×

স্বাস্থ্য

ডেঙ্গু নির্মূলে ‘ন্যাশনাল ভেক্টর কন্ট্রোল সেল’ জরুরি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২২, ১০:৫৪ এএম

ডেঙ্গু নির্মূলে ‘ন্যাশনাল ভেক্টর কন্ট্রোল সেল’ জরুরি

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার

বছরব্যাপী এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রাখার তাগিদ দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার। তিনি বলেছেন, বছরব্যাপী এডিস মশা নিধন কার্যক্রম চলমান না রাখলে প্রতি বছরই ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। এক্ষেত্রে দেশব্যাপী বাহকবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান হওয়া দরকার। যে প্রতিষ্ঠানটির নাম হতে পারে ‘ন্যাশনাল ভেক্টর কন্ট্রোল সেল’। ভোরের কাগজকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।

কবিরুল বাশার বলেন, ন্যাশনাল ভেক্টর কন্ট্রোল সেলের রূপরেখা ২০১৯ সালে দিয়েছিলাম। সেটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন আছে। এমন একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান যতদিন পর্যন্ত না হবে ততদিন বাহকবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে বহুবিদ সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে।

সেলের কার্যকারিতা সম্পর্কে তিনি বলেন, এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম হবে- দেশব্যাপী যে কোনো ধরনের মশা বা পোকামাকড়বাহিত রোগ বালাই নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে রোগ নিয়ন্ত্রণের আগাম প্রস্তুতি নেয়া। বাহক নিয়ন্ত্রণে কি ধরনের কীটনাশক ব্যবহৃত হবে, এটি প্রয়োগে কি ধরনের যন্ত্রপাতি লাগবে সব বিষয়ে তারা গবেষণা করবে। একই সঙ্গে দেশের যেকোনো জায়গায় যেকোনো ধরনের সমস্যার উদ্ভব হলে ‘র‌্যাপিড অ্যাকশন রেসপন্স’ হিসেবে এই প্রতিষ্ঠান কাজ করবে। এছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যেমন সিটি করপোরশেন, পৌরসভা, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই কন্ট্রোল সেল সহাসয়তা করবে। এভাবে জাতীয় পর্যায়ে বাহক রোগ নির্মূলের পরিকল্পনা থাকা খুবই জরুরি।

দেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহতার চিত্র বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু ভাইরাস আসে। তখন তাকে বলা হতো ‘ঢাকা ফিবার’। এরপর ২০২০ সালে ডেঙ্গি যখন আবার আসে তখন তাকে ডেঙ্গু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এরপর থেকেই আমরা যখন ডেঙ্গু নিয়ে গবেষণা করি তখনই চিহ্নিত করা হয় ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা।

তিনি বলেন, ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরই দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা গেছে। কখনো কম, কখনো বেশি। ২০০০ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রতি মাসে রোগী ভর্তির তথ্যের বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২১ বছরের ইতিহাসে কখনো আগস্ট, কখনো সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি হয়েছে। কিন্তু ২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি ব্যতিক্রম দেয়া গেল চলতি অক্টোবর মাসে।

২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল ২৪০৬ জন। মারা গিয়েছিল মাত্র ৬ জন। ২০১৯ সালে লক্ষাধিক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে অক্টোবরে আক্রান্ত হয়েছিল ৮১৪৩ জন। তবে তখন কোনো রোগী মারা যায়নি। ২০২০ সালে ১৬৪ জন অক্টোবরে আক্রান্ত হয়েছিল, মারা গিয়েছিল ৩ জন। ২০২১ সালে ৫৪৫৮ জন অক্টোবর মাসে আক্রান্ত হয়েছিল এবং ২২ জন মারা গিয়েছিল। কিন্তু ২০২২ সালে এসে আমরা খুবই ভিন্ন ধরনের চিত্র দেখলাম। এ বছর সব মিলে ৩৬ হাজারের কিছু উপরে মানুষ আক্রান্ত হলেও শুধু অক্টোবরে আক্রান্ত হয়েছেন ২০৩৯ হাজারেরও অধিক মানুষ। এর মধ্যে মারা গেছেন ৭৮ জন।

২০২২ সালে ডেঙ্গুতে অধিক মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা যখন কারণ বিশ্লেষণ করতে যাই তখন কয়েকটি ফ্যাক্টর নিয়ে এনালাইসিস করি। এর মধ্যে রয়েছে – বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা, এসিড মশার ঘনত্ব ও ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা। এই ডাটাগুলোকে বিশ্লেষণ করে মাল্টিপল কম্পিউটার সিভিলেশন মডেলিংয়ের মাধ্যমে ফরকাস্টিং মডেল করি। সেই মডেলে দেখা গেছে- চলতি বছর অধিক সংখ্যক ডেঙ্গু আক্রান্তের পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের একটি প্রভাব রয়েছে। কারন, অন্যান্য বছরের মতো এবারো অক্টোবরে মাসে থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে এডিস মশার ঘনত্ব বেড়েছে।

কবিরুল বাশার বলেন, বছরের শুরুতে মে মাসে ডেঙ্গু শুরু হয়েছিল। এরপর আমরা ডেঙ্গুরোগী কমাতে পারিনি। যেহেতু আমাদের দেশে রোগীর পাশাপাশি ডেঙ্গুর ঘনত্বও রয়েছে এবং উপযোগী পরিবেশে রয়েছে সে কারণে জ্যামিতিকহারে ডেঙ্গুরোগী বেড়েছে এবং অক্টোবর মাসে সেটি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

গবেষণার ভিত্তিতে তিনি বলেন, অক্টোবরের পর থেকে হয়তো ডেঙ্গুরোগী কিছুটা কমতে শুরু করবে। কারণ, সেখানে বৃষ্টিপাত আর্দ্রতার কিছুটা প্রভাব রয়েছে। সিত্রাং কিছুটা ভালো ফলাফল এনে দিয়েছে। সিত্রাংয়ে বাইরের অনেক মশাই মারা গেছে। তাছাড়া মশার প্রজননস্থল কিছুটা ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু অন্যদিকে সিত্রাংয়ের বৃষ্টিপাতের ফলে যেসব জায়গায় পানি জমেছে সেসব জায়গায় ১৫ দিন পরে আবারো প্রচুর পরিমাণে মশা উৎপাদন হবে। সেটা হতে পারে কিউলেক্স বা এডিস মশা।

সারাবছরই ডেঙ্গুর সম্ভাবনা থাকবে জানিয়ে কবিরুল বাশার বলেন, নভেম্বরের পর থেকে এসিড মশার ঘনত্ব এবং রোগীর সংখ্যা কিছুটা কমে এলেও এখন থেকে একটি দৃশ্য আমরা সারাবছরই দেখব, ডেঙ্গু আমাদের দেশে বিরাজমান থাকবে। তাই বছরব্যাপী এডিস মশা নিধন কার্যক্রম চলমান রাখতে হবে। অন্যথায় প্রতিবছরই যখন মৌসুম আসবে, জুন, জুলাই আগস্ট সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারন করবে। বছরব্যাপী এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চলমান রাখতে পারলে ডেঙ্গুকে সঠিকভাবে ম্যানেজমেন্ট করতে পারব। আরেকটি বড় বিষয় হলো- এ বছর ডেঙ্গু দেশের প্রতিটি জেলায়ই কম বেশি হয়েছে। অথচ জেলাগুলোতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য তেমন কোনো জনবল, যন্ত্রপাতি ও কীটনাশক নেই। এ সব ব্যাপারে জাতীয় পর্যায়ে সমাধানের চিন্তা করতে হবে সংশ্লিষ্টদের।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App