×

অর্থনীতি

ব্যাংকের দোষেই বাড়ছে খেলাপি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২২, ০৮:৫৫ এএম

ব্যাংকের দোষেই বাড়ছে খেলাপি

প্রতীকী ছবি

খেলাপি ঋণের জন্য মূলত দায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মন্দ ব্যবস্থাপক, এমডি ও চেয়ারম্যানরা

করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ঋণ পরিশোধে বড় ছাড় দেয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও ঋণ শ্রেণিকরণের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করছে না। এত ছাড়ের মধ্যেও গত জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়ে সোয়া লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এদিকে, দেশের একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ঘুরেফিরে ঋণ পাচ্ছেন। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় তারা ব্যাংকের ঋণের টাকা ফেরত দেন না। কেউ কেউ নামে-বেনামে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে তা বিদেশেও পাচার করছেন। সাধারণত ওসব টাকা আর ফেরত আসে না। ফলে বেড়েই চলেছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। মূলত ঋণ বিতরণে যথাযথ নিয়ম না মানায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, খেলাপি ঋণের জন্য মূলত দায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মন্দ ব্যবস্থাপক, এমডি ও চেয়ারম্যানরা। এ তিন জায়গায় নিয়োগ ঠিক করতে পারলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেকাংশে নেমে যাবে।

যখন কোনো কারণে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় পর কোনো ঋণ বা ঋণের কিস্তি ফেরত পাওয়া যায় না বা সম্ভব হয় না, তখন ওই ঋণকে খেলাপি ঋণ বলে। বর্তমান বাংলাদেশের অর্থনীতি তথা ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা এ খেলাপি ঋণ। আর এ লাগামহীন খেলাপি ঋণের জন্যই অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে এক ধরনের বন্ধ্যাত্ব। ফলে বিনিয়োগ বাড়ছে না আশানুরূপ, যার প্রভাব অর্থনীতিতে দৃশ্যমান। এমনকি অবকাঠামোগত উন্নয়নেও এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। সামান্য মাত্রায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও পরিবর্তন করতে গেলেও অন্যের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। অথচ বিশাল এ খেলাপি ঋণ যদি না থাকত তাহলে কিন্তু অনায়াসে বড় বড় প্রকল্প কোনো ধরনের বিদেশি ঋণ বা সাহায্য ছাড়াই সম্পন্ন করা যেত।

সূত্র জানায়, গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা। গত জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। আলোচ্য ছয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের জুনে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। এক বছরে অর্থাৎ গত বছরের জুনের তুলনায় গত জুনে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা। এবারই প্রথম খেলাপি ঋণ সোয়া লাখ কোটি টাকা ছাড়াল। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, খেলাপি ঋণের এ হিসাবের মধ্যেও ফাঁকি আছে। কারণ এখানে পুনঃতফসিল করা ঋণের হিসাব দেখানো হয় না। ওই ঋণ অবলোপ করা হয়।

