বাড়িয়ে ব্যাংকের সক্ষমতা বাড়ানোর পক্ষে জোরাল মত তুলে ধরেন তিনি।

বিশ্বব্যাংক ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করছে। এদিকে আগস্টে মূল্যস্ফীতি ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত আগস্টে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ঘর ছাড়িয়ে যায়। আগস্টে পয়েন্ট টু পয়েন্টভিত্তিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৫১ শতাংশ। এর আগে ২০১১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ২০ শতাংশ মূল্যস্ফীতির রেকর্ড ছিল। যদিও সেপ্টেম্বরে কিছুটা কমে ৯ দশমিক ১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদন থেকে সম্প্রতি এ তথ্য জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। মূল্যস্ফীতি মানুষের প্রকৃত আয় কমিয়ে দেয়। কমে যায় সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে শুধু প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নয়, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও অনেক চাপে আছেন। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন ও সীমিত আয়ের জনগোষ্ঠী এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের দুর্দশা বেড়েই চলেছে।

এদিকে ডলারের সংকট কাটাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে নতুন এলসি খোলার পরিমাণ কমছে। যদিও বাকি বা দেরিতে পরিশোধের শর্তে আগে খোলা এলসির দায় পরিশোধ বেড়েছে। যে কারণে বৈদেশিক মুদ্রার খরচ কমেনি। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে এলসি খোলা ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ কমলেও আমদানির দায় পরিশোধ বেড়েছে ১১ দশমিক ৭০ শতাংশ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App