×

মুক্তচিন্তা

জনস্বাস্থ্য রক্ষায় সরকার, বিরোধিতায় কোম্পানি

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২২, ০১:৩৬ এএম

জনস্বাস্থ্য রক্ষায় সরকার, বিরোধিতায় কোম্পানি
পৃথিবীব্যাপী ধূমপান ও তামাকজনিত কারণে যত মানুষ মারা যায়, এককভাবে তা এইচআইভি, মাদকদ্রব্য গ্রহণ, ভেজাল ওষুধ সেবন, অগ্নিকাণ্ড, সড়ক দুর্ঘটনা এবং অন্যান্য দুর্ঘটনার সম্মিলিত মৃত্যুর চেয়ে অনেকগুণ বেশি! বিগত সময়ে আমেরিকার যুদ্ধে সমগ্র প্রাণহানির চেয়ে তামাকের কারণে মৃত্যু ১০ গুণ বেশি। তাছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে করোনার কারণে যত মৃত্যু হয়েছে তার চেয়ে প্রতি বছর বেশি মৃত্যু হয় তামাকের কারণে (বছরে ৮৭ লক্ষাধিক)। তথ্যগুলো উপস্থাপনের উদ্দেশ্য হলো- ‘তামাক’ মানবজাতির জন্য কতটা ভয়াবহ অভিশাপ, সেটা বোঝানোর জন্য। তামাক পুরো পৃথিবীর জন্য হুমকিস্বরূপ। তামাক নির্মূলে জাতিসংঘের উদ্যোগে বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র ঐক্যবদ্ধ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বৈশ্বিক উদ্যোগে পরিচালিত হচ্ছে জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন ও তামাকবিরোধী কর্মকাণ্ড। ‘তামাক’ যেহেতু বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের জন্য বোঝাস্বরূপ এবং সার্বিক উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা, সেহেতু এটি নির্মূলে অনেক কাজ করার আছে। বিষয়টির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেই আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার ঘোষণা প্রদান করেছেন। তাছাড়া দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ও সহায়ক নীতি প্রণয়নসহ ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর। বিশেষত তামাকজনিত রোগ, মৃত্যু এবং ক্ষয়-ক্ষতি কমাতে সর্বাত্মকভাবে কাজ করছে সরকার। কিন্তু অতীতের মতোই এই শুভ উদ্যোগের ঘোরতর বিরোধিতা করছে তামাক কোম্পানিগুলো। কারণ একটাই। তামাক কোম্পানির স্বার্থে আঘাত লেগেছে। সরকারের জনস্বার্থে গৃহীত পদক্ষেপের বিপরীতে তামাক কোম্পানির উদ্দেশ্য হচ্ছে তরুণদের আকৃষ্ট করা আর মানুষকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়ে অধিক মুনাফা লাভ করা। মানুষের জীবন, স্বাস্থ্য, পরিবেশ-প্রকৃতি তামাক কোম্পানির মুখ্য বিষয় নয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮(১) অনুচ্ছেদে জনস্বাস্থ্যের উন্নতি রাষ্ট্রের প্রাথমিক দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। দেশে বিদ্যমান ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়াধীন জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের উদ্যোগে ২০১৩ সালের পরে আবারো সংশোধন করা হচ্ছে। উদ্যোগটি অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং প্রশংসনীয়। এবারের খসড়া সংশোধনীতে উল্লেখযোগ্য প্রস্তাবনা হচ্ছে- আইনে উল্লেখিত পাবলিক প্লেস, পরিবহনের আওতা বৃদ্ধি ও সব তামাকজাত দ্রব্য সেবন নিষিদ্ধ, আইন অমান্যে জরিমানা বৃদ্ধি এবং এসব স্থানে আলাদাভাবে ‘ধূমপানের স্থান’ না রাখা। ২. তামাক কোম্পানির ‘সিএসআর’ কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা। ৩. বিক্রয়স্থলে সব ধরনের তামাকজাত দ্রব্য দৃষ্টির আড়ালে রাখা। ৪. খোলা ও খুচরা এবং ভ্রাম্যমাণ তামাক বিক্রয় নিষিদ্ধ করা। ৫. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের দোকান না রাখা। ৬. তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ে লাইসেন্স গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা। ৭. তামাক পণ্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী ৯০ শতাংশ করা। ৮. ই-সিগারেট বা ভেপিংয়ের আমদানি, উৎপাদন, বিক্রয়, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উল্লেখযোগ্য। আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনের পক্ষে ১৬ হাজার এবং বিপক্ষে এক হাজার ১০০ মতামত এসেছে। সম্প্রতি, গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, আইন সংশোধনের বিপক্ষে আসা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, মালিক সমিতি ও ব্যক্তির নামে প্রেরিত চিঠির বেশিরভাগই ভুয়া এবং নামসর্বস্ব। অনেকের নাম, সংগঠনের প্যাড অনুমতি ছাড়াই জালিয়াতি করে ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে, যা গণমাধ্যমেও দেখানো হয়েছে। আইন সংশোধন বিষয়ে নানা মহল থেকেই বিভিন্ন অভিমত আসছে। তবে তামাক কোম্পানির ‘পেইড এজেন্ট’ এবং দোসররা আইন সংশোধনী বিলম্ব