×

মুক্তচিন্তা

পুঁজিবাদকে পরাভূত করা চাই

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২২, ১২:৩৬ এএম

পুঁজিবাদকে পরাভূত করা চাই

তা গাছ বলি আর নদীই বলি উভয়েই খুব বিপদে আছে। কাঠুরেরা এখন অনেক বেশি তৎপর বৃক্ষনিধনে। দখলদাররা সারাক্ষণ ব্যস্ত নদী দখলে ও দূষণে। প্রকৃতি নিজেই তো বিপন্ন। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীরা গবেষণার বড় বড় দায়িত্বের ভেতরে থেকে মাঝে মধ্যে আমাদের জানাচ্ছেন যে সৌরজাগতিক এমন একটা বিস্ফোরণ ঘটতে পারে যাতে শুধু পৃথিবী নয় পরিচিত মহাবিশ্বই ধ্বংস হয়ে যাবে। ভাবলে হাত-পা শীতল হয়ে আসে, কিন্তু তবু একেবারে যে শীতল হয় না তার কারণ ঠিক আগামীকালই যে ঘটনাটা ঘটতে যাচ্ছে এমন নয়। কিন্তু যা প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে টের পাওয়া যাচ্ছে সেটা হলো পৃথিবীটা ক্রমেই মনুষ্য বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। প্রকৃতি ইতোমধ্যেই অত্যন্ত বিরূপ হয়ে পড়েছে। ঝড় ও জলোচ্ছ¡াসের মাত্রা বেড়েছে। আগের তুলনায় ঘন ঘন হচ্ছে। বাংলাদেশে আমরা শরৎকালকে এখন পাচ্ছি বর্ষা ও গ্রীষ্ম হিসেবে। গ্রাস করে ফেলবে। সমুদ্রের পানি উঁচু হয়ে উঠছে, নিচু এলাকা বিলীন হয়ে যাবে। প্রকৃতি ক্ষেপে গেছে। এমনি এমনি ক্ষেপেনি। তাকে উত্ত্যক্ত করা হয়েছে। সে এখন প্রতিশোধ নেবে। কারা উত্ত্যক্ত করল? উত্ত্যক্ত করল, পুঁজিপতিরা। সৌরজাগতিক মহাপ্রলয়ের আগে মনে হয় ধরিত্রীই ধ্বংস হয়ে যাবে। ওই পুঁজিপতিদের কারণে। মানুষের হয়ে যন্ত্র এখন অনেক কাজ করে দেয়। যুদ্ধ করে, উৎপাদন করে, নির্মাণ করে, জটিল সমস্যার সমাধানও করে ফেলে অতিদ্রুত। একদিনে ঘটেনি এই ঘটনা। ঘটতে ঘটতে এখন চরম উৎকর্ষের স্তরে পৌঁছে গেছে। শ্রমের প্রয়োজন ক্রমেই কমে আসছে, হাতের কাজ হাতিয়ার করে দিচ্ছে। ১২০ জনের কাজ এখন ১২ জনে করতে পারে। এতে উৎফুল্ল হবার কারণ আছে। কিন্তু কার? মালিকের নাকি শ্রমিকের? মালিক খুশি শ্রমিক নিয়ে ঝামেলা কমছে দেখে। ট্রেড ইউনিয়নের শক্তি নেই, ধর্মঘট নেই, দরকষাকষির দরকার পড়ে না। কিন্তু শ্রমিকের লাভটা কোথায়? যে শ্রমিকরা বেকার হয়ে গেছে তারা কি করবে? তাদের ওপর যে-মানুষদের নির্ভরশীলতা তারা কোথায় যাবে? শ্রমিকরা জিনিসপত্র কেনে, তাতে উৎপাদন বাড়ে, দোকানপাটের সুবিধা হয়, কর্মসংস্থান ওভাবেও বৃদ্ধি পায়। শ্রমিকরা যদি বেকার হয়ে যায় তাহলে ওইসব ক্ষেত্রে যে ক্ষতি হবে তার পূরণের উপায়টা কী? কী করবে? কী করে খাবে? মালিকের উপকারে যে শ্রমিকের সর্বনাশ এই তো চিরকালের নিয়ম। তাহলে? কার দৃষ্টিতে দেখব আমরা উন্নতিকে? পাঁচজন বিলাসী মালিকের নাকি ৯৫ জন মানুষের, যারা মেহনত করে জীবন চালায় তাদের? গণতন্ত্রের জয়ধ্বনির তো বিরাম নেই, কিন্তু পুঁজিবাদী গণতন্ত্রীরা জগৎকে দেখে পাঁচজনের দৃষ্টিতে, ৯৫ জনের নয়। বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলে এখন একদিকে চরম বিপদ অন্যদিকে শনৈঃশনৈঃ উন্নতি। বন্যায় মানুষের সর্বনাশ হয়েছে। ওদিকে রাস্তাঘাট হচ্ছে, ট্যুরিস্টরা আসবে, ক্যান্টনমেন্ট বসছে, মেট্রোরেল দেখা দেবে। উন্নতি নয়তো কি? উন্নতির ফলে জমির দাম বাড়ছে। তাতে জমির বড় বড় মালিকেরা খুশিতে হাসবে এতে অস্বাভাবিকতা নেই। কিন্তু যাদের সামান্য কিছু জমি আছে, সেটা বিক্রি হয়ে গেলে যারা ভূমিহীন ক্ষেত