×

মুক্তচিন্তা

জিন্নাহর দুর্ভাগ্য : নিজেই ষড়যন্ত্রের শিকার

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২২, ১২:৩৫ এএম

জুলাই (১৯৪৮) মাসের শেষ দিকে কোনোরকম সংবাদ না দিয়ে (পাকিস্তানের) প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান জিয়ারত এসে হাজির হলেন, আর সঙ্গে ছিলেন চৌধুরী মোহাম্মদ আলী। (জিয়ারত বেলুচিস্তানের একটি ছোট শহর, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ অসুস্থাবস্থায় এখানে ছিলেন, সঙ্গে ছিলেন বোন ফাতিমা জিন্নাহ। কিন্তু অসুস্থতার দিনগুলো তিনি কেন জিয়ারত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তা অজ্ঞাত) তারা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর স্বাস্থ্যগত অবস্থা এবং কী রোগ শনাক্ত হয়েছে তা জিন্নাহর চিকিৎসক আর্মি মেডিকেল কোরের ডাক্তার কর্নেল ইলাহি বক্সের কাছে জানতে চাইলেন। ডাক্তার বললেন, কায়েদকে পরীক্ষার জন্য ফাতিমা জিন্নাহ তাকে ডেকে এনেছেন, কাজেই রোগী সম্পর্কে যদি কিছু বলার থাকে তাকেই বলবেন। লিয়াকত আলী খান বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমি তো জানার জন্য উদ্বিগ্ন।’ ডাক্তার বিনীতভাবে বললেন, ‘জি স্যার, কিন্তু আমি রোগীর অনুমতি ছাড়া কিছু বলতে পারব না।’ ফাতিমা জিন্নাহর ভাষ্য : আমি কায়েদের পাশে বসেছিলাম, যখন আমাকে বলা হলো প্রধানমন্ত্রী ও সেক্রেটারি জেনারেল তার সঙ্গে দেখা করতে চান, আমি কায়েদকে বললাম। তিনি হাসলেন, ‘ফাতি, তোমার কি ধারণা আছে তারা কেন এসেছেন?’ আমি বললাম, ‘সে কারণ আমি কেমন করে অনুমান করব।’ তিনি বললেন, ‘তিনি আমার অসুখ কতটা মারাত্মক তা জানতে চাইছেন। তার মানে আমি আর কতদিন টিকে থাকব, তাই।’ কয়েক মিনিট পর তিনি বললেন, ‘নিচে যাও, প্রধানমন্ত্রীকে বলে এসো আমি তার সঙ্গে দেখা করব।’ দুজন এক সঙ্গে আধঘণ্টার মতো ছিলেন। লিয়াকত আলী খান নেমে আসার পরপরই আমি ওপর তলায় আমার ভাইয়ের কাছে গেলাম। আমি দেখলাম তিনি অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন, দেখলেই অসুস্থ মনে হচ্ছে। তাকে একটু ফলের জুস দিতে বললেন। তার পর আমাকে বললেন, ‘এবার মোহাম্মদ আলীকে পাঠাও।’ কেবিনেটের সেক্রেটারি জেনারেল চৌধুরী মোহাম্মদ আলী তার সঙ্গে ১৫ মিনিট কাটিয়ে যখন নামলেন, তিনি আবার একা, আমি তার রুমে গেলাম। তিনি জুস কিংবা কফি খাবেন কি না জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু অন্য কোনো কিছু তার মনকে এতটাই আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে, তিনি আমার কথার জবাবই দিতে পারলেন না। ততক্ষণে ডিনারের সময় হয়ে গেছে। তিনি বললেন, ‘তুমি বরং নিচে যাও এবং তাদের সঙ্গে ডিনার করো।’ আমি জোর দিয়ে বললাম না, আমি আপনার সঙ্গে উপরেই খাব, আমি খাবার উপরে আনিয়ে নিচ্ছি।’ তিনি আমায় বললেন, ‘না, এটা ঠিক হবে না। তারা এখানে আমাদের অতিথি। যাও তাদের সঙ্গে খাবারে যোগ দাও।’ আমি নিচে নেমে দেখলাম প্রধানমন্ত্রী ডিনার টেবিলে বেশ খুশি মনে কৌতুক করছেন, হাসছেন। আমি আমার ভাইয়ের স্বাস্থ্য নিয়ে দুশ্চিন্তায় কাঁপছি, তিনি শয্যায় একা পড়ে আছেন। চৌধুরী মোহাম্মদ আলী নিশ্চুপ থেকে কিছু ভাবছিলেন। ডিনার শেষ হওয়ার আগেই উপরে আমার ভাইয়ের রুমে ছুটে এলাম। তার রুমে ঢুকতেই তিনি হাসলেন, বললেন, ‘ফাতি তোমাকে সাহসী হতে হবে। আমার চোখ ভাসিয়ে যে অশ্রæ নেমে আসছিল আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করে তা লুকোলাম।’ কয়েক দিন পর অর্থমন্ত্রী গোলাম মোহাম্মদ এলেন কায়েদে আজমকে দেখতে। আমি একাই তার সঙ্গে লাঞ্চে বসেছিলাম, তিনি বললেন, ‘মিস জিন্নাহ আপনাকে আমার কিছু কথা বলতেই হবে। কায়েদে আজমের স্বাধীনতা দিবসের বার্তাটিকে উপেক্ষা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বার্তা পোস্টারে ছাপা হয়েছে এবং শহরজুড়ে ভবনের দেয়ালে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। বড় শহরগুলোর ওপর উড়োজাহাজ থেকে প্রধানমন্ত্রীর মুদ্রিত বার্তা নিক্ষেপ করা হয়েছে।’ আমি নিঃশব্দে শুনে গেলাম। এসব নিয়ে বিচলিত হওয়ার কী দরকার। আমার কাছে একমাত্র বিষয় হচ্ছে আমার ভাইয়ের স্বাস্থ্য তার প্রচারণা নয়। এই কথাগুলো তার বই মাই ব্রাদার-এর পাণ্ডুলিপিতে ছিল, কিন্তু বই প্রকাশ হওয়ার পর এই অংশসহ আরো কিছু সংবেদনশীল পৃষ্ঠা বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে- পাকিস্তানের সংহতির স্বার্থে। তবে তখনকার ডাকসাইটে আমলা ও লেখক কুদরতুল্লাহ শাহাব তার ১২ শতাধিক পৃষ্ঠার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ শাহাবনামাতে পাণ্ডুলিপির এ অংশটুকু যোগ করে দিয়েছেন। এই কাহিনী বয়ান করেছেন জিন্নাহর ছোট বোন ফাতি। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর (১৮৭৬-১৯৪৮) দুই ভাই বন্দে আলী এবং এক ভাই আহমদ আলী এবং তিন বোন মরিয়ম, ফাতিমা ও আমিনার বড় ভাই। ফাতিমার সঙ্গে জিন্নাহর বয়সের ব্যবধান ১৭ বছর। তিনি তার সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। জিন্নাহর স্ত্রীর অকাল মৃত্যুর পর চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্রী এবং অখণ্ড ভারতবর্ষের প্রথম নারী ডেন্টিস্ট ফাতিমা জিন্নাহ (১৮৯৩-১৯৬৭) ভাইয়ের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে এবং পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে এই রাষ্ট্রের সাফল্য ও ট্র্যাজেডির নিকটতম প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে ওঠেন। রাজনৈতিক উচ্চাশা তার ছিল না, প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের একনায়কত্বের অবসান ঘটাতে ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ফাতিমা জিন্নাহর চেয়ে বড় কোনো ব্যক্তিত্বের খোঁজ পাকিস্তানে মেলেনি। ফাতিমা জিন্নাহর জনপ্রিয়তা পূর্ব পাকিস্তানেই বেশি এবং পূর্বাঞ্চলে অপজিশন পার্টিতে অন্যতম প্রধান সংগঠক শেখ মুজিবুর রহমান আছেন তারই সঙ্গে। এটি তার প্রধান শক্তি। লিয়াকত আলী খান প্রসঙ্গে ফাতিমা জিন্নাহর বিবরণটি জিন্নাহকে নিয়ে লেখা ‘মাই ব্রাদার’-এ থাকার কথা ছিল। