×

আন্তর্জাতিক

ট্রাসের পর কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ম্যাক্রোঁ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২২, ১১:১৪ এএম

ট্রাসের পর কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ম্যাক্রোঁ

ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ

ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের শাস্তি হিসেবে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব এখন যেন বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে। জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দেখা দিয়েছে মুদ্রাস্ফীতি। যুক্তরাজ্যে টালমাটাল বাজার পরিস্থিতিতে আরো বেশি ঝুঁকিতে পড়েছে প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের রাজনৈতিক অবস্থান। গত মে মাসে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবার এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। রয়টার্স

ফ্রান্সে কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে বেতন ও মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে গতকাল দেশজুড়ে ধর্মঘটের ডাক দেয় দেশটির ট্রেড ইউনিয়ন। এর মধ্যে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ফ্রান্সের তেল পরিশোধনাগারের কর্মীরা কর্মবিরতি পালন করছে, যার ফলে কার্যত দেশটিতে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। এর সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবারের ধর্মঘটে যোগ দেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গণপরিবহনের মতো সরকারি খাতের কর্মীরা।

উল্লেখ্য, ফরাসি সরকার বিশেষ ক্ষমতাবলে জরুরি পরিস্থিতিতে সেবা খাতে কর্মীদের ‘রিকুইজিশন’ করতে পারেন। সে সময় কর্মীরা ধর্মঘট করলেও কাজে যোগ দিতে বাধ্য থাকেন। বিশ্লেষকদের মতে, কর্মীদের দাবি নিয়ে আলোচনা ফলপ্রসূ হওয়ার আগেই রিকুইজিশনের সরকারি সিদ্ধান্তে হিতে বিপরীত হয়েছে।

ফরাসি সরকারের মুখপাত্র অলিভিয়ের ভেরান জানান, আরো কর্মীদের রিকুইজিশন দেয়া হতে পারে, কারণ পেট্রোল স্টেশনে জ্বালানির জন্য অপেক্ষমাণ গাড়ি চালকদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তিনি বলেন, ‘যতজনকে প্রয়োজন, ততজনকেই রিকুইজিশন করা হবে। যখন বেতন নিয়ে এক ধরনের ঐকমত্যে পৌঁছানো গেছে, তখন পরিশোধনাগার বন্ধ করে রাখা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়।’

বামপন্থি সিজিটি ইউনিয়ন টানা চতুর্থ সপ্তাহের জন্য ফরাসি জ্বালানি সংস্থা টোটালএনার্জিসের কর্মীদের কাজে যোগ না দেয়ার আহ্বান জানায়। শুক্রবার ৭ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি ও একটি বোনাস দেয়ার প্রস্তাবে একমত হয়েছিল টোটালএনার্জিস ও মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী কিছু ইউনিয়ন। তবে সিজিটি প্রতিষ্ঠানটির উচ্চ মুনাফা ও মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে ১০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি হওয়া না পর্যন্ত ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। তাদের যুক্তি, একদিকে মুদ্রাস্ফীতি চলছে অন্যদিকে কোম্পানিটি বিপুল মুনাফা করেছে।

উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে ইউরো জোনের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটিতে উত্তেজনা বেড়ে চলেছে। এর মধ্যে ধর্মঘট জ্বালানি খাতের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়েছে যার মধ্যে বহুজাতিক পারমাণবিক বিদ্যুৎ কোম্পানি ইডিএফও আছে। ধর্মঘটের কারণে এখানে ইউরোপের বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রক্ষণাবেক্ষণ কাজ বিলম্বিত হতে পারে। এফএনএমই-সিজিটি ইউনিয়নের একজন প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ধর্মঘটের কারণে ফ্রান্সের ১০টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটছে, ১৩টি রিঅ্যাক্টরে রক্ষণাবেক্ষণ কাজে ফের বিলম্ব ঘটছে আর এতে ফ্রান্সে বিদ্যুৎ উৎপাদন মোট ২ দশমিক ২ গিগাওয়াট হ্রাস পেয়েছে। ইউরোস্টার জানিয়েছে, ধর্মঘটের কারণে তারা লন্ডন ও প্যারিসের মধ্যে কিছু নির্ধারিত ট্রেনযাত্রা বাতিল করেছে।

দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে রবিবার প্যারিসের রাস্তায় বড় ধরনের প্রতিবাদ দেখা গেছে। এদিন কয়েক হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানায়। এ সময় ফ্রান্সের কট্টর বামপন্থি দল লা ফঁস আসুমিজেঁর নেতা জ্য লুক মিলশঁ, চলতি বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া লেখক আনি এরন্যু পাশাপাশি মিছিল করে এগিয়ে যান। এ মিছিলের পরই মঙ্গলবারের সাধারণ ধর্মঘট পালনের ডাক দেন মিলশঁ।

এমন এক সময় এই ধর্মঘট শুরু হয়েছে যখন ফ্রান্সের রাজনীতির অঙ্গনে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি চলছে। রবিবার দেশটির প্রধানমন্ত্রী এলিসাবেথ বোর্ন জানান, সরকার বিশেষ সাংবিধানিক ক্ষমতা ব্যবহার করে সংসদে ভোটগ্রহণ ছাড়াই ২০২৩ সালের বাজেট পাস করানোর চেষ্টা চালাবে। সব মিলিয়ে বলা যায়, প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সরকার খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই।