অর্থনীতিতে অভিশপ্ত খেলাপি ঋণ সৃষ্টির উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা জানান, অনেক ব্যবসায়ী ঋণখেলাপি হওয়ার জন্য ঋণ নেন এবং টাকা পাচার করেন। আবার ব্যাংকারদের কেউ কেউ অসৎ না হলে কোনো মন্দ গ্রাহক ঋণ নিতে পারেন না। তাদের মতে, ঘুসখোর ব্যাংকার (কিংবা মালিকপক্ষ বা রাজনৈতিক চাপে) সব সময় মন্দ গ্রাহক খুঁজে ফেরেন। দেশে আলোচিত হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটকারী নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর সেই সময়ের এমডি, চেয়ারম্যান জড়িত বলে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। ব্যাংকাররা জানেন কীভাবে জামানতের মূল্য বেশি দেখাতে হয় এবং কীভাবে সাজালে জাল দলিলে ঋণ পাওয়া যায়। জামানত ছাড়া তৎকালীন গ্রামীণ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৩ থেকে ৪ শতাংশে। আবার চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর আগে তৎকালীন বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫ শতাংশের নিচে। জানা মতে, করোনাকালে ৪ শতাংশ সুদেও অনেক ভালো গ্রাহক ঋণ নেননি। ভালো গ্রাহক জানেন, অপ্রয়োজনে ঋণ নিয়ে সুদ গোনা কোনো কাজের কাজ নয়।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, খেলাপি ঋণের যে হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংক দেয় আইএমএফের হিসেবে তার পরিমাণ বাস্তবে দ্বিগুণের কম নয়। কারণ পুনঃতফসিল করা ঋণ রেগুলার ঋণ হিসেবে দেখানো হয়। আসলে ওই টাকা আর কখনো ফেরত পাওয়া যাবে না। আহসান এইচ মনসুর বলেন, যে খেলাপি ঋণের কথা বাংলাদেশ ব্যাংক বলে, যাদের কথা বলে তাদের একটা বড় অংশ বোকাসোকা। তারা হয়তো যৌক্তিক কারণেই খেলাপি হয়েছেন। তাদের ঋণের পরিমাণও অল্প। কিন্তু মূল ঋণ নিয়েছে অল্প কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। তাদের আইনের নানা সুবিধা দিয়ে ঋণখেলাপি হিসাবে দেখানো হয় না। একই কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর। তিনি বলেন, আমরা খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক দেখলেও এর দায় অল্প কয়েকজনের। ব্যাংকিং খাত তাদের নিয়ন্ত্রণে। তারা এই খাতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছেন। ফলে প্রকৃত যারা বিনিয়োগকারী, উদ্যোক্তা তারা ক্ষতির মুখে পড়ছেন।

খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার আরো কিছু কারণ হচ্ছে- রাজনৈতিক নেতা ও ব্যাংকের পরিচালকদের প্রভাব; রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা; পর্যাপ্ত জামানতের অভাব; খরা-বন্যাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ; প্রকল্পের গুরুত্ব ও ভবিষ্যৎ বিবেচনা না করা; পর্যাপ্ত আইনের অভাব; মামলা নিষ্পত্তির দীর্ঘসূত্রতা; সরকারের ট্যারিফ নীতি; বন্ধকি সম্পত্তির বিক্রয়জনিত জটিলতা ইত্যাদি।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, খেলাপি হলে নতুন করে ঋণ পাওয়ার কথা নয়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স¤প্রতি পুনঃতফসিলের ক্ষমতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কাছে ছেড়ে দিয়ে একটি উদার নীতি দেখিয়েছে। তাতে খেলাপি কমার চেয়ে আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তা ছাড়া আইনি প্রক্রিয়া দুর্বল হওয়ার কারণেও খেলাপি ঋণ আদায় হচ্ছে না। ফলে ব্যাংকগুলো আইনি প্রক্রিয়ায় ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে আগ্রহ দেখায় না। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আইনি প্রক্রিয়া আরো সহজ হওয়া প্রয়োজন। আর আইনি প্রক্রিয়া সহজ হলেই খেলাপি ঋণ আদায় বাড়বে।

৫০০ কোটি টাকার বড় অঙ্কের একটি মেয়াদি ঋণ চার দফায় ২৯ বছরের জন্য পুনঃতফসিলের সুযোগ দিয়ে গত ১৮ জুলাই সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ১৬ দিনের মধ্যে সংশোধনী দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া নতুন সার্কুলারে ঋণখেলাপিদের আরো ছাড় দেয়ার পাশাপাশি বেশ কিছু ক্ষেত্রে কড়াকড়িও করা হয়। এতে বলা হয়, পুনঃতফসিল করা কোনো ঋণ ৬ মাস অনাদায়ী থাকলে তা সরাসরি ক্ষতিজনক মানে শ্রেণিকরণ করতে হবে। আর প্রকৃত আদায় ছাড়া পুনঃতফসিল করা ঋণের সুদ আয় খাতে নেয়া যাবে না। সব ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতার শর্ত তুলে দেয়া হয়েছে। এছাড়া পুনঃতফসিল করা কোনো ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে খেলাপি করলে সেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে।

