×

জাতীয়

সক্রিয় শিখন পদ্ধতিতে মূল্যায়ন আগামী বছরই

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২২, ০৯:০০ এএম

সক্রিয় শিখন পদ্ধতিতে মূল্যায়ন আগামী বছরই

ফাইল ছবি

প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সব ধরনের পরীক্ষা বাদ দিয়েছে সরকার। এর বিপরীতে জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় নিয়ে ‘সক্রিয় শিখন পদ্ধতিতে’ শিক্ষকরা মূল্যায়ন করবেন শিক্ষার্থীদের। এতে প্রতি চার মাস অন্তর অন্তর বছরে তিনবার শিক্ষার্থীদের শিখন অগ্রগতি প্রতিবেদন নামে একটি ‘রিপোর্ট কার্ড’ দেয়া হবে এবং তাতে মান অনুযায়ী ‘সন্তোষজনক, উত্তম ও অতিউত্তম’ লেখা থাকবে। রিপোর্ট কার্ডে লেখা ‘সন্তোষজনক, উত্তম এবং অতিউত্তম’ বিশেষণ থেকেই অভিভাবককে বুঝে নিতে হবে তার সন্তান স্কুলে কেমন পড়াশুনা করছে। আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে পড়াশুনায় নতুন এই পদ্ধতি কার্যকর হতে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে প্রথাগত পরীক্ষা পদ্ধতিরও বিদায় হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতিতে এই তিন শ্রেণিতে শিক্ষকরা ক্লাসে এসে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাতেন। তারপর বাড়ির কাজ দিতেন। বছরে তিনবার প্রথম সাময়িক, দ্বিতীয় সাময়িক বা অর্ধবার্ষিক এবং বার্ষিক পরীক্ষা দিতে হতো শিক্ষার্থীদের। কিন্তু নতুন পদ্ধতিতে এসবের কিছুই থাকছে না। নতুন এই পদ্ধতিতে স্কুলেই সব পড়াশুনা হবে। পাশাপাশি সময়নিষ্ঠা, শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, আচার-আচরণ, দলীয়, একক কাজে অংশগ্রহণ এবং বিশেষ পারদর্শিতা ধারাবাহিকভাবে মূল্যায়ন করা হবে। একজন শিক্ষার্থী স্কুলে এসে কী করে, কীভাবে হাঁটাচলা করে, কীভাবে পড়াশুনা করে, কীভাবে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে, কীভাবে সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলে, খেলাধুলা কিংবা অন্যান্য বিষয়ে ওই শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ কেমন- তার সবই শিক্ষক মূল্যায়ন করবেন। অর্থাৎ স্কুলে শিক্ষার্থীর প্রতি মুহূর্তের কর্মকাণ্ডই মূল্যায়ন করবেন শিক্ষক। আর একেই ধারাবাহিক মূল্যায়ন বা সক্রিয় শিখন পদ্ধতির মূল্যায়ন বলা হচ্ছে। এই মূল্যায়নের জন্য পাঠ্যবইও পরিবর্তন হচ্ছে। আগামী শিক্ষাবর্ষে নতুন শিক্ষাক্রমে প্রথম শ্রেণির পাঠ্যবই দেয়া হচ্ছে।

জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) প্রাথমিক শিক্ষাক্রম উইংয়ের সদস্য অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান ভোরের কাগজকে বলেন, নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা বক্তৃতা নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে সক্রিয় শিক্ষাব্যবস্থার যুগে প্রবেশ করছে। এতে তারা পরীক্ষাভীতি থেকেও মুক্ত হবে। নতুন এই পদ্ধতির জন্য প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৭টি বিষয়ে তিনটি বই পড়ানো হবে এবং তৃতীয় শ্রেণিতে ৮টি বিষয়ে ৬টি বই পড়ানো হবে।

তিনি বলেন, নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষকরা শুধু চার মাস পর একটি রিপোর্ট কার্ড দিয়েই বসে থাকবেন না, শিক্ষার্থীর শিখন অগ্রগতি নিয়ে চার মাস পরপর অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলবেন। ওই সময়ই অভিভাবকদের জানাতে হবে, শিক্ষার্থীর কোথায় কোথায় ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতি পোষাতে দুর্বল শিক্ষার্থীদের নিয়ে ‘নিরাময়মূলক ক্লাস’ করবেন শিক্ষকরা। এজন্য শিক্ষকদের যা যা কৌশল নিতে হবে তাও শিক্ষক গাইডে এনসিটিবি থেকে বলে দেয়া হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ও ২০১০ সালের শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, শিখনকালীন মূল্যায়ন অত্যন্ত ভালো প্রক্রিয়া। কিন্তু এর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ব্যবস্থা না থাকলে শিখনকালীন মূল্যায়ন পদ্ধতি ব্যর্থ হতে বাধ্য। শিখনকালীন মূল্যায়নে আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, তুলনামূলক পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের সমানভাবে যোগ্য করে তুলতে হবে। যারা পিছিয়ে পড়ছে তাদের বাদ দিয়ে শুধু যারা যোগ্য তাদের নিয়ে চললে হবে না। যারা পিছিয়ে থাকবে তাদের জন্য নিরাময়মূলক ব্যবস্থা থাকতে হবে। এ ব্যবস্থা না থাকলে শিখনকালীন মূল্যায়নের কোনো অর্থ নেই।