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে শেখ মুজিবুর রহমান যেভাবে লিয়াকত আলী খানকে তুলে ধরেছেন তার অংশবিশেষ উদ্ধৃত করছি : নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান লীগ সভায় ঘোষণা করলেন, ‘যে আওয়ামী লীগ করে গা, উসকো শের হাম কুচাল দেগা’। তিনি যদিও বলতেন, গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন কিন্তু কোনো বিরোধী দল সৃষ্টি হোক তা তিনি চাইতেন না। তার সরকারের নীতির কোনো সমালোচনা কেউ করুক তাও তিনি পছন্দ করতেন না। নিজের দলের মধ্যে কেউ বিরুদ্ধাচরণ করলে তাকেও বিপদে ফেলতে চেষ্টা করতেন। যেমন নবাব মামদোত। পশ্চিম পাঞ্জাব সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মামদোত। জিন্নাহর বিশ্বস্ত একজন ভক্ত ছিলেন। জিন্নাহর হুকুমে নবাবি ছেড়ে দিয়ে তিনি বিরাট সম্পত্তি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।… তিনি জনগণের প্রধানমন্ত্রী হতে চাননি, একটা দলের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছেন। রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দল যে এক হতে পারে না এ কথাও তিনি ভুলে গিয়েছিলেন।’ তিনি আরো লিখেছেন ‘১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে মওলানা ভাসানী ও আমি যখন জেলে সেই সময় লিয়াকত আলী খানকে রাওয়ালপিন্ডিতে এক জনসভায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। …লিয়াকত আলী খান যে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু করেছিলেন সেই ষড়যন্ত্র তাকে মরতে হলো। কে বা কারা লিয়াকত আলী খানকে হত্যা করার পেছনে ছিল আজ পর্যন্ত তা উদ্ঘাটন করা হয়নি। আর হবেও না। এই ষড়যন্ত্রকারীরা যে শক্তিশালী ছিল তা বোঝা যায়। কারণ তারা কোনো চিহ্ন পর্যন্ত রাখে নাই।… গুলির সঙ্গে সঙ্গে আততায়ীকে গুলি করে হত্যা করার কারণ কী?’ একজন টাইপিস্ট আর টাইপরাইটারের সহায়তায় যিনি পাকিস্তান অর্জন করেছেন বলে মনে করতেন সেই জিন্নাহও তাত্ত্বিক গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে বাস্তবে হয়ে উঠেছিলেন স্বৈরাচারী। এ নিয়ে তালুকদার মনিরুজ্জামান ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ’-এ বিস্তারিত লিখেছেন। ল্যারি কলিনস ও ডমিনিক ল্যাপিয়ের ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট গ্রন্থি জিন্নাহর ঘাতক ব্যাধি য²া প্রসঙ্গটি এসেছে এবং ১৯৪৬-এর জুনে ডাক্তার জেএল প্যাটেলের পরীক্ষা করা জিন্নাহর রিপোর্ট তার দুই ফুসফুসের ভয়ংকর খারাপ অবস্থার আশঙ্কা করা হয়েছিল এবং এক্সরে প্লেট তার হেফাজতে সিলগালা অবস্থায় ছিল। মাউন্টব্যাটেন আফসোস করেছেন