×

মুক্তচিন্তা

অর্জিত সব উন্নয়নে মানুষকেও সংবেদনশীল হতে হবে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২২, ০১:৩৬ এএম

সাধারণ মানুষ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ক্রমাগত ঘূর্ণাবর্তে অতিষ্ঠ প্রায়! সচেতন সবাই জানেন এ সংকট কেবল বাংলাদেশেরই নয়- বৈশ্বিক। কিন্তু সাধারণ মানুষ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ঊর্ধ্বগতির পশ্চাতে বৈশ্বিক সংকটকে মানতে চায় না। মানতে না চাওয়ার পেছনেও এক অদৃশ্য শক্তির প্রচ্ছন্ন উসকানি রয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো সম্পর্ক নেই- এ জাতীয় ভাষণেও সাধারণ মানুষকে বোঝানোর জন্য সেই অদৃশ্য শক্তির উসকানি প্রবল। আর করোনায় ক্ষতির প্রসঙ্গ ভুলিয়ে দিতেও একই অদৃশ্য শক্তি আমাদের সামনে নানা রকমের রসদ সাজিয়ে লোভনীয় উসকানি দিচ্ছে! সরকারের ব্যর্থতা বলেই তারা উসকানি দিচ্ছে। ফলে সাধারণের মন থেকে দ্রুতই যেন মুছে গেছে পদ্মা সেতুর মতো বড় অর্জনও! রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কিংবা রাজধানীর চারপাশজুড়ে বিস্তৃত হতে থাকা মেট্রোরেলের সাফল্যকেও তারা না দেখারই ভান করছে! একটি অদৃশ্য শক্তির প্রচ্ছন্ন উসকানি আজ আওয়ামী লীগের সব অর্জন ও সাফল্যকে ¤øান করে দিচ্ছে। আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারক মহল সেদিকে কতটুকু সচেতন জানি না। কেবল আন্দোলন জমিয়ে তোলায় বিএনপির ব্যর্থতা নিয়ে আওয়ামী লীগের শব্দবোমার বিস্ফোরণ ঘটালে চলবে না। মনে রাখতে হবে উন্নয়ন ও অগ্রগতির বিপরীত অবস্থানেও কিছু মানুষ আছে। মনে রাখতে হবে এই মানুষগুলো অহর্নিশ সরকার তথা আওয়ামী লীগের পতনেই বেশি মনোযোগী। দেশ-বিদেশ থেকে নানা ধরনের কৌশলী পন্থায় এরা সক্রিয়। আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী মহল নিশ্চয়ই এ বিষয়েও ব্রহ্মাস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত আছে! আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থেকে শুরু করে নিচের দিকের সর্বকনিষ্ঠ কর্মীর সবাই তাদের বিভিন্ন বক্তব্যে রাজপথে নামার বিএনপির সাহসের তির্যক সমালোচনা করছেন, দীর্ঘদিন আমরা এ কথা শুনছি। বিএনপির নেতাকর্মী বিশেষত ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে উদ্দেশ্য করেই তাদের এরূপ বক্তব্য। আওয়ামী লীগের প্রায় সর্বস্তরের নেতাকর্মীর প্রশ্নমূলক শব্দগুচ্ছে ছিল ‘কোন রমজানের পর? কোন ঈদের পর? কোন শীতে বিএনপি আন্দোলন জমাতে রাজপথে নামবে?’ বিগত কয়েক বছরে বিএনপির আন্দোলনের অভিলাষ আর তাদের অভিলাষকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সারির নেতাদের ব্যবহৃত এরূপ শব্দবোমা শেষ পর্যন্ত বুমেরাং হচ্ছে কি না তা দলটির সাম্প্রতিক সভা-সমাবেশগুলো দেখে আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারক মহলের ভাবনার অবকাশ তৈরি করছে বলে মনে হচ্ছে। এও মনে হচ্ছে যে, বিএনপির সভা-সমাবেশ বা আন্দোলন জমানোর সামর্থ্যকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের চেয়ে নিজেদের প্রতিই আওয়ামী লীগের মনোযোগ প্রয়োজন। বিএনপিকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের পরিবর্তে আওয়ামী লীগের উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন নতুন নতুন শব্দগুচ্ছের সন্ধান করতে হবে। বিগত ১৪ বছর দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষাসহ আওয়ামী লীগ উন্নয়নের যে মাইলফলক অর্জন করেছে তা সংবেদনশীলতার সঙ্গে জনমনে প্রতিস্থাপন করতে হবে। আওয়ামী লীগের যুগান্তকারী উন্নয়ন ও অর্জন সাধারণের মনকে কেন তেমনভাবে স্পর্শ করছে না তাও ভাবতে হবে। সরকারকেও মনে রাখতে হবে সাধারণ মানুষ তাদের জীবনযাত্রায় ও জীবনসংগ্রামে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব অনুভব করতে চায় না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সাম্প্রতিক পরিস্থিতি যে বৈশ্বিক শৃঙ্খলার (কার্যত বিশৃঙ্খলা!) আবর্তে ঘূর্ণায়মান