পড়াশুনার এই নতুন পদ্ধতি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এতে শিক্ষার্থীর জ্ঞান, দক্ষতা ও মূল্যবোধকে মূল্যায়ন করা হবে। ধারাবাহিক মূল্যায়নে আনুষ্ঠানিক কোনো পরীক্ষা নয়, তাই বিদ্যালয়ে ও শ্রেণিকক্ষে পৃথকভাবে কোনো পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে না। শিক্ষার্থীদের এই মূল্যায়ন সম্পর্কে আগে কোনো ধারণা বা নোটিস দেয়া হবে না। শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে স্বাভাবিক ও আনন্দময় পরিবেশে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করবেন। পাশাপাশি প্রতিটি অধ্যায় পড়াশেষে শিক্ষকরা একটি চেকলিস্ট ব্যবহার করবেন। ওই চেকলিস্টে শিক্ষকদের দেখতে হবে, শিক্ষার্থী জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধের বিষয়গুলো আত্মস্থ করতে পেরেছে কিনা। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের তথ্য ও ভাবের উপস্থাপন সঠিক হয়েছে কিনা। শব্দ চয়ন সুন্দর, উচ্চারণ স্পষ্ট ও সাবলীল কিনা। হাতের লেখা পরিষ্কার ও সুন্দর কিনা। সবশেষে শিক্ষার্থীদের হাতে শিখন অগ্রগতি প্রতিবেদন নামে রিপোর্ট কার্ড দেয়া হলেও স্কুলে পাঠ চলাকালীন মূল্যায়ন তথ্য সংরক্ষণ ডায়েরি নামে শিক্ষার্থীর সব তথ্য সংরক্ষিত থাকবে।

ধারাবাহিক মূল্যায়নের উদ্দেশ্য : শিখনে শিক্ষার্থীকে সহায়তা করা ধারাবাহিক মূল্যায়নের অন্যতম উদ্দেশ্য। শিক্ষার্থীর শিখন অগ্রগতি নিয়মিতভাবে পরিবীক্ষণ করে শিখন ঘাটতি বা উন্নয়নের ক্ষেত্র নিরূপণ করা এবং তার প্রতিকার করা। চিহ্নিত ঘাটতিগুলো পুনঃমূল্যায়নের মাধ্যমে পূরণ করা। এছাড়াও ধারাবাহিক মূল্যায়নে চারটি ধাপ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে, পরিকল্পনা প্রণয়ন, মূল্যায়ন পদ্ধতি, মূল্যায়ন পরিচালনা ও তথ্য সংরক্ষণ, সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ কার্যকর ফলাবর্তন দেয়া।

মূল্যায়নের প্রয়োগক্ষেত্র : ধারাবাহিক মূল্যায়নের প্রয়োগক্ষেত্র তিনটি- জ্ঞান, দক্ষতা এবং মূল্যাবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি। প্রতিটি প্রয়োগক্ষেত্রের আবার কয়েকটি উপক্ষেত্র রয়েছে। জ্ঞান প্রয়োগক্ষেত্রের উপক্ষেত্র হল- জানা, অনুধাবন ও প্রয়োগ। আবার দক্ষতার উপক্ষেত্র হলো- সৃজনশীলতা, সূ²চিন্তা, যোগাযোগ ও সহযোগিতা। একইভাবে মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির উপক্ষেত্রগুলো হচ্ছে- সহমর্মিতা, পরমতসহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও কৌতূহল প্রভৃতি।

মূল্যায়নের বিভিন্ন কৌশল : ধারাবাহিক মূল্যায়নে যে কৌশলগুলোর কথা বলা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে- মৌখিক প্রশ্নোত্তর, লিখিত প্রশ্নোত্তর, পর্যবেক্ষণ, প্রকল্প/ব্যবহারিক, একক কাজ, জোড়ায় কাজ ও দলগত কাজ, সাক্ষাৎকার, স্বমূল্যায়ন, সতীর্থ/সহপাঠী কর্তৃক মূল্যায়ন। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ধারাবাহিক মূল্যায়ন শিখন শেখানো কার্যাবলির অংশ। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীর শিখন নিশ্চিত করা।

নিরাময়মূলক ব্যবস্থা : চলমান মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক শিখন ঘাটতি চিহ্নিত করে ফলাবর্তন দেয়ার মাধ্যমে ফলোআপ করতে হবে। কিন্তু ফলোআপের পর যদি শিখন অগ্রগতি সন্তোষজনক না হয় সেক্ষেত্রে নিরাময়মূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। নিরাময়মূলক ব্যবস্থা হচ্ছে- শিক্ষার্থীদের দুর্বলতা দূর করার মাধ্যমে শিখন নিশ্চিত করা। শিক্ষক কর্তৃক নিরাময়মূলক সহায়তা এবং শিক্ষক-সহপাঠী যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নিরাময়মূলক সহায়তা দেয়া। এজন্য শিক্ষকদেরও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App