×

সারাদেশ

বরিশালের আমড়া যাচ্ছে ইউরোপে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০২২, ০৩:৫৫ পিএম

বরিশালের আমড়া যাচ্ছে ইউরোপে

ছবি: ভোরের কাগজ

বরিশালের আমড়ার খ্যাতি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এখন বিশ্বজুড়ে। দক্ষিণাঞ্চলের মাটি ও পানি আমড়া চাষের জন্য বেশ উপযোগী। বিশেষ করে বরিশালের ঝালকাঠি-পিরোজপুরে সুস্বাদু আমড়ার ফলন হয় সবচেয়ে বেশি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, সারাদেশের আমড়ার চাহিদার ৬০-৭০ ভাগ মেটায় এ অঞ্চলের চাষিরা। গত কয়েক বছরে বাম্পার ফলনও হয়েছে। সুস্বাদু আর সুখ্যাতির কারণে কৃষকরা দামও পেয়েছেন বেশ। ভালো টাকা আয়ের সুযোগ থাকায় বরিশাল বিভাগে আমড়া চাষির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে পিরোজপুরের আমড়া একটি অর্থকরী ফল হিসেবে জায়গা করে নিয়েছেন। এটি চাষ করে জেলার বিভিন্ন উপজেলার চাষিরা বেশ ভালো আয় করছেন। এমনকি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে সারাদেশসহ বর্তমানে ইউরোপে যাচ্ছে। জেলার বিভিন্ন উপজেলার স্থানীয় বাজারে পাইকারদের মাধ্যমে এসব আমড়া বিক্রি করে বাগানের মালিকরা কোটি কোটি টাকা আয় করছেন। তবে মধ্যস্বত্বভোগীদের অধিক মুনাফার কারণে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন আমড়া চাষিরা।

আমড়া বাঙালির অতি প্রিয় একটি ফলের নাম। দক্ষিণাঞ্চলের আমড়ায় টক-মিষ্টির মিশ্রণে ভিন্ন এক স্বাদ পাওয়া যায়। কচি অবস্থায় টক। পরিপক্ব হলে খেতে বেশ লাগে। পাকা ফলের গন্ধ চমৎকার। পাকা ফল খুবই মিষ্টি। আমড়ার বেশির ভাগ কাঁচা খাওয়া হলেও ভর্তা, আচার, চাটনি আর পরিপক্ব ফল দিয়ে তৈরি করা যায় জুস, জেলি এবং মোরব্বার মতো লোভনীয় খাবার। গ্রামাঞ্চলের কেউ কেউ গোশতের সঙ্গে আমড়া রান্না করে খান। ডালের সঙ্গেও খাওয়া যায়। আমড়ার শাঁস সাদা। পাকলে হলুদ রং ধারণ করে। যে কারণে একে গোল্ডেন আপেল বলে।

দক্ষিণাঞ্চলের মাটি ও পানির জন্য এর ফলন ও গুণগতমান অনেক ভালো। বিভাগের পিরোজপুরের স্বরূপকাঠিকে (নেছারাবাদ) আমড়ার রাজধানী বলা হয়। কারণ ওখানকার ফলন সবচেয়ে বেশি। ঝালকাঠি, বরিশাল, ভোলা এবং বরগুনায়ও আমড়ার ভালো ফলন হয়। এছাড়া দিন দিন আমড়ার উৎপাদন বৃদ্ধি ও উচ্চমূল্য পাওয়ায় এ অঞ্চলের অনেক মানুষই আমড়া চাষের দিকে ঝুঁঁকছেন।

এ ব্যাপারে পিরোজপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবু হেনা মো. জাফর ভোরের কাগজকে জানান, চলতি মৌসুমে গত ২/৩ বছরের তুলনায় আমড়ার ফলন অনেক ভালো হয়েছে। কৃষকরা তাদের চাহিদা মতো দামও পাচ্ছেন। জেলার কাউখালী, নাজিরপুর ও নেছারাবাদে এর চাষ বেশি হয়েছে। প্রায় সব বাড়িতেই অন্তত ২/৩টি করে আমড়া গাছ আছে। এসব এলাকার রাস্তার পাশে, বাড়ির আঙিনায় আমড়া গাছ লাগানো প্রতিটি মানুষের নেশায় পরিণত হয়েছে।

এ এলাকার মাটি ও আবহাওয়া আমড়া চাষের জন্য খুবই উপযোগী। লাভজনক এ মৌসুমি ফল আমড়া গাছে রোগবালাই খুবই কম। আমড়া গাছ রোপণের দুই বছর পরই তা ফল দেয় এবং কমপক্ষে ১০/১২ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। তিনি আরো জানান, পিরোজপুর তথা বরিশালের আমড়া এখন দেশের ঐতিহ্য। দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন ভারত, মালয়েশিয়া, নেপাল, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে তা পাঠানো হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যেও যাচ্ছে নিয়মিত। জানা গেছে, আমড়া কেনাবেচার জন্য রয়েছেন একাধিক ব্যাপারী। তারা চৈত্র-বৈশাখ মাসে গৃহস্থদের অগ্রিম টাকা দিয়ে আমড়ার গাছ কিনেন। ওই ক্রেতারা স্থানীয় পাইকারদের কাছে এসব আমড়া বিক্রি করেন। পাইকাররা তা বস্তাবন্দি করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠান। এসব পাইকারকে স্থানীয় ভাষায় মহাজন বলে। মহাজনরা গ্রাম থেকে গৃহস্থদের কাছ থেকে আমড়া কেনার জন্য স্থানীয় ক্রেতাদের অগ্রিম টাকা দিয়ে থাকেন। একে স্থানীয় ভাষায় দাদন বলে। শ্রাবণ থেকে কার্তিক- ৪ মাস পর্যন্ত স্থানীয় ব্যাপারীরা গৃহস্থদের কাছ থেকে আমড়া কিনেন। আবার কেউ কেউ গৃহস্থদের কাছ থেকে কেনা গাছ থেকে এ সময়ে পর্যায়ক্রমে আমড়া সংগ্রহ করেন। তারপর সেগুলো বস্তা হিসেবে ব্যাপারীরা জেলার সবচেয়ে বড় আমড়ার মোকাম কাউখালীতে নিয়ে বিক্রি করেন।