সাধারণ মানুষ তাও অনুভব করতে চায় না- উপলব্ধিও করতে চায় না! সাধারণ মানুষ সহজ-সরল জীবনযাপন করতে চায়। সরকারকে মনে রাখতে হবে সাধারণ মানুষ সব দৈব-দুর্বিপাক ভুলে যায়, তারা কিন্তু করোনার অতিমারির দুর্দশাও ভুলতে বসেছে! বিএনপি দেশের যেসব সংকটের কথা বলে প্রকৃতপক্ষে তা দেশের নয় রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদেরই সংকট। কার্যত দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থেকে বিএনপি একপ্রকার উন্মাদ হয়ে পড়েছে। বামপন্থিদের অনেকেও আওয়ামী লীগের সাফল্যকে মেনে নিতে পারছে না। পাশাপাশি ধর্মীয় উগ্রবাদী কয়েকটি দলও চরম আওয়ামীবিদ্বেষী। ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত কিছুসংখ্যক আলেম-ওলেমা আইনের আশ্রয়ে রয়েছেন বলে তাদের অনুসারী আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তারা আইনি প্রক্রিয়াকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে সাধারণকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে চাপ দিচ্ছে, যা ধর্মীয় আবেগজনিত স্পর্শকাতরও বটে। শাস্তি পাওয়া যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের সদস্যদের মানসিকতা স্বাভাবিকভাবেই সরকারের প্রতি চরম বৈরী-ভাবাপন্ন। আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে তারাও আজ অত্যধিক সক্রিয়! বলার অপেক্ষা রাখে না বর্ণিত গোষ্ঠীগুলোর সব পক্ষই নানাভাবে বিএনপির আন্দোলনের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ- একাট্টা হতে শুরু করেছে! তারই প্রভাব দেখা গেছে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত সমাবেশে- সেখানে দেশবাসীকে যুদ্ধাপরাধীর উত্তরসূরির আস্ফালনও দেখতে হয়েছে! আরো কিছু ব্যক্তি রয়েছেন যারা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে হাওয়া ভবন থেকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে এরা নানা অপকর্মে যুক্ত হয়ে দেশে না ফিরে বিদেশ থেকে অনলাইনে সীমাহীন ‘হলুদ’ সাংবাদিকতা করে যাচ্ছেন! এই সংখ্যাটিও নেহাত কম নয়। তারা নিয়মিতভাবে সরকারের সব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করছেন এবং নানা রঙে তা প্রচার করছেন। মোবাইল চালু করলেই যেহেতু এসব কনটেন্ট সাধারণের সহজ নাগালের মধ্যে পৌঁছে যায়, তাই বারবার মিথ্যা প্রপাগান্ডাও সাধারণ মানুষ দুর্বল মুহূর্তে সত্যি বলে মেনে নেয়। প্রাযুক্তিক কৌশলের মারপ্যাঁচে তৈরি কনটেন্ট সাধারণ মানুষ কেন অনেক সময় জ্ঞানী লোকের পক্ষেও বুঝে ওঠা কষ্টকর। সাম্প্রতিককালের ‘আয়নাঘর’খ্যাত ভুয়া তথ্যচিত্র এরই এক বিশেষ নমুনা! কিন্তু সাধারণ মানুষের বুঝতে হবে সেখানে চলে অঢেল টাকার খেলা! টাকার খেলা চলে বলেই আল-জাজিরার মতো গণমাধ্যমকেও নানাভাবে প্রভাব খাটিয়ে সরকারবিরোধী প্রচারণায় যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা যখন উন্নত বিশ্বের বহুসংখ্যক রাষ্ট্রকে কাবু করে ফেলছে তখনো বাংলাদেশের এক শ্রেণির মানুষ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য সরকারের ওপরই এককভাবে দায় চাপিয়ে সাধারণের মনে অসন্তোষ সৃষ্টিতে মগ্ন রয়েছে। এ কথা সত্যি বাংলাদেশে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের অনৈতিক সিন্ডিকেটের জন্য হরহামেশাই কোনো কোনো নিত্যপণ্য সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। নিকট সাম্প্রতিককালে আমরা বিভিন্ন নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রে এমনটি দেখেছি। বিশেষ করে ডিম নিয়ে যে কাণ্ড হয়ে গেছে সেটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়! বর্তমানে চিনি নিয়ে চলছে সেই ডিম-কাণ্ডেরই অনুরূপ ঘটনা! সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার দাবি এবং তারা যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই বলছে দেশে প্রচুর চিনির মজুত রয়েছে। তবু এক শ্রেণির ব্যবসায়ীর তৈরি কৃত্রিম সংকটে বাজার থেকে চিনি একেবারে হাওয়া হয়ে