×

মুক্তচিন্তা

নিয়ন্ত্রণহীন দ্রব্যমূল্যের দৌরাত্ম্য

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৭ নভেম্বর ২০২২, ১২:২৬ এএম

চাহিদা আর সরবরাহে সমন্বয় আর ক্রয়ক্ষমতার মেলবন্ধনে দ্রব্যমূল্য পায় মর্যাদা আর আবেগ। চাহিদাকে আমলে নিয়ে সরবরাহকে সবল রাখতে এবং ক্রয়ক্ষমতাকে সুষম পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারলে বাজার ব্যবস্থাপনায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে দ্রব্যমূল্য নীতি ও নিয়ন্ত্রণের আওতায় চলে আসে। চাহিদা, সরবরাহ আর ক্রয়ক্ষমতা নজরদারিতে থাকলে বা রাখতে পারলে দ্রব্যমূল্য মাত্রা স্থিতিশীল হতে পারে। বলাবাহুল্য বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নীতি-নিয়মের মধ্যে রাখা বা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে বা বিষয়ে কোনো কার্যকর পদ্ধতি বা ব্যবস্থা যে সফল অবস্থায় নেই। যদিও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার তথা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং এফবিসিসিআইসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বেশ কিছু উদ্যোগ কিংবা পদক্ষেপ প্রয়োজনীয় সময়ে গ্রহণ করার ঘোষণা মিডিয়ায় প্রকাশ পায়। সাম্প্রতিককালে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ভেজালের ভয় ব্যবসা-বাণিজ্য তথা জনস্বাস্থ্য ও সুস্থতাকেও রীতিমতো নানা চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। চাল, চিনি, ডিম, মাছ, মাংস, ভোজ্যতেল, সবজি এমনকি পেঁয়াজ, কাঁচামরিচের মতো নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দর বৃদ্ধি চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে না থাকায় কোনো কোনো ক্রেতা হয়তো এসব সামগ্রী ক্রয়ে হিমশিম খান। কিন্তু অস্বাভাবিক অর্থ উপার্জনকারীর কাছে অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি সত্ত্বেও এসব তোয়াক্কা না করে তারা যত দাম হোক তা ক্রয়ে সক্ষমতা রাখেন, পারেন বা বাহুল্য ব্যয়ে তারা ক্লান্ত বোধ করেন না। তাদের জন্য দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অনুপ্রাণিত হয়ে থাকে। ক্রেতা বা ভোক্তার চাহিদা পূরণে তাদের ক্রয়ক্ষমতার ক্ষেত্রে তাদের বৈষম্যমূলক আয় এবং অর্থনৈতিক অবস্থানগত কারণে ক্রয়ক্ষমতায় অসামঞ্জস্যতা দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির একটি শাস্ত্রগত কারণ। অবস্থা যদি এমন হতো, যে দাম বাড়ার কারণে সব ভোক্তা ওই সামগ্রী ক্রয়ে একসঙ্গে বিরত থাকতে পারেন, তাহলে সহসা সার্বিক চাহিদা কমে পচনশীল এসব সামগ্রীর দাম পড়ে যেত। কিন্তু তা তো হওয়ার নয়, কেননা সে ক্ষেত্রে উৎপাদন এবং এর বিপণন পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট সবাই ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে সরবরাহ চেইনে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। অর্থনীতি এভাবে চলতে পারে না। উঁচু দামে কেনার মানুষ আছে বলেই উঁচু দাম হাঁকা হয় আর এ পর্যায়ে স্থির কিংবা সীমিত আয়ের মানুষদের দ্রব্যমূল্যেও উল্লম্ফন নৃত্যে ত্রাহি মধুসূদন অবস্থায় পড়তে হয়। বোঝার বাকি থাকে না এমতাবস্থায় চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক ধর্মবিচ্যুত হয়ে হলাহলপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করে গোটা অর্থনীতির জন্যই। মানুষের মধ্যে অতিরিক্ত চাহিদা সৃষ্টি হয় বিশেষ বিশেষ সময়ের মানসিক প্রয়োজনে এবং