×

জাতীয়

অ্যান্টিবায়োটিক এখন মৃত্যুদূত!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০২২, ১০:১১ এএম

অ্যান্টিবায়োটিক এখন মৃত্যুদূত!

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিইউতে মারা যাওয়া রোগীদের ৮০ শতাংশের মৃত্যুর কারণ হলো সুপারবাগ

প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি বন্ধ করার তাগিদ

বিশ্বে অন্যান্য মহামারির ক্ষয়ক্ষতি দৃশ্যমান। তবে ‘সুপারবাগ সংক্রমণ’ মহামারি অনেকটা নীরবেই ছড়িয়ে পড়ছে এবং এর ভয়াবহতা ব্যাপক। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে আগে থেকেই সতর্ক করে আসছিলেন। অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী এই সুপারবাগ ২০১৯ সালে ১২ লাখ ৭০ হাজার মানুষের জীবন কেড়ে নেয় বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। ভারতে এই সুপারবাগ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করছেন দেশটির চিকিৎসকরা। অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার ও ভুল ডোজের কারণে জীবাণু যেভাবে ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠছে তাতে যে কোনো সময় বড় ধরনের স্বাস্থ্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। এতে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বা সুপারবাগ আবির্ভাবের শঙ্কাও করছেন তারা।

দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক তথ্যউপাত্ত বলছে, এই শঙ্কার যৌক্তিক কারণও আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বর্তমানে যে হারে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয় যার অর্ধেকের বেশি অপ্রয়োজনীয়। চলতি বছরের মে মাসে দেশের অ্যান্টিবায়োটিক পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে জানানো হয়, দেশে বহুল ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকের ৬৭ শতাংশই অকার্যকর। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর পরিচালিত এক জরিপের বরাত দিয়ে ওই অনুষ্ঠানে জানানো হয়, দেশে অন্যতম একটি সমস্যা হচ্ছে, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে সেবনের প্রবণতা। ৬৭ দশমিক ৩ শতাংশ ফার্মেসির কর্মীরাই অ্যান্টিবায়োটিক সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন না। এছাড়া তারা সহজে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ চিনতেও পারেন না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে এই হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) মোট ৯০০ রোগী ভর্তি হয়েছিল। যাদের মধ্যে ৪০০ জন মারা যায়। এদের প্রায় ৮০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে তাদের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী

ব্যাকটেরিয়া ছিল। এমন পরিস্থিতি শঙ্কারই বটে। মেডিকেল জার্নাল ‘ল্যানসেট’ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুপারবাগে মারা যাওয়াদের শরীরে সংক্রমণ রোধে সবচেয়ে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হলেও তা কাজে আসেনি।

প্রসঙ্গত, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স নিয়ে দেশে বিশ্বব্যাংক ও সিডিসির অর্থায়নে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) একটি সার্ভিলেন্স করত। ২০১৬ সাল থেকে ১৮ সাল পর্যন্ত এই সার্ভিলেন্স হয়েছিল। কিন্তু এরপর দাতা সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হলো এ নিয়ে তারা আর কোনো অর্থায়ন করবে না। সরকারি উদ্যোগে করতে হবে। এরপরই থেমে যায় সার্ভিলেন্সের কাজ।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, অনেক চিকিৎসক কোনো বাছবিচার না করেই রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে থাকেন। ফ্লু বা সাধারণ সর্দিজ্বর, ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়ার মতো ভাইরাসজনিত রোগ, এমনকি ডায়রিয়ার চিকিৎসায়ও অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয়। অথচ এসব রোগ নিরাময়ে অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো কার্যকারিতাই নেই। কোভিড-১৯ মহামারির সময়ও বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে অনেকে আক্রান্তদের অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা দিয়েছেন। যা পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করে দিয়েছে।

অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। ২০২০ সালের নভেম্বরে ভার্চুয়ালি বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম ‘ওয়ান হেলথ গ্লোবাল লিডার্স গ্রুপ অন অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স’-এর যাত্রা শুরুর অনুষ্ঠানে কো-চেয়ারের বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধে বিশ্বকে সম্মিলিতভাবে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স মানুষ ও প্রাণী উভয়ের জন্য এক বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আর অপরিণামদর্শী খাদ্য উৎপাদন আমাদের বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের সংখ্যা কমে আসছে এবং যাতে বিশ্ব আরেক নতুন সংকটে পড়তে পারে। নতুন অ্যান্টিবায়োটিক যেন সবার সামর্থ্যরে মধ্যে থাকে তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।

বিএসএমএমইউর ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, আইসিইউতে যেসব রোগী মারা যাচ্ছেন, তারা এমনিতেই জটিল রোগী। তাদের শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল থাকে, তাদের আরো অনেক সমস্যা থাকতে পারে। কিন্তু আমরা এটাও দেখেছি, তাদের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশের শরীরে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেসিস্ট্যান্স সুপারবাগ পাওয়া গেছে।

আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, শুধু আমাদের দেশে নয় বিশ্বজুড়ে আগামীতে ওষুধ প্রতিরোধী জীবাণু দ্বারা মহামারি হবে। আমাদের দেশেও এই সুপারবাগ দ্রুত গতিতেই ছড়াচ্ছে। আমরা যে হারে অ্যান্টিবায়োটিক খাচ