×

মুক্তচিন্তা

কলকাতায় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসব ‘হাওয়া’য় উড়ে গেল

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২২, ১২:৩৮ এএম

সম্প্রতি কলকাতায় পাঁচ দিনব্যাপী বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হলো। বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এবং কলকাতার বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনের ব্যবস্থাপনায় রবীন্দ্র সদন চত্বরে বেশ জাঁকজমকের সঙ্গেই এই আয়োজন করা হয়। নন্দন ১, ২ ও ৩-এ দেখানো হলো মোট ৩৭টি ছবি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘হাসিনা : এ ডটার’স টেল’, ‘হাওয়া’, ‘পরাণ’, ‘গুণীন’, ‘চিরঞ্জীব মুজিব’, ‘কালবেলা’, ‘বিউটি সার্কাস’, ‘শাটল ট্রেন’ ও ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’। কিন্তু প্রচারের পুরো আলো টেনে নিয়ে গেল চঞ্চল চৌধুরী অভিনীত, মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত ‘হাওয়া’ ছবিটি। এই ছবি চলতি বছরের জুলাই মাসের শেষে মুক্তি পেয়েছিল বাংলাদেশে। ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল ছবির একটি গানও ‘সাদা সাদা কালা কালা…’। তারপরে কলকাতায় বিনা পয়সায় এই ছবি দেখার সুযোগ করে দিলেন আয়োজকরা। স্বাভাবিক নিয়মে হামলে পড়ল কলকাতা। নন্দন প্রেক্ষাগৃহে যে কোনো ছবি দর্শক পায়। কারণ কলকাতার রোজকার মিলনস্থল এই চত্বর। এর অবস্থান শহরের কেন্দ্রস্থলে। কিন্তু যেটা লক্ষণীয় তা হলো বাকি ৩৬টি ছবি নিয়ে কোনো মাধ্যমে কোনো আলোচনা নেই। কলকাতার মিডিয়া ভীষণভাবে প্রচার করল শুধু ‘হাওয়া’ ও চঞ্চল চৌধুরীকে নিয়ে। চঞ্চল চৌধুরী অত্যন্ত গুণী অভিনেতা। ভীষণ রকমের ভদ্র ও পাক্কা দেশপ্রেমিক। সর্বোপরি শক্ত মাটিতে পা রাখা শক্তিশালী মানুষ। কিন্তু ‘হাওয়া’কে ঝড়ে পরিণত করা মিডিয়ার সামনে তিনি বারেবারে উচ্চারণ করলেন তাদের টিম এফোর্টের কথা। সাকিব খানের প্রশংসা করলেন। নিজের দেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির এত গুণগান করলেন। কিন্তু কিসের কী? প্রচার এমনভাবে মিডিয়াতে হলো যেন ‘হাওয়া’র একক কৃতিত্ব চঞ্চল চৌধুরীর। মেজবাউর রহমান সুমনের প্রথম ছবি যে ‘হাওয়া’ দুই ঘণ্টা ১০ মিনিটজুড়ে পর্দায় মুগ্ধ হওয়ার মতো দৃৃশ্য ও ফ্রেম উপহার দিল তা অনেকটাই উহ্য থেকে গেল। বেশ কিছু জায়গায় ‘হাওয়া’ চমকে দিয়েছে, মুগ্ধ করেছে। টিম ওয়ার্ক হিসেবেও এই প্রয়াস প্রশংসার দাবি রাখে। কামরুল হাসান খসরুর ক্যামেরা কথা বলেছে। চঞ্চল চৌধুরী চানের চরিত্রে, ইবার চরিত্রে সরিফুল রাজ, গুলতির চরিত্রে নাজিফা তুশি লা জবাব। তা সত্ত্বেও কলকাতা শুধু স্বীকৃতি দিল চঞ্চলকে। বাকিদের নয়। তিতিবিরক্ত চঞ্চল হাসতে হাসতে এক ইন্টারভিউয়ে বলেই ফেললেন ‘নিন্দে আর প্রশংসা দুটোই অতিরিক্ত, বিশ্বাস করি না’। তবুও কলকাতার এই উন্মাদনা বাংলাদেশের ‘গেরিলা’ বাদে আর কোনো চলচ্চিত্র নিয়ে হয়েছে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই গেল, তা হলো প্রচারের আলোয় বাকি ছবিগুলো সেভাবে প্রতিফলিত হলো না কেন? পুরো চলচ্চিত্র উৎসবের আলো কেন পড়ল না বাকি ছবিগুলোর ওপরে? ‘হাসিনা : এ ডটার’স টেল’ পিপলু খানের ছবি। ২০১৮ সালের নভেম্বরে মুক্তি পাওয়া ছবি। সে বছরই শেখ হাসিনার জন্মদিনে দেশের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে ছবিটি প্রদর্শিত হয়েছিল। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে আরেকটা মূল্যবান মাইলফলক এই ছবিটি। মাত্র ৭০ মিনিটের ছবি। এই ছবিটা খুব দুঃখের ছবি নয়, রাজনীতির ছবি নয়, রক্তাক্ত ছবি নয়। এই ছবিটি মানবিকতার ছবি, সম্পর্কের ছবি, পারিবারিক বন্ধনের ছবি। শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা বলেছেন তাদের ৩২ নম্বর বাড়ির কথা। বড় মানুষদের নিয়ে, ক্ষমতাবানদের নিয়ে ছবি করা, গল্প লেখা, উপন্যাস লেখা, শিল্প করা কঠিন। আলোচনা-সমালোচনার বন্যা বয়ে যায়। কিন্তু এই ছবিতে পিপলু খানের পরিমিতিবোধ একে মহামূল্যবান দলিল এবং শিল্পকর্ম পর্যায়ে নিতে পেরেছেন। কিন্তু এহেন ছবির প্রচার একটুও চোখে পড়েনি। ‘চিরঞ্জীব মুজিব’ হলো ২০২১ সালের বাংলাদেশি বাংলা ভাষার জীবনীমূলক চলচ্চিত্র, যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সংলাপ লেখক নজরুল ইসলাম দ্বারা পরিচালিত। চলচ্চিত্রটিতে আহমেদ রুবেল বঙ্গবন্ধু চরিত্রে অভিনয় করেছেন, যিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও জাতির পিতা। চলচ্চিত্রটি বঙ্গবন্ধুর লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনীর একটি অংশের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে, যেখানে তাঁর জীবনের ১৯৪৯ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত বর্ণনা করা হয়েছে। শেখ মুজিব তো শুধু ওপার বাংলার নয়, এপার বাংলারও এক অনুভূতির নাম। শেখ মুজিব বাংলাদেশের জাতির পিতা, মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক। তাই তাঁকে নিয়ে জানার আগ্রহ এবং কৌতূহল মানুষের সব সময় আছে এবং থাকে। শেখ মুজিবের যে রাজনৈতিক জীবন, তা শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যেও তার শিকড় গভীরে। এবং তাঁর মাহাত্ম্য বিরাট। শেখ মুজিব এপার বাংলাকে এতটাই আলোড়িত করেছিলেন যে এই লেখকসহ আরো কয়েকজনের বিভিন্ন বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কলকাতা জীবন নিয়ে। কিন্তু প্রচারের আলো থেকে বঞ্চিত হয়েছে এই ছবিটিও। একই কথা বলা যায় ‘পরাণ’, ‘গুণীন’, ‘কালবেলা’, ‘বিউটি সার্কাস’, ‘শাটল ট্রেন’ ও ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ সম্পর্কে। কিন্তু কেন? এক কথায় বলা যায় এই চলচ্চিত্র উৎসবের সঠিক প্রচার পরিকল্পনায় তুমুল ঘাটতির কারণে। যে কোনো অনুষ্ঠান সফল করতে তার প্রিভিউ বা প্রাক-কথন প্রচার খুব জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসব নিয়ে এই প্রচারের দিকটা ছিল বড়ই দুর্বল। এখন মিডিয়া বিভক্ত বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে- প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও সোশ্যাল মিডিয়া। প্রথম দুটিতে প্রচারে খরচ ভালোই, কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া? সেখানে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের ব্যবহার করা হয়নি কেন? স্রেফ যোগাযোগের অভাবে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতির চিত্র, আপসহীন ধর্মনিরপেক্ষতা, বন্ধুত্বের মানসিকতার সব উপাদান নিয়ে আসা এতগুলো চলচ্চিত্র থাকা সত্ত্বেও সেভাবে প্রতিফলিত হয়নি। ২০১৩ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষিতে নাসির উদ্দীন ইউসুফের ছবি ‘গেরিলা’ কলকাতার চিত্রমোদিদের মধ্যে বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাসের প্রতিনিধিত্ব করেছিল এবং স্থায়ী ছাপ রেখে গিয়েছিল। তার মূল কারণ ছিল তৎকালীন আয়োজকদের প্রচার। এই সময়ে যে কোনো অনুষ্ঠানের পূর্বে ঢাক পেটানোর প্রয়োজন কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। সেই জন্য খুব দরকার সঠিক ঢাকি নির্বাচনের। ঠিক এই কারণেই কলকাতার বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসব এবারে ‘হাওয়া’য় উড়ে গেছে।

অমিত গোস্বামী : কবি ও লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App