মজুর হয়ে যাবে তাদের অবস্থাটা কী দাঁড়াবে ভাবা মুশকিল, তারাও খুশি। কেন? কেননা শুনেছে দাম বাড়বে? এমনকি যাদের জমিজমা বলতে কিছু নেই, তারাও খুশি। দাম বাড়ছে তো। যেন জমির সঙ্গে তাদেরও দাম বাড়বে। বোঝাবার কেউ নেই যে এ উন্নতি তাদের জন্য সর্বনাশের সূত্রপাত। উন্নতির বাজনা কেবল কানে নয়, বুকে নয়। মস্তিষ্কের ভেতরেও পৌঁছে গেছে। উন্নতির-প্রেম বড় সামান্য প্রেম নয়। ছাড়া পাওয়া ভারি মুশকিল। উন্নতির মহাপ্রেমে পেয়েছে মিয়ানমারের সরকারকে। দীর্ঘকাল সেখানে হৃদয়হীন সামরিক শাসন চলছিল, ওই সরকার উন্নতি ছাড়া অন্যকিছু বুঝত না। উন্নতির অর্থটা ছিল পরিষ্কার। পাঁচজনের উন্নতি, ৯৫ জনকে ডুবিয়ে দিয়ে। বলাবাহুল্য ওই পাঁচজনের বড় অংশ ছিল সামরিক বাহিনীর সদস্য। অবশ্যই তারা গণতন্ত্রী ছিল না। সে-সময়ে গণতন্ত্রের জন্য যারা সংগ্রাম করেছেন তারা অকল্পনীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সমস্ত দেশটাই ছিল ভয়াবহ এক কারাগারে, এর ভেতরে আবার ছোট কারাগারে জীবন কাটাতে হয়েছে অনেক গণতন্ত্রসংগ্রামীকে। প্রাণ দিয়েছে বহু মানুষ। পাশ্চাত্য বিশ্ব মিয়ানমারে গণতন্ত্র দাও, দিতে হবে বলে আওয়াজ দিয়েছে, নানাবিধ স্বরে ও সুরে। এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক যত যত রকম সম্ভব চাপ দিয়েছে। চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে শোনাও গেছে। কিন্তু তারপর আবার ফিরে এসেছে সামরিক শাসন। মিয়ানমারের একাংশে রোহিঙ্গারা বসবাস করে। আজ থেকে নয়, যুগ যুগ ধরে। বংশপরম্পরায়। কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাপক হারে শুরু হয়ে গেছে রোহিঙ্গানিধন। এই নিধন সামরিক শাসনেও চলছিল। কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকার এসে তার মাত্রা দিল চড়িয়ে। এবার নিধন নয়, শুরু হয়েছে প্রকাশ্য গণহত্যা। ঘটে চলেছে আধুনিক বিশ্বের নৃশংসতম ঘটনার একটি। রোহিঙ্গারা গণহত্যার শিকার হচ্ছে তারা মুসলমান হওয়ার অপরাধে নয়, তাদের ভেতর অমুসলিমও আছে। তাদের অপরাধ তারা দুর্বল ও স্বতন্ত্র একটি জাতি সত্তা। বার্মিজরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এবং ভীষণভাবে জাতীয়তাবাদী। বলা বাহুল্য এ জাতীয়তাবাদ পুঁজিবাদী; মুনাফা বোঝে, মনুষ্যত্ব বোঝে না, মুনাফার জন্য মানুষ মারতে কুণ্ঠিত হয় না। রোহিঙ্গাদের কোনো নাগরিক অধিকার নেই। চাকরি পায় না, সুযোগ পায় না উচ্চশিক্ষার, চলাফেরার অধিকারও সীমিত। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক- সবদিক দিয়েই তারা বঞ্চিত। আওয়াজ দেবে এমন সুযোগ নেই; আওয়াজ দিলেও শোনার লোক নেই। তাই তারা সমূলে উৎপাটিত হচ্ছে। মারা যাচ্ছে। বিতাড়িত হচ্ছে। গণহত্যার উদ্যোগ ও উদ্দেশ্য সফল হবে বলেই ধারণা করা যাচ্ছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা বলতে কেউ থাকবে না। রোহিঙ্গাদের বসবাসের পরিবেশে গাছ ছিল, পাশে নদী ছিল। কেউই তাদের আশ্রয় দিতে পারেনি, গাছও নয় নদীও নয়। বনের ভেতর দিয়ে, পাহাড়পর্বত ডিঙিয়ে, নদী সাঁতরে তারা সবকিছু ফেলে শুধু প্রাণটাকে সঙ্গে নিয়ে হাজারে হাজারে নয় লাখে লাখে সীমান্ত ডিঙিয়ে আশ্রয়প্রার্থী হয়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ তাদের নিতে চায়নি। শরণার্থী বলে অনুপ্রবেশকারী বলেছে প্রথমে, পরে