করতে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। সরকার তামাক নিয়ন্ত্রণে কোনো পদক্ষেপ নিলেই তামাক কোম্পানিগুলো খোঁড়া যুক্তি দিয়ে নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে প্রভাবিত করে। প্রকৃতপক্ষে, তামাক কোম্পানি সরকারকে যে রাজস্ব জমা দেয় তার ৯৫ শতাংশের বেশি ভোক্তার দেয়া ভ্যাট ও অন্যান্য শুল্ক। করোনার পরে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা এবং তামাক কোম্পানির কর ফাঁকি রোধে তামাকজাত দ্রব্যে সুনির্দিষ্ট কর আরোপের প্রস্তাবনা দেয়া হয় তামাকবিরোধী ও জনস্বাস্থ্যবিদদের তরফ থেকে। কিন্তু বাস্তবায়ন কিংবা আমলে নেয়া হচ্ছে না। শুধু মূল্য বাড়িয়ে কোম্পানির পকেট ভারি করা হচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী পাস হলে কর্মসংস্থান হারাবেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। যে পরিমাণ মানুষ কর্মসংস্থান হারাবে বলে প্রচারণা করা হয় সেটাও সত্য নয় বলে উঠে এসেছে। এগুলো সবই করুণা আদায়ের উপায়। এদেশে অনেক শ্রেণি-পেশার মানুষ আছে। কোনো মানুষ চায় না তার সন্তান ধূমপায়ী বা মাদকাসক্ত হোক। গবেষণা বলছে, দেশে ৯৫ শতাংশ মাদকাসক্ত ধূমপায়ী। অর্থাৎ সিগারেট দিয়েই মাদকে আসক্ত হয় তারা। সিগারেট হাতের নাগালে দিয়ে একজন শিশু-কিশোর, তরুণকে নেশার জগতে ঠেলে দিয়ে প্রকারান্তরে তামাক কোম্পানিকেই উৎসাহিত করছে কিছু মানুষ। তাদের উচিত বিকল্প পেশায় নিযুক্ত হওয়া। পৃথিবীতে বাংলাদেশ অন্যতম সস্তা তামাকজাত দ্রব্যের বাজার। দেশে তামাকজাত দ্রব্য সস্তা এবং সহজলভ্য, তাই এর ভোক্তাও বেশি। বাংলাদেশে সব তামাকজাত দ্রব্য খুচরা ক্রয়-বিক্রয় হয় বিধায়, স্বল্প আয়ের মানুষসহ ছাত্রছাত্রীরা তাদের টিফিনের টাকায় তামাকজাত দ্রব্য কিনতে পারে। এ ছাড়া জর্দা, গুল ও সাদাপাতা খোলা ও খুচরা বিক্রয়ের ফলে সরকার প্রচুর রাজস্ব হারাচ্ছে। খুচরা সিগারেট বিক্রির সুবিধার কারণে সিগারেট কোম্পানিগুলো এবং বিক্রেতারা প্যাকেটের গায়ের মূল্যের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করে থাকে। আইন সংশোধনীতে খুচরা ও ভ্রাম্যমাণ তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ের যে প্রস্তাবনা এসেছে তা সময়োপযোগী। অনেক ক্ষেত্রে প্রচার করা হচ্ছে বিড়ি-সিগারেট সেবন গরিব ও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য বিনোদন। প্রকৃতপক্ষে তামাক তাদের জন্য মৃত্যুফাঁদ। তামাক কোম্পানি এ ধরনের ‘মিথ’ প্রচার করে আসছে, যাতে নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয়। খুচরা বিক্রি বন্ধ হলে দরিদ্র ও কিশোর-যুবকদের মধ্যে তামাক ক্রয় কমবে। ফলে তাদের ধূমপান ও মাদক থেকে বিরত রাখা সম্ভব হবে। তামাকসেবীদের অনেকে নিরুৎসাহিত হবে। তামাকবিরোধী সচেতনতায় ব্যবহৃত সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর কার্যকারিতা বৃদ্ধি পাবে, একই সঙ্গে তামাকের চোরাচালান বন্ধ হবে। তামাক ব্যবহারের ফলে দেহে ২৫টি রোগ হয়। সহজভাবে বলতে গেলে- মাথার চুল থেকে শুরু করে পায়ের নখ পর্যন্ত প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই তামাকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া যারা ধূমপান করেন না, পরোক্ষ ধূমপানের কারণেও সেই মানুষগুলোও ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। মহিলাদের মধ্যে ধোঁয়াবিহীন তামাকের (জর্দা, গুল, সাদাপাদা) ব্যবহার বেশি থাকায় মুখের ক্যান্সার, গলায় ক্যান্সার ইত্যাদি অনেকগুণ বৃদ্ধি পায়। প্রতি ১০ জন ফুসফুস ক্যান্সার এবং সিওপিডিতে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে যথাক্রমে ৯ জন ও আটজনই আক্রান্ত হয় ধূমপানের কারণে। পৃথিবীতে যে ১০টি দেশের মধ্যে তামাক বেশি ব্যবহার করে তার মধ্যে বাংলাদেশ ৮ম অবস্থানে রয়েছে। প্রতি বছর তামাকের কারণে ১২ লাখ মানুষ বিভিন্ন জটিল ও কঠিন রোগে অসুস্থ হয়। ৪ লাখ মানুষ পঙ্গু হয় এবং ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এই বিষাক্ত পদার্থ আমরা কেন গ্রহণ করব, কেন আমরা পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করব? সুতরাং আসুন, আমরা সবাই মিলে সরকারপ্রধানের তামাকমুক্ত বাংলাদেশ ঘোষণার বাস্তবায়ন করি। তামাকের ব্যবহার ও আগ্রাসন রোধ করি। সচেতন হই, সুস্থ জীবন, সুস্থ পৃথিবী গড়ে তুলি। অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী : কলাম লেখক, চিকিৎসক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা; প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মানস। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App