ক্ষমা চাইলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস: বিতর্কিত ‘মিনি-বাজেট’ প্রণয়নের দায় নিয়ে ক্ষমা চেয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস। গত সোমবার এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমি দায় স্বীকার করতে চাই এবং যে ভুলগুলো হয়েছে তার জন্য দুঃখিত…।’ তবে এজন্য তিনি পদত্যাগ করছেন না। বরং পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে দলকে নেতৃত্ব দেবেন বলেও জানিয়ে দিয়েছেন।

২০১৬ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ভোট দেয়ার পর থেকে রাজনৈতিক সংকটে জর্জরিত ব্রিটেন এ পর্যন্ত ৩ জন প্রধানমন্ত্রীকে হারিয়েছে। ট্যাক্স কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে গত মাসে কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্বে জয়ী হন ট্রাস। ক্ষমতায় এসেই এরইমধ্যে অজনপ্রিয় বাজেট প্রণয়ন এবং কিছু অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নেন তিনি। এসব পদক্ষেপ তার দলকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলেছে। এখন তিনি রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকার লড়াই করছেন।

অল্প সময়ের এই প্রধানমন্ত্রিত্ব ‘নিখুঁত ছিল না’, তবে নিজের ভুল ‘শুধরে’ নিয়েছেন বলে সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন লিজ ট্রাস। ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি আরো বলেন, তিনি যুক্তরাজ্যের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য এখনো প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে এটি অর্জন করতে যে এখন আরো বেশি সময় লাগবে, সেটাও স্বীকার করেন তিনি।

অর্থনৈতিক এই বিশৃঙ্খলায় প্রধানমন্ত্রী লিজের নিজ দলেও অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে। কনজারভেটিভ পার্টিরই শতাধিক সংসদ সদস্য (এমপি) ট্রাসের প্রতি অনাস্থা জানিয়েছেন। আর এতে করে জনমত জরিপে বিরোধী লেবার পার্টির চেয়ে পিছিয়ে পড়ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই ধাক্কায় আগামী সাধারণ নির্বাচনেও অনেক আসন হারাতে পারে কনজারভেটিভ পার্টির।

ট্যাক্স ইস্যুকে কেন্দ্র করে টানাপড়েন তৈরি হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে কোয়াসি কোয়ার্টেংকে সরিয়ে দেন গত ১৪ অক্টোবর। তার স্থলাভিষিক্ত হন জেরেমি হান্ট। চলতি বছর শুক্রবার নিয়োগ পাওয়া যুক্তরাজ্যের চতুর্থ অর্থমন্ত্রী জেরেমি হান্ট।

যুক্তরাজ্যে টালমাটাল বাজার পরিস্থিতি সামাল দিতে ৩ সপ্তাহ আগে সরকারের ঘোষিত মিনি বাজেটে কর ছাড়ের প্রায় সব পরিকল্পনা থেকেই সরে এসেছেন নতুন অর্থমন্ত্রী জেরেমি হান্ট। তিনি বলেছেন, ‘আমরা মিনি-বাজেটের প্রায় সব কর পদক্ষেপই পাল্টে দেব।’ হান্টের এই ঘোষণা প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের কর-ছাড় পরিকল্পনার সম্পূর্ণ বিপরীত। এতে আরো বেশি ঝুঁকিতে পড়েছে ট্রাসের রাজনৈতিক অবস্থান।

নিষেধাজ্ঞা দুধারি তলোয়ার: গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও অন্যান্য দেশ বড় পরিসরে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ইউরোপীয় কাউন্সিল থেকে রাশিয়াকে বাদ দেয়া হয় এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে ভেটো প্রদানের ক্ষমতা তুলে নেয়া হয়। কয়েকটি পশ্চিমা দেশ তাদের দেশ থেকে রাশিয়ার কূটনীতিকদের বহিষ্কারও করে।

অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার অংশ হিসেবে বিভিন্ন দেশে রাশিয়ার সম্পদ বাজেয়াপ্তের পদক্ষেপ নেয়া হয়। আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থা সুইফট থেকে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে বাদ দেয়া হয়। পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার বিদেশে মজুত সম্পদের অর্ধেকের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেয়। এর পরিমাণ কমবেশি ৩১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়া রপ্তানির ক্ষেত্রেও কঠোর বিধিনিষেধ দেয়া হয়।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, নিষেধাজ্ঞা সব সময় দুধারি তলোয়ারের মতো। রাশিয়া এখন যেসব পাল্টা পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেগুলোর পরিণতি কী হতে পারে, তা নিয়ে অনেক পশ্চিমা নীতিনির্ধারক ভুল ধারণা পোষণ করেছেন। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো- জ্বালানির ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি। ইউরোপে ব্যবহৃত গ্যাসের ৪০ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। আসন্ন শীত মৌসুমে গ্যাসের আমদানি ও দাম ইউরোপের রাজনীতির প্রধান বিষয় হয়ে উঠবে। জার্মানি, ফ্রান্স ও ইতালির ট্যাবলয়েড পত্রিকায় শীতের সময় বরফে জমে যাওয়া বাড়িঘরের অবস্থা কেমন হবে, সেই চিত্র তুলে ধরছে। ইউরোপের প্রধান এ তিন দেশের সম্ভাব্য পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App