যে জিন্নাহর শারীরিক অবস্থা যে এতটাই সংকটাকীর্ণ তিনি মোটেও জানতেন না। যদিও তার পূর্বসূরি ওয়াভেল এবং আরো কারো কারো জানা ছিল বলে তিনি পরবর্তী সময়ে জেনেছেন। ভারত বিভাজনের এত স্বল্প সময়ের মধ্যে তার মৃত্যু ঘটবে এটা জানা থাকলে মাউন্টব্যাটেন মনে করেন তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর ও স্বাধীনতা প্রদানের বিষয়টি পিছিয়ে দিতেন। জিন্নাহর অসুস্থতা সম্পর্কে অবহিত তার পুরো পরিকল্পনা পাল্টে দিত বলে তিনি মনে করেন। কংগ্রেসের একমাত্র শত্রæ ছিল জিন্নাহ মুসলিম লীগের বাকি সবাই কেবল আর ছায়া মাত্র। জিন্নাহর মৃত্যুতে কংগ্রেস স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলত, স্বস্তিকর হতো মাউন্টব্যাটেনের জন্যও। তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে একমাত্র বাধা ছিলেন জিন্নাহ। মাউন্টব্যাটেন ল্যারি কলিংস ও ডোমেনিক ল্যাপিয়েরকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ভারতের একটি আহাম্মক সরকারের লাগাম ছিল তার হাতে, এই সরকারে ছয় জন কংগ্রেসের ছয় জন মুসলিম লীগের বাইরে থেকে তিনজন যে কোনো প্রস্তাবে ভোটের ফলাফল ৯-৬; কংগ্রেসের পক্ষেই। কিন্তু এটা নিশ্চিত মুসলিম লীগ মানবে না। ভারত শাসন আইনের ৯৩ ধারায় পুরো ভারতবর্ষ আমার ব্যক্তিগত শাসনের অধীনে’ নিয়ে যেতে পারতাম। ‘দেশ শাসনের এ কী অদ্ভুত পন্থা।’ বল্লভ ভাই প্যাটেল কি ভারত ভাঙতে তাকে প্ররোচিত করেছেন? ‘না এটা প্যাটেল নয়, আমিই এক সঙ্গে ভারতকে ধরে রাখতে পারছিলাম না।’ জিন্নাহর সঙ্গে মাউন্টব্যাটেনের সম্পর্ক শুরু থেকেই খারাপ, জিন্নাহই তার অস্বস্তির কারণ। সুতরাং ‘জিন্নাহর ব্যাপারে আমার কোনো সহানুভূতি নেই।’ (মাউন্টব্যাটেন এন্ড দ্য পার্টিশন অব ইন্ডিয়া) নিজের অসুস্থতার কথা কি জিন্নাহ জানতেন না? ডাক্তার কর্নেল এলাহী বক্স যেদিন জিন্নাহকে বললেন, তিনি য²ায় ভুগছেন, তিনি মোটেও বিস্মিত হননি বরং তিনি বলেছেন, এ কথা তিনি ১২ বছর আগে থেকেই জানেন। জেনে গেলে ভারতের হিন্দুরা তার মৃত্যুর কাউন্টডাউন শুরু করে দেবে সে জন্যই কথাটা আড়াল করে রেখেছেন। বাস্তবতা আরো নির্মম। জিন্নাহর হাতে গড়া পাকিস্তানি মুসলমান নেতারাই প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের নেতৃত্বে সেই কাউন্টডাউন শুরু করেছিলেন। তা জিন্নাহর মৃত্যু ও তাদের উচ্চাশা পূরণের কাউন্টডাউন। জিন্নাহর স্বপ্ন পূরণ হয়নি এমনকি ভাষা প্রশ্নেও। জিন্নাহর ঢাকা ডিক্লারেশন (রাষ্ট্রভাষা একমাত্র উর্দু) বাস্তবায়নের জন্য লাহোর হাইকোর্টের ২০১০ সালের মামলা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। এমনিতেই ১৯৪৭-এ তিনি পেয়েছেন মথ-ইটেন পাকিস্তান, ১৯৭১ সেখান থেকে ছুটে গেছে বৃহদাংশ জনগণ। যে উর্দুর স্বপ্নবিভোর তিনি ছিলেন, তা চালু করতেও এখন মামলা মোকদ্দমার আশ্রয় নিতে হচ্ছে।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App