এরপর সেখান থেকে লঞ্চে করে ঢাকা, চাঁদপুর, মুন্সীগঞ্জ, চট্টগ্রাম, রংপুর, সিলেট, যশোরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। গৃহস্থদের কাছ থেকে এক বস্তা আমড়া ৮০০-৯০০ টাকায় কিনে তা জেলার বাজারে প্রায় ১৪০০-১৫০০ টাকায় বিক্রি করছেন ব্যাপারীরা। আর সেই আমড়া ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার বাজারে পাইকারি প্রতিবস্তা ২২০০-২৫০০ টাকায় বিক্রি হয়। তবে মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে মুনাফা বঞ্চিত হচ্ছেন আমড়া চাষিরা।

এ ব্যাপারে নাজিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দ্বিগ বিজয় হালদার ভোরের কাগজকে জানান, এখানে (নাজিরপুর) প্রায় ৭৫ হেক্টর জমিতে আমড়া চাষ হয়। চাষিরা গত ২/৩ বছরের তুলনায় এবার আমড়ার দাম ভালো পেয়েছেন। এ উপজেলার কলারদোয়ানিয়া, দেউলবাড়ি ও মালিখালী ইউনিয়নে আমড়ার চাষ বেশি হচ্ছে। এসব এলাকা নিচু হওয়া সত্ত্বেও চাষিরা তাদের পতিত জমিতে কান্দি কেটে মাটি উঁচু করে আমড়ার চাষ করেছেন। গাছ রোপণের দুবছর পরই তা ফল দেয় এবং কমপক্ষে ১০/১২ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। তবে এসব গাছ একটু বেশি বয়স হলে পোকা ধরে। শতাংশপ্রতি ৩-৪টি গাছ লাগালে এর ফলন বেশ ভালো হয়। গত ২/৩ বছর ধানের দাম কম পাওয়ায় এলাকার কৃষকরা আমড়া চাষের দিকে ঝুঁকছেন।

নাজিরপুরের আমড়া চাষি আছাদুজ্জামান শিকদার বলেন, ধানের দাম কম পাওয়ায় আমড়া চাষের দিকে ঝুঁঁকছি। আমড়া চাষ সহজ ও লাভজনক। এবছর প্রায় দুই একর জমিতে লাগানো আমড়া গাছ থেকে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা পেয়েছি। কিন্তু সমপরিমাণ জমিতে ধানচাষ করলে মাত্র ২০-৩০ হাজার টাকার বেশি পেতাম না। তিনি আরো বলেন, আমড়া গাছের বয়স একটু বেশি হলে তাতে পোকায় ধরলে স্থানীয় উপজেলা কৃষি অফিসের পরামর্শে প্রতিকার করা সম্ভব। তাছাড়া কিছু গাছে বৈশাখের শুরুতে নতুন গজানো পাতায় লেদাপোকা আক্রমণ করে। এ সময় বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক ছিটালে তা দূর হয়। ঝালকাঠি জেলার আমড়া মোকামের ব্যবসায়ী কবির হোসেন বলেন, এ মোকাম থেকে বছরের শ্রাবণ থেকে কার্তিক এই চারমাস দেশের বিভিন্ন স্থানে কোটি কোটি টাকার আমড়ার চালান যায়।

বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ভালো ফলনের জন্য আমড়ার উচ্চ ফলনশীল জাত রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত বারি আমড়া-১ এবং বারি আমড়া-২ রয়েছে। বারি আমড়া-১ বারোমাসি। গাছ বামনাকৃতির হয়। তাই বাড়ির ছাদেও লাগানো যায়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় একটি জাত উদ্ভাবন করেছে। নাম এফটিআইপি বাউ আমড়া-১। বরিশাল কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. ফজলুল হক জানান, যেহেতু আমড়া এখন উচ্চমূল্যের একটি ফসল তাই অধিদপ্তরের মাঠকর্মীদের মাধ্যমে চাষিদের পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদেরও আমড়া চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আমড়া পুষ্টিগুণে টইটম্বুর। এতে ভিটামিন সি’র পাশাপাশি রয়েছে প্রচুর পরিমাণ লৌহ। আমড়ায় আছে যথেষ্ট ভেষজ গুণও। কফ ও পিত্ত নিবারণের পাশাপাশি মুখে রুচি আনা এবং কণ্ঠস্বর পরিষ্কারে এর ভূমিকা রয়েছে। জ্বর, সর্দি, কাশি, এমনকি ইনফ্লুয়েঞ্জার জীবাণুকে প্রতিরোধ করে। দাঁতের মাড়ি শক্ত রাখে। দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত ও পুঁজ পড়া বন্ধ করে। স্ট্রোক এবং হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণ করে। পেকটিন জাতীয় আঁশ থাকায় বদহজম, পেট ফাঁপা, কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণে সহায়তা করে। মুখের রুচি বাড়ায়। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় আমড়া ক্যান্সার প্রতিরোধক। ভাইরাল ইনফেকশনের বিরুদ্ধে কাজ করে। রক্ত আমাশয় হলে আধা কাপ পানিতে ৩-৪ গ্রাম আমড়ার কষ, সেই সঙ্গে ১ চা চামচ গাছের রস এবং একটু চিনি মিশিয়ে খেতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App