ছাড় দিয়ে বলেছে আশ্রয়প্রার্থী। বাংলাদেশ বলছে জায়গা কোথায়, সামর্থ্যই বা কতটুকু। রোহিঙ্গাদের জায়গা-জমি, ঘরবাড়ি, ব্যবসা-বাণিজ্য সামান্য যা ছিল বার্মিজরা তা দখল করবে, সেখানে শিল্পকারখানা বসাবে, বিদেশিরা বিনিয়োগ করবে, লাফঝাঁপ দিয়ে মিয়ানমারের উন্নতি হতে থাকবে। আর কী চাই? পুঁজিবাদী লালসার এমন নজির সাম্প্রতিক ইতিহাসে বিরল। রোহিঙ্গারা তাদের মাতৃভূমিতে ফেরত যেতে পারবে এমন ভরসা কম; তাদের উপমা বৃক্ষও নয়, নদী তো নয়ই; যেসব উপমা মনে আসে তাদের কোনটাই মানুষ্যত্বের জন্য নিতান্ত অসম্মানজনক। গণহত্যার তৎপরতার সময়ে মিয়ানমার সরকার সবচেয়ে কুৎসিত যে অস্ত্রটি ব্যবহার করছে সেটি হলো গণধর্ষণ। গণহত্যাতে গণধর্ষণ থাকবে এটা স্বাভাবিক। প্রতিপক্ষ দুর্বল, তাদের মেয়েরা আরো দুর্বল, সর্বোপরি মেয়েরা বিনামূল্যে-প্রাপ্য ভোগের সামগ্রী। মেয়েরা বাঁচে কি করে? তারা ধর্ষিত হচ্ছে। একাত্তরে আমাদের মেয়েরাও হয়েছে। কিন্তু মিয়ানমারে যেভাবে ও যেহারে গণধর্ষণ চলেছে গণহত্যার ইতিহাসে তা অতুলনীয়। পুরুষদের হত্যা করা হচ্ছে; যারা পারছে পালিয়ে বনে জঙ্গলে লুকিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে, মেয়েরা ধর্ষিত হচ্ছে এবং তারপর হচ্ছে বিতাড়িত। নিহতও হয়েছে অনেকে। শরণার্থীদের মিছিলে তাই নারী ও শিশুতে ভরপুরে। তথ্য পাবার উপায় নেই। সাংবাদিকদের প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। ত্রাণকর্মীরাও নিষিদ্ধ। বিদেশি পর্যবেক্ষকরা যে ঢুকবেন তেমন উপায় নেই। ওদিকে মিয়ানমানে নিযুক্ত জাতিসংঘের প্রধান কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে যে তিনি তার সংস্থার কর্মীদের ত্রাণ, সংবাদ সংগ্রহ, বহির্বিশ্বকে জানানো তো নিষেধ করে দিয়েছেনই, এমনকি মিয়ানমান সরকারকেও কাছে তথ্য দেয়া যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। টাকার বশ সবাই হয়, জাতিসংঘের বড় বড় প্রতিনিধিরাও। পুঁজিবাদের নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতা ভয়ংকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার হাতে পড়ে মানুষ বিপন্ন, প্রকৃতি উত্ত্যক্ত। মানুষ এখন আর বৃক্ষের মতো থাকছে না। তার স্বাতন্ত্র্য, তার ভূমিতে প্রোথিত থাকা, তার আকাশমুখী হওয়া নির্মমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নদীর মতো সে যে স্বচ্ছ ও প্রবহমান থাকবে সেও সম্ভব নয়। বৃক্ষ এবং নদী উভয়েই আতঙ্কের ভেতর রয়েছে। বৃক্ষের ধ্বংসকার্য চলছে, নদী দূষিত হচ্ছে। আলো-বাতাস এখন আর বৃক্ষের জন্য মিত্র নয়, চতুষ্পার্শের সম্পদ ইতোমধ্যেই নদীর জন্য শত্রæতে পরিণত হয়েছে। পুঁজিবাদকে তাই রুখতে হবে। ধাওয়া করে তাকে কাবু করা যাবে না, ওষুধে সে বশ মানবে না। ধরা পড়বার ভয়ে সে আতঙ্কিত হবে না। তার লজ্জা নেই, তার জন্য কোনো আইনকানুন নেই, নিজেই সে আইনকানুন। তাকে পরাভূত করতে হবে সমবেত চেষ্টায়। এর জন্য উৎপাদনকে আনা চাই সামাজিক মালিকানার অধীনে; মুনাফার লোলুপতা দূর করে রক্ষা করা চাই মানুষের মনুষ্যত্বকে। পুঁজিবাদকে জব্দ করার কাজটা সম্ভব সামাজিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। দেশে দেশে এবং সারা বিশ্বে। নইলে কেউ বাঁচবে না- বৃক্ষ নয়, নদী নয়, মানুষও নয়।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App