সে প্রয়োজন মেটাতে অসমভাবে ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে। ক্রয়ের সক্ষমতা সব পর্যায়ে সমানভাবে বৃদ্ধি না পেলে মূল্যস্ফীতি লাগামহীন ও নিয়ন্ত্রণ অযোগ্য হয়ে পড়ে। পণ্যদ্রব্যে ভেজাল, মজুদদারি, মুনাফাখোরি এবং অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ধর্মমত নির্বিশেষে সবার অবস্থান স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন। এর বিপরীতে দেখা যায় দেশে এখন খাদ্যপণ্যসহ বিভিন্ন পণ্যে ভেজাল একটি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। খাদ্যপণ্যে ফরমালিনসহ ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার এমনই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে যে, বিষাক্ত রাসায়নিক নেই এমন খাদ্যদ্রব্য পাওয়া একেবারেই কঠিন। বিভিন্ন সময় ভেজালের বিরুদ্ধে জোরেশোরে অভিযান চললেও পরিস্থিতির আশাজাগানিয়া কোনো উন্নতি যে ঘটে না তা বলার অবকাশ নেই। কারণ ফরমালিন ব্যবহারকারীরা আপাতত পিছু হটলেও খাদ্যদ্রব্যে অন্যান্য বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার সমানে চালায়। পণ্যে ভেজাল দেয়া বা ফরমালিনসহ ক্ষতিকর রাসায়নিক মেশানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং অন্যায় জেনেও যে পরিবেশ ও আর্থ প্রশাসনিক ব্যবস্থায় এটা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে, সেখানে এসবের দায়ভার কেউ এড়াতে পারে না। এসব অন্যায় অনিয়মের উৎসমুখে যথাপ্রতিরোধে না গিয়ে অন্যায় অনিয়ম হওয়ার পর তা নিয়ন্ত্রণের মহড়া যুক্তিযুক্ত ও কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে প্রতিভাত হতে পারে না। যেমন দুর্নীতি দমনের কাজ দুর্নীতি হওয়ার পর শুরু করা মানে নিহত ব্যক্তির পোস্ট মর্টেম করা মাত্র। ক্ষতি যা হওয়ার তা হওয়ার পর দুঃখ ও বেদনার চৌহদ্দি নির্ণয়। নকল, ভেজাল এবং অহেতুক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা আত্মপ্রবঞ্চনামূলক ও আত্মঘাতী হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এসবের অবসানে সমস্যার মূল উৎস থেকে জবাবদিহিতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি উঠে আসে। সমস্যার গভীরে না গিয়ে প্রতিবিধানের বিষয়টি পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ অব্যাহত থাকলে অবস্থা দিন দিন খারাপই হতে বাধ্য। বাংলাদেশ শুধু শতকরা নব্বই ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত আবাসস্থল নয়, এ দেশের মানুষ ধর্মভীরু হিসেবেও পরিচিত। ধর্মীয় অনুশাসনে নকল ভেজাল এবং মজুতদারি মুনাফাখোরিকে চরমভাবে ধিক্কার দেয়া হলেও এসব দৈত্য পদ্মা মেঘনা যমুনা পাড়ের এই জাতিকে জিম্মি করে রেখেছে বছরের পর বছর ধরে। নকল, ভেজাল এবং মুনাফাখোরি সম্পর্কে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসনের বিষয়টি অনেকেরই অজানা আবার যাদের জানা তারা না জানার অভিনয় করেন। বিষয়গুলো সবার সজ্ঞান মানসিকতায় আনা দরকার। অধিক মুনাফা অর্জনের আকাক্সক্ষা, অপব্যয়, অপচয় আত্মসাতের প্রবণতা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সার্বিকভাবে সব পক্ষের মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। মানসিকতা পরিবর্তনে আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় সুশাসন পর্যবেক্ষণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ পদক্ষেপ ও ব্যবস্থা প্রয়োজন। এর পাশাপাশি এ বিষয়ে মসজিদের ইমাম, মন্দির, গির্জার