×

জাতীয়

প্রাণঘাতী রূপে প্রলম্বিত ডেঙ্গু

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০২২, ০৮:৩৪ এএম

প্রাণঘাতী রূপে প্রলম্বিত ডেঙ্গু

ফাইল ছবি

ছড়িয়ে পড়েছে দেশের ৫৬ জেলায় খুলনা ও বরিশাল বিভাগের সব জেলায়ই রোগী

দৈনিক ডেঙ্গুরোগী ও মৃতের সংখ্যা ওঠানামা করলেও সার্বিক চিত্র স্বস্তিদায়ক নয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ডেঙ্গু সংক্রমণের বিস্তার এবং ভয়াবহতা দুই’ই বাড়ছে। চলতি বছরের সর্বোচ্চ সংখ্যক ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে গত ২৪ ঘণ্টায়। প্রথমবারের মতো একদিনে রোগীর সংখ্যা ছাড়িয়েছে সাড়ে ৮’শর ঘর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ৮৫৫ জন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আর এই জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৫ জনের। এর আগে সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগী হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যু হয়েছিল বৃহস্পতিবার। ওই দিন ৮ জনের মৃত্যু এবং হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ৭৬৫ জন। ইতোমধ্যে দেশের ৫৬টি জেলায় ছড়িয়েছে ডেঙ্গুর ব্যাপকতা। ৮ বিভাগের মধ্যে খুলনা ও বরিশাল বিভাগের সব জেলায়ই ডেঙ্গুরোগী শনাক্ত হয়েছে। ঢাকার পর সবচেয়ে রোগী ও মৃত্যু হয়েছে কক্সবাজার জেলায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বছরজুড়েই ডেঙ্গুরোগী শনাক্ত হচ্ছে। সাধারণত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুরোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। তবে এখন মধ্য অক্টোবরেও ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন অনেক হিসাব-নিকাশই বদলে দিয়েছে এবং দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেমন রোগ বালাইয়ের ধরন বদলে যাচ্ছে তেমনি বদলে যাচ্ছে রোগ বালাইয়ের সময়সীমাও।

ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবিরও বলেছিলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগে যেখানে ডেঙ্গু হয়নি সেখানেও ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। হাসপাতালে আসা অধিকাংশ রোগী আগেও এক বা একাধিকবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত দুই দশকেরও বেশি সময় দেশে ডেঙ্গু বড় ধরনের জনস্বাস্থ্য সমস্যা। ২০০০ সালের পর থেকে প্রতি বছর বহু মানুষ এডিস মশাবাহিত এই জ¦রে আক্রান্ত হচ্ছে এবং মারাও যাচ্ছে। কিন্তু সে অনুযায়ী গুরুত্ব পায়নি। বরং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে চলেছে একে অপরের ওপর দায় চাপানোর প্রবণতা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল এক লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ১৭৯। ২০২০ সালে ডেঙ্গুতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন এক হাজার ৩৯২ জন, মারা গিয়েছিলেন ৩ জন। ২০২১ আক্রান্তের সংখ্যা ২৮ হাজার ৪২৯ জন এবং মৃতের সংখ্যা ছিল ১০৫ জন। আর চলতি বছরের অক্টোবরের ১৬ তারিখ সকাল ৮টা পর্যন্ত রোগীর সংখ্যা ২৫ হাজার ১৮১ জন। মৃতের সংখ্যা ৯৪ জন। অধিদপ্তরের মাসভিত্তিক হিসাব অনুযায়ী জানুয়ারি মাসে ১২৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২০ জন, মার্চে ২০ জন, এপ্রিলে ২৩ জন, মে মাসে ১৬৩ জন এবং জুন মাসে ৭৩৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে আর মৃত্যু হয়েছে একজনের। জুলাই মাসে রোগী ছিল এক হাজার ৫৭১ জন আর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ৯ জন। আগস্টে রোগী ছিল ৩ হাজার ৫২১ আর ১১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। সেপ্টেম্বরে রোগী ছিল ৯ হাজার ৯১১ জন, মৃত্যু হয় ৩৪ জনের। আর অক্টোবরের ১৬ দিনে রোগীর সংখ্যা ৯ হাজার ৮৯ জন আর ৩৯ জনের মৃত্যু হয়। তবে বাস্তবে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর চেয়ে অনেক বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় বলে বলছেন চিকিৎসকরা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ভোরের কাগজকে বলেন, ২০০০ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত একটি ধারাবাহিকতা দেখা যাচ্ছে, প্রতি বছরই আগস্ট ও সেপ্টেম্বর এই দুটি মাসের ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা বেশি থাকে। এবং এই দুটির একটি মাসে ডেঙ্গুর সংক্রমণ চূড়ায় উঠে। এ বছর অনেক বৃষ্টি না হলেও থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। যা এডিস মশার বংশবিস্তারের জন্য অনুকূল। এডিস মশা নির্মূলে দুই সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ নিয়ে অনেকটাই হতাশ এই কীটতত্ত্ববিদ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বছরের শুরু থেকেই এ ধরনের পরিস্থিতি হতে পারে সেই শঙ্কার কথা জানিয়েছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, এমন পরিস্থিতিতে কী করা যায়- এই বিষয়টি জানতে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি বারের জন্যও বসলেন না সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। তারা অন্তত একটি ফরমাল মিটিং ডাকতে পারতেন। আমরা পত্রিকা, টিভিতে বলেই যাচ্ছি কিন্তু কাজ তো হচ্ছে না।

প্রতিরোধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি একটি কথা বারবার বলছি। হটস্পট ম্যানেজমেন্ট। হটস্পট ধরে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, কারো বাসায় যদি একজন ডেঙ্গুরোগী থাকে। সেই বাসার ৫’শ মিটারের মধ্যে যদি কোনো উড়ন্ত এডিস মশা বাঁচিয়ে না রাখা হয় তাহলে ওই রোগী থেকে আর কোনো রোগী আক্রান্ত হবে না। রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক নাজমুল ইসলামও বলছেন, মশা নিধন না করতে পারলে ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব নয়।

হাসপাতালে ডেঙ্গুরোগী ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. শেখ দাউদ আদনান ভোরের কাগজকে বলেন, ডেঙ্গুরোগী ব্যবস্থাপনায় আমাদের যে গাইডলাইন তা মেনেই বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নির্দেশনার বাইরে গিয়ে চিকিৎসা দিলে (বাড়তি পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধ) এতে রোগীর ক্ষতি হোক বা না হোক এমন তথ্য আমাদের কাছে এলে আমরা ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। ডেঙ্গুতে যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ নির্ণয় করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে অঞ্চলভিত্তিক ম্যাপিংসহ বিভিন্ন কর্মসূচি নিতে সহজ হবে। এছাড়া বিভিন্ন হাসপাতাল ডেঙ্গুরোগীদের জন্য আলাদা ইউনিটও করছে।

এদিকে বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নানা পদক্ষেপ নিয়ে মাঠে নামলেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা নিয়েও। তবে এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী দাবি করেন ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তারা কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, এডিস মশা ধ্বংস করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আমরা নিয়মিতই মিটিং করছি। মন্ত্রণালয় থেকে যে তদারকি কমিটি করা হয়েছে তারাও মাঠে আছে। ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা বাড়লেও তা এখনো নিয়ন্ত্রণে আছে বলেই মনে করেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App