×

মুক্তচিন্তা

শোক হোক শক্তি ও উজ্জ্বল উদ্ধার

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২২, ০১:০৭ এএম

আজকাল মানুষ রাজনীতির কথা শুনতে চায় না। হাতে গোনা কয়েকজনকে বাদ দিলে রাজনৈতিক নেতাদের কথাও কেউ বিশ্বাস করে না। বলতে গেলে সমাজ বিশেষত তারুণ্য এখন রাজনীতি বিমুখ। এই যে বিমুখতা এর কারণ আমাদের অজানা নয়। অন্যদেশ বা পরিবর্তিত বিশ্বের দোহাই দিলেও আমাদের দেশে আজ যে নেতৃত্বের সংকট তার মূল জায়গাটি ৩ নভেম্বর ১৯৭৫। সে দিন ভোর রাতে আমাদের দেশকে নেতৃত্বশূন্য করার শেষ আঘাত হানা হয়েছিল। পৃথিবীর কোনো দেশে কোনো সভ্যতার ইতিহাসে যা নেই তাই ঘটেছিল সে রাতে। কারাগার বন্দিদের নিরাপদ আশ্রয়। এমনকি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকেও আইন বা বিচার ছাড়া কেউ স্পর্শ করতে পারে না সেখানে। অথচ সে কালরাতে আমাদের দেশের চার সূর্য সন্তানকে হত্যা করা হয়েছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। আমি তখন ১৬ বছরের তরুণ। স্পষ্ট মনে পড়ে শ্যামা পূজা হচ্ছিল পাড়ায় পাড়ায়। মাত্র ৩ মাস আগে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার পরিজনদের নির্মমভাবে হত্যা করায় মানুষের মনে ছিল ভয় আর অস্বস্তি। দালাল রাজাকার স্বাধীনতাবিরোধীরা ছাড়া সাধারণ মানুষ তখন দিকনির্দেশনাহীন। তাদের মনে শঙ্কা। সবাই ধারণা করে নিয়েছিল সৈয়দ নজরুল ও তাজউদ্দীন আহমদরা কিছু না কিছু করবেন। বিশেষত তাজউদ্দীন আহমদের ওপর প্রগতিশীল ও বাংলাদেশপ্রেমী মানুষের আস্থা ছিল আকাশচুম্বী। তারা দলে তার পরিণতি ও মন্ত্রিসভা থেকে সরে যাওয়া ভালো চোখে দেখেনি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মোশতাকের খুনি রূপ বেরিয়ে আসলে জনগণ আরো বেশি তাজনির্ভর হয়ে দিন গুনতে থাকে। হঠাৎ পাড়ায় পাড়ায় আতঙ্ক আর চাপা অস্থিরতা সে রাতে আমাদের হতবিহ্বল করে ফেলে। তখন যোগাযোগহীন শহর বন্দরগুলো বলতে গেলে বিচ্ছিন্ন। ঢাকার খবর চট্টগ্রাম পৌঁছাতে দিন পেরিয়ে যেত। কিন্তু দুঃসংবাদ বাতাসের আগে ছোটে। সে রাতে পূজা তড়িঘড়ি করে সেরে সবাই বাড়ি ঘরে চলে যায়। পরদিন রটে যায় আমাদের দেশ গত রাতে নেতাদের হারিয়ে সত্যিকারের এতিম হয়ে গেছে। কী ঘটেছিল সে রাতে? ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে একটি পিকআপ এসে থামে। তখন রাত আনুমানিক দেড?টা থেকে দুটো। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় সে গাড়িতে কয়েক সেনা সদস্য ছিল। ঢাকা তখন এখন অস্থিরতার নগরী। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে অভ্যুত্থান এবং পাল্টা অভ্যুত্থান নিয়ে নানারকম কথা শোনা যাচ্ছে তখন। সে সময় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জেলার হিসেবে কর্মরত ছিলেন আমিনুর রহমান। রাত দেড়টার দিকে কারা মহাপরিদর্শক টেলিফোন করে জেলার মি. রহমানকে তাৎক্ষণিকভাবে আসতে বলেন। মূল ফটক দিয়ে ঢুকে বাম দিকেই ছিল জেলার আমিনুর রহমানের কক্ষ। তখন সেখানকার টেলিফোনটি বেজে উঠে। মি. রহমান যখন টেলিফোনের রিসিভারটি তুললেন, তখন অপর প্রান্ত থেকে বলা হলো প্রেসিডেন্ট কথা বলবেন। ২০১০ সালে বিবিসি বাংলার কাছে সে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে মি. রহমান বলেন, ‘টেলিফোনে বলা হলো প্রেসিডেন্ট কথা বলবে আইজি সাহেবের সঙ্গে। তখন আমি দৌড়ে গিয়ে আইজি সাহেবকে খবর দিলাম। কথা শেষে আইজি সাহেব বললেন যে প্রেসিডেন্ট সাহেব ফোনে বলছে আর্মি অফিসাররা যা চায়, সেটা তোমরা কর।’ বহু বছর পর এমন তথ্য বেরিয়ে এলেও সবাই জানেন এর আগে খন্দকার মোশতাক চার জাতীয় নেতাকে ফোন করেছিল। তাদের তিনি মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে বলে। সৈয়দ নজরুলসহ মনসুর আলী কামারুজ্জামান সাহেব তা বলিষ্ঠভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আর তাজউদ্দীন আহমদ? মোশতাক হয়তো ধরে নিয়েছিল তাজউদ্দীন আহমদ দল ও মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে রাখা নেতা, ফলে তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যকাণ্ডে বেখুশি নাও হতে পারেন। টোপ ফেলে মোশতাক তাকে প্রধানমন্ত্রিত্বের