পুরোহিতরাও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারেন। মসজিদের ইমাম, মন্দির, প্যাগোডা ও গির্জার পুরোহিতরা নকল, ভেজাল ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিরুদ্ধে বিশ্বাসী মানুষদের সচেতন করে তুললে সবার সজ্ঞান মানসিকতার উন্নতি হতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যারা এসব নিয়মকানুন প্রয়োগ ও প্রতিপালন পরিবীক্ষণের দায়িত্বে তাদেরও যথাদায়িত্ব পালনে সজাগ ও সক্রিয় হওয়া বা থাকাটা যথাযথ অর্থবহ হওয়ার আবশ্যকতা রয়েছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ ও দেখভালের দায়িত্ব পালনকারীরা নিজেরাই যেন ব্যবসার ব্যয় বাড়িয়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ হিসেবে না দাঁড়ান সে দিকে সমাজকে সতর্ক থাকা দরকার। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বাড়তি চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন মিল মালিকরা। ফলে বাজারে কিছুটা সংকট চলছে, যার প্রভাবে বাড়ছে দাম। পাশাপাশি কিছু মিল মালিক জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির অজুহাত দিচ্ছেন। আর আমদানিকারকরা বলছেন, গত বছর লোকসানের পর এবার আমদানি কম হওয়ায় সরবরাহ কমেছে বাজারে। পরস্পর প্রযুক্ত কারণ আর পরস্পরের দোষারোপের সংস্কৃতিতে একই সঙ্গে খোঁড়া যুক্তির বন্যায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের সব প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়ে দ্রব্যমূল্য বেড়েই চলেছে। এমনকি ফুটপাতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর ক্ষুদ্র কেনাবেচার ক্ষেত্রে যে চাঁদাবাজি তার পরিমাণ কয়েকশ কোটি টাকা। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে এসব ‘বিনিয়োগ ছাড়াই অর্থ উপার্জন’ জাতীয় কর্মকাণ্ড প্রভাবক ভূমিকা রাখছে। নিজ দেশের উৎপাদন সক্ষমতাকে ও ব্যবস্থাকে পর্যুদস্ত করতে দেশের সর্বত্রই বিদেশে উৎপাদিত পোশাকের ব্যাপক চাহিদা বৃদ্ধির আয়োজন চলে আত্ম-উন্নয়নবিমুখ এই দেশে। অভিযোগ উঠছে সীমান্তের শুল্ক দপ্তরের মাধ্যমে যে মূল্যে এসব পোশাকের চালান খালাস হয় তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি মূল্যে ঢাকাসহ সর্বত্র এসব বিক্রি হয়। এভাবে নামমাত্র মূল্য ঘোষণা দিয়ে একদিকে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়, অপরদিকে হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হয় বৈদেশিক মুদ্রা। আর ধর্মীয় উৎসবে বাজারের চাহিদা মেটাতে অসাধু আমদানিকারকদের বড় সিন্ডিকেট কাজ করে প্রতি বছর। তারা শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করে। সীমান্তের বিভিন্ন দপ্তর ও বাহিনীর কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে নামমাত্র মূল্য ঘোষণা দিয়ে অবাধে পণ্য খালাস হয়ে চলে আসে। স্থলবন্দরগুলো দিয়ে অবাধে আসে বিদেশি পণ্যের চালান। সরকারকে এসব বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা উপলক্ষ করে বাজার ব্যবস্থাপনাসহ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মধারায় যেসব বশংবদ সমস্যা সবার দৃষ্টিসীমায় আসে সেগুলো সুরাহা কিংবা প্রতিরোধ ও প্রতিবিধানের ব্যাপারে উপযুক্ত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ আবশ্যক অনস্বীকার্য হয়ে উঠছে।

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : কলাম লেখক ও উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App