×

জাতীয়

ঝুলে গেল সমন্বিত তিস্তা প্রকল্প

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ নভেম্বর ২০২২, ১২:৩৩ পিএম

ঝুলে গেল সমন্বিত তিস্তা প্রকল্প

ফাইল ছবি

ভূরাজনৈতিক চাপের কারণে এই প্রকল্প এগিয়ে নিতে আগ্রহ হারিয়েছে সরকার, এখনো হাল ছাড়েনি চীন

ঝুলে গেছে তিস্তা নদী সমন্বিত ব্যবস্থাপনা প্রকল্প (তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প)। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দ্রুতগতিতে চীনকে দায়িত্ব দিতে একটি নথি তৈরি করে সিদ্ধান্ত নিতে চেয়েছিল সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ঘুরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে আটকে আছে নথিটি। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ভূরাজনৈতিক চাপে এই প্রকল্পে এগিয়ে নিতে আগ্রহ হারিয়েছে সরকার। তবে এখনো হাল ছাড়েনি চীন। ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেছেন, সরকার এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চাইলে তার দেশ সব ধরনের সহায়তা দিতে প্রস্তত।

পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত এ প্রসঙ্গে ভোরের কাগজকে বলেন, তিস্তা প্রকল্পে কী হচ্ছে আমরা কেউই কিছু জানতে পারছি না। তবে বাংলাদেশ এই প্রকল্প নিয়ে কী করতে যাচ্ছে তার কারিগরি ও পরিবেশগত দিক না জানা পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা উচিত হবে না। পাশাপাশি এখানে তৃতীয় দেশ ‘ভারত’ জড়িত। কাজেই প্রকল্পটি নিয়ে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিষয় রয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে এসব সমস্যারও সমাধান করার পরামর্শ দেন তিনি।

সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করে বলেছেন, একটি অবাস্তব বিষয় নিয়ে সরকারের একটি মহল তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প তৈরি করে চীনকে দিয়ে বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল। এতে তিস্তা নদীর গর্ভাংশ কমে গিয়ে জমি জেগে উঠবে। এই জমি থেকে স্থানীয়রা সুবিধা পাবে। নদী প্রকৌশলে এ ধরনের প্রকল্প ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে। তবু তিস্তায় সাময়িক লাভের কথা চিন্তা করে পানিসম্পদ সচিব, পানিসম্পদ উপমন্ত্রী ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নথিতে সই করে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে পাঠিয়েছিলেন। এরপর গত ১১ অক্টোবর ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং লালমনিরহাট ও রংপুরে তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন। মূলত রাষ্ট্রদূতের ওই সফরের পরই এ নিয়ে ঢাকা, বেইজিং ও নয়াদিল্লিতে প্রকল্পটি নিয়ে আলোচনা নতুন মাত্রা পায়। এরপরই প্রতিবেশী ভারত এ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে। ভারতের কাছ থেকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়ে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পুরো বিষয়টি আটকে রেখেছে।

জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, পুরো বিষয়টি নিয়ে কী হচ্ছে তা আমি জানি না। হয়তো ইআরডি (অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ) বলতে পারবে। ইআরডি সচিব শরীফা খান ভোরের কাগজকে বলেন, গত এক সপ্তাহের সৌদি আরব সফর শেষে গতকাল শনিবার দেশে ফিরলাম। কাজেই এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। বিদেশ সফরে যাওয়ার আগে তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের গতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এরকম কোনো নথি আমার চোখে পড়েনি। আপনি বরং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিন। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক ভোরের কাগজকে বলেন, নথিটি ইআরডির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিলে চীন তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পে কাজ করবে। প্রকল্পের অনুমোদন হয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত কোনো আপডেট নেই। তবে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মিজানুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, না না, তিস্তা নিয়ে এরকম কোনো প্রকল্প এখন আর নেই। আগে ছিল কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, না, এ নিয়ে আর কথা বলা উচিত হবে না।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই প্রকল্পে কী হচ্ছে তা কেউ জানতে পারছেন না। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মঈনুল হোসেন এবং রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ এই প্রকল্প নিয়ে ইতিবাচক প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলেছেন, যারা এখন এই প্রকল্পের পক্ষে কথা বলছেন, তারাই প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার ৫ বছর পর এর বিপক্ষে কথা বলতে বাধ্য হবেন। বিরোধিতার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পটি চীন শ্রমিকনির্ভর প্রকল্প হিসেবে সাজিয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের পর তিস্তার গর্ভাংশ কমে যাবে। বেশি পরিমাণে জমি জেগে উঠবে। নদীর সীমানা কমে গেলে পরিবেশের বিপর্যয় হবে। সব মিলিয়ে নদী প্রকৌশল বিদ্যা না জেনেই প্রকল্পটি প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে ওই অঞ্চলের ক্ষতি হবে। পাশাপাশি চীনের এই প্রকল্প শ্রমিকনির্ভর হওয়ায় এই কাজের জন্য শ্রমিক, প্রকৌশলীসহ আড়াই থেকে তিন হাজার চীনা নাগরিক ওখানে নিয়োজিত হবেন। তারা ওখানে একবার নিয়োজিত হলে পুরো অঞ্চল ঘুরে বেড়াবেন। যেখানে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে তার থেকে মাত্র ১১ কিলোমিটার দূরে ভারত সীমান্ত। ওই সীমান্ত এলাকাকে ভারত ‘চিকেন’স নেক’ নামে অভিহিত করে। চীন কোনোভাবে ওই প্রকল্পে কাজ পেলে চিকেন’স নেকের নিরাপত্তা বিঘিœত হবে বলে মনে করে ভারত। এর ফলে দেশটি আপত্তির কথা জানিয়েছে বাংলাদেশকে। এছাড়া ভারতের আপত্তিকে আগ্রাহ্য করে বাংলাদেশ প্রকল্পটির কাজ চালিয়ে নিতে চাইলেও পারবে না। কারণ বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কাজটি করতে চাইলে ভারতের আপত্তিতে ঋণও পাবে না বাংলাদেশ। ঋণ না পেলে কাজও করতে পারবে না। আবার চীনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েও যদি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চায় সরকারÑ সেক্ষেত্রেও ভারতের কাছে এর ব্যাখ্যা দিতে হতে পারে। সব মিলিয়ে ভারতকে চটিয়ে এই প্রকল্প কখনোই করা উচিত হবে না বলে বিশ্লেষকদের অভিমত।

চিকেন’স নেকের ব্যাখ্যা দিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলেন, শিলিগুড়ি করিডোর ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে দেশের অবশিষ্ট অংশের সংযোগরক্ষাকারী একটি সংকীর্ণ ভূখণ্ড।

পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত এই ভূখণ্ডের আকৃতি মুরগির ঘাড়ের মতো বলে একে চিকেন’স নেক নামেও অভিহিত করা হয়। পূর্বে নেপাল, পশ্চিমে বাংলাদেশ। মাঝখানে খুব সঙ্কীর্ণ একটি অংশ ভারতের নিয়ন্ত্রণে। এই অঞ্চল ভারতের হাতছাড়া হলে উত্তর-পূর্ব ভারত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। উত্তরবঙ্গের তিনটি জেলারও একই হাল হবে। যে উত্তর-পূর্ব ভারত নিয়ে চীনের সঙ্গে বিস্তর টানাপড়েন, চিকেন’স নেককে নিজেদের কব্জায় নিয়ে সেই উত্তর-পূর্বকেই বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারলে চীনের পক্ষে লক্ষ্যে পৌঁছনো খুব সহজ। এ কারণেই চীন ভারতের চিকেন’স নেক থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্পে কাজ পেতে আগ্রহী।

গত শনিবার স্থানীয় একটি হোটেলে বাংলাদেশ-চায়না সিল্ক ফোরাম আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেন, এটি একটি প্রকল্প যেটি চীন অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে। এটি বাস্তবায়নে হয়তো চীন বাধা নয়। যদি বাংলাদেশ সরকার সত্যিকারভাবে এটি করতে চায়, তবে চীন এটি বাস্তবায়ন করবে। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের ওপর কিছু বহিঃচাপ আছে। আমি সঠিকভাবে জানি না কোথা থেকে চাপ আছে এবং কেন। বাংলাদেশ ভাটির দেশ জানিয়ে তিনি বলেন, প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি অনুযায়ী সীমান্তের কাছে কোনো ধরনের বাঁধ নির্মাণ করা হবে না এবং বিপরীত স্রোতের কারণে উজানের দেশের জন্য এটি ক্ষতিকর নয়। তিনি বলেন, আমাকে কয়েকজন বলেছে এই প্রকল্পের বিষয়ে যেন আমি সাবধানে থাকি। কারণ এর স্পর্শকাতরতা আছে। বিশেষ করে ভূরাজনৈতিক। অর্থ বা প্রযুক্তি নয়, বরং বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ় সংকল্প এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় জিনিস বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিস্তা নদীর উৎসে বাঁধ দিয়ে পানি সরবরাহ বাধাগ্রস্ত করছে চীন, এমন তথ্যের বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করা হলে চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, তিস্তার উৎস সিকিমে (ভারতের একটি রাজ্য), চীনে নয়। এটি সম্পূর্ণ বানোয়াট তথ্য।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App