লোভ দেখালে তাজ তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, লিডারকে হত্যা করতে পারা খুনির সঙ্গে কথা বলতেও ঘৃণা হচ্ছে তার। মোশতাককে তিনি এমন ছবক দিয়েছিলেন যে ফোন রাখার সময় বেইমান খন্দকার মোশতাক নাকি বলেছিল : আমি আর আপনাদের বাঁচতে দিতে পারলাম না। আজীবন এক দলে এক নেতার অধীনে কাজ করা সহকর্মীদের গুলি করার আদেশ দিতে কণ্ঠ কাঁপেনি খুনি মোশতাকের। জেলার আমিনুর রহমান পরে বলেছিলেন কীভাবে মোশতাক ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করার জন্য ফটক খুলে দিতে এবং চার জাতীয় নেতাকে এক কাতারে দাঁড় করানোর আদেশ দিয়েছিল। শুরুতে যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম আর তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন এক কক্ষে। মধ্যরাতে কারাগারে পাগলা ঘণ্টা শুনেও ঘাবড়ে যাননি তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি পবিত্র কুরআন শরিফ পাঠ করছিলেন। সৈয়দ নজরুল অথবা কামারুজ্জামানকে শান্ত গলায় বলেছিলেন, ভয় পাবেন না। নামাজটা সেরে নিন। তাজউদ্দীন আহমদের প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা তাকে বলে দিয়েছিল কী ঘটতে যাচ্ছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এই চার নায়ক স্বাধীনতার অহংকার। ৯ মাস তাদের সংগ্রাম আর নেতৃত্ব না থাকলে মুক্তিযুদ্ধ বা দেশ স্বাধীন হওয়াটা ছিল অসম্ভব। আপনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়লেই জানবেন ভারতের সঙ্গে লিয়াজোঁ এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখা কতটা কষ্টসাধ্য ছিল। এক পর্যায়ে ইন্দিরা গান্ধী তাজউদ্দীন আহমদ ব্যতীত কাউকেই বিশ্বাস করতেন না। আর তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন আগাগোড়া চাপের মুখে। মুজিববাদী নামে পরিচিত অনেকেই তাকে শান্তিতে কাজ করতে দেয়নি। এই মানুষটি যুদ্ধের ৯ মাস পরিবারের সঙ্গে ছিলেন না। এমনকি তার একমাত্র পুত্র শিশু সোহেল তাজ তখন গুরুতর অসুস্থ হওয়ার পরও তিনি জোহরা তাজউদ্দীনকে বলেছিলেন, ওকে দেখার জন্য তো তুমি আছো। কিন্তু আমার মুক্তিযোদ্ধাদের দেখার জন্য তো আমি ছাড়া কেউ নেই। আমাকে মাফ করে দিও। গল্পের চেয়েও আকর্ষণীয় ঈর্ষণীয় সব কাহিনীর জনক এই চার নেতা। তাদের মেরে ফেলা মানে কোনো মানুষকে মেরে ফেলা জাতীয় কিছু ছিল না। মনে রাখতে হবে আত্মস্বীকৃত খুনিরা ততদিনে প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়ে গেছিল। ব্যর্থ হলেও খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান এবং মোশতাককে চপেটাঘাতের কথা তখন সবাই জেনে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে মানুষজনও বুঝতে শুরু করেছিল খুনিদের আর প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। ঠিক তখনই যাওয়ার আগে তারা বাংলাদেশের রাজনীতিকে নেতাহীন করার জন্য দেশকে অভিভাবকহীন করার জন্য জেলখানায় গিয়ে চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ কারণেই আমরা যারা ৬০ পেরিয়ে গেছি বারবার বলি, ১৯৭৫ সালের কোনো হত্যাকাণ্ডই অপরিকল্পিত কিছু নয়। এগুলোর পেছনে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি পাকিদের মদদ আর দেশ বিদেশের ষড়যন্ত্র ছিল পরিষ্কার। ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড স্মরণে জেলহত্যা দিবস পালন করে সরকারি দল। কিন্তু এটাই কি যথেষ্ট? আজ দেশ ও সমাজে ইতিহাসে কোথাও কি এদের কথা তুলে ধরা হয়? যে ৯ মাসের রক্তগর্ভ থেকে সৈয়দ নজরুল-তাজউদ্দীন আহমদের মতো নেতারা আমাদের একটি দেশ উপহার দিলেন কোথায় তার স্বীকৃতি। কেন তাদের আড়ালে রাখা? কিসের ভয়? আজকের মাথা উঁচু বাংলাদেশ আকাশসমান অট্টালিকা বাণিজ্য সম্পদ এসবই কি তাদের কাছে ঋণী নয়? ৩ নভেম্বর কারাগারের মতো নিরাপদ স্থানে প্রাণ হারানো চার জাতীয় নেতার প্রতি যথাযথ সম্মান আর শ্রদ্ধাতেই রাজনীতির মুক্তি। সরকারি বা বিরোধী যে কোনো রাজনীতি ও দল যদি তা না করে নেতা নেতৃত্বের সংকট কখনো দূর হবে না। মরণ সাগর পাড়ে যারা অমর তাদের জানাই প্রণাম। সিডনি থেকে অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App