যদিও আদালতে এখন ব্যাংক ও আর্থিক খাতের কয়েক লাখ মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এসব মামলার বিপরীতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ১ লাখ কোটি টাকার বেশি আটকে আছে। এ বিষয়ে কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার তানজীব-উল-আলম বলেন, হাইকোর্টের আদেশের মাধ্যমে অর্থঋণ আদালতের মামলা বছরের পর বছর ঝুলে আছে। এছাড়া চলমান মামলার বিচারকাজ অযৌক্তিকভাবে মুলতবি রাখা হয়। বিচারকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকায় এসব মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি সম্ভব হচ্ছে না। তিনি আরো বলেন, হাইকোর্টের আদেশে যে মামলাগুলো স্থগিত রয়েছে, সেগুলো বাতিলের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে এজন্য উদ্যোগ নিতে হবে।

কঠোর অবস্থানে কিছু ব্যাংক: ব্যাংক থেকে বার বার তাগিদ দেয়ার পরও কিস্তি পরিশোধ না করায় ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে এবার কঠোর অবস্থান নিয়েছে কয়েকটি ব্যাংক। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকের অর্থঋণ ও সার্টিফিকেট মামলায় বড় বড় ঋণখেলাপি গ্রাহককেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ৩২৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকা পরিশোধ না করে আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় নুরজাহান গ্রুপের এমডি জহির আহমেদ রতন, পরিচালক টিপু সুলতান ও ফরহাদ মনোয়ারকে ৫ মাসের কারাদণ্ড দেন অর্থঋণ আদালত। পাশাপাশি রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের (আরএসআরএম) এমডি মাকসুদুর রহমানকে ৩১২ কোটি ৮২ লাখ টাকা ঋণখেলাপির দায়ে পাসপোর্ট জব্দসহ দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালত। এছাড়া জনতা ব্যাংকের মতিঝিল করপোরেট শাখায় গোল্ডেন রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের সাড়ে ৬ কোটি টাকা অনাদায়ে খেলাপি গ্রাহক মো. আবুল হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়। বৈদেশিক বাণিজ্য করপোরেট শাখার আব্দুস সামাদ প্যাকেজিংয়ের আড়াই কোটি টাকা অনাদায়ে প্রতিষ্ঠানটির ৩ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গাজীপুর করপোরেট শাখার খেলাপি গ্রাহক মেসার্স হাসান স মিলের ১ কোটি ১ লাখ টাকা অনাদায়ে মিলটির মালিক খন্দকার জাকির হোসেনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়।

এদিকে প্রায় ৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের চার ঋণখেলাপিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে এনডি গ্রুপের চেয়ারম্যান মাহমুদা জামানও রয়েছেন। গ্রেপ্তার হওয়া অন্য আসামিরা হলেন- মো. আলমগীর হোসেন, মাহবুব আলম ও এইচএম শহীদুল আলম মানিক। তারা সবাই এনডি গ্রুপের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে রূপালী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে। এ বিষয়ে রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ে আমরা কঠোর অবস্থান নিয়েছি। এনডি গ্রুপের চেয়ারম্যানসহ চার আসামিকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে খেলাপিদের কাছে একটি বার্তা যাবে। ব্যাংকের অন্য ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধেও আইনি প্রদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে আমরা কোনো আপস করব না।

আড়াই হাজার কোটি টাকা সুদ মওকুফ : চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন- এই তিন মাসে বেসরকারি ব্যাংকগুলো তাদের বিতরণ করা ঋণে সুদ মওকুফ করেছে ২ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা। যা আগের প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) ছিল মাত্র ১৯১ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো আগের প্রান্তিকের তুলনায় ২ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা বেশি সুদ মওকুফ করেছে, যা প্রায় ১২ গুণ বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, সুদ মওকুফের সিংহভাগ সুবিধা নিয়েছেন ব্যাংকের পরিচালকরা। কিছু ক্ষেত্রে বেসরকারি ব্যাংকগুলো এখন অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের সঙ্গে যোগসাজশেও সুদ মওকুফ করছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App