গেছে! মাঝেমধ্যেই আমরা বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী নিয়ে এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই। চাল, ডাল, আটা, পেঁয়াজ, রসুনের মতো নিত্যপণ্যের পাশাপাশি মাছ মাংস তরিতরকারি ও সবজির ক্ষেত্রেও আমরা উচ্চ মূল্যজনিত আতঙ্কে ভুগি। ভোজ্য তেল নিয়ে আবারো বাজার অস্থির হতে চলেছে বলে গণমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে। মনে রাখতে হবে, এরূপ আতঙ্ক কেবল বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেই নয়- বরং বিশ্বব্যাপী। আমাদের অনেকেরই বহু আত্মীয়স্বজন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাস করছেন। প্রবাসী নিকটাত্মীয়দের মাধ্যমে খোঁজ নিলেও জানা যাবে যে, সেসব দেশেও নিত্যপণ্যের মূল্য আর আগের মতো নেই! সে মধ্যপ্রাচ্য কিংবা ইউরোপ বা আমেরিকা যে কোনো দেশই হোক না কেন! এ সবই বৈশ্বিক টানাপড়েনের প্রভাব। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের উন্মাদনা সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী আরো বিস্তৃত হতে চলেছে। অনেক দেশের আন্তঃসম্পর্কেও শুরু হয়ে গেছে মেরুকরণের নয়া প্রচেষ্টা। কিন্তু আমাদের দেশে আওয়ামীবিরোধী এক জাতীয় বুদ্ধিজীবীও এরূপ বক্তব্য প্রচার করেন, ‘সরকার রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কথা বলে! ভাবখানা এমন যে, বাংলাদেশের টাকায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ করছে!’ প্রথিতযশা কোনো বুদ্ধিজীবীর এমন বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে সরকারের প্রতি সাধারণের মনেও এক ধরনের সন্দেহ তৈরি হয়। কিন্তু বিশ্বের কোনো সংকটই আজ আর কোনো একক দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বিশেষ করে যুদ্ধের মতো কোনো সংকট তৈরি হলে তা বিশ্বকে প্রভাবিত করবেই- ইতোমধ্যে আমরা তার ইঙ্গিতও দেখতে পাচ্ছি। ভাবা দরকার যে, আমাদের চাহিদার প্রায় ৪০ ভাগ গম যখন রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আমদানি করতে হয় তখন দেশ দুটির মধ্যে বিদ্যমান সংকট আমাদের প্রভাবিত করবে না তা নিতান্তই আওয়ামীবিদ্বেষী না হলে কোনো বুদ্ধিজীবীর মুখে এরূপ তথ্য-তত্ত্ব প্রকাশ পেত না। আমরা দেখতে পাচ্ছি ব্রিটেনের জ্বালানি ও গ্যাস সংকট একবারে নাকের ডগায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ডিজেল সংকট দেখা দিয়েছে। ইউরোপের অনেক দেশে এখন দৈনিক পরিসংখ্যান বেরুচ্ছে কাদের কী পরিমাণ জ্বালানি মজুদ আছে, কত দিনের গ্যাসের মজুত আছে, তাদের রিজার্ভের পরিমাণই বা কী ইত্যাদি! এমন হিসাব আমরা দেখেছিলাম শ্রীলঙ্কার দেউলিয়া হওয়ার প্রাক্কালে! হয়তো ইউরোপের কোনো দেশ দেউলিয়া হবে না কিন্তু সাম্প্রতিক সংকট মোকাবিলায় তারা যে ত্রাহি অবস্থা পার করছে তা গণমাধ্যমে চোখ রাখলেই উপলব্ধি সম্ভব। কিন্তু আমরা এটাও লক্ষ করছি যে, এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ এ সমস্যাকেও ‘রাজনৈতিকভাবে’ ব্যবহারে প্রবৃত্ত হয়েছেন। তারা বলতে চাইছেন আওয়ামী লীগ সংকটের ‘জুজুর ভয়’ দেখাচ্ছে! বিশ্বের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদরা যখন আগামী বছরকে মন্দাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় শঙ্কিত বোধ করছেন তখন আমাদের দেশের এক শ্রেণির নেতা ও বুদ্ধিজীবীর মধ্যে বিরাজ করছে নিদারুণ হঠকারিতা। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে! আমরা বিশ্বাস করি, জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রাজ্ঞ ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্বগুণে চলমান সব সংকট মোকাবিলা করে বাংলাদেশ তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে। সরকারের অর্জিত অভাবিত উন্নয়নের স্পর্শ সাধারণের নিত্যদিনের সংকট মোকাবিলায় আরো সহায় হোক। অর্জিত সব উন্নয়নে সাধারণ মানুষেরও সংবেদনশীল মননের স্বাক্ষর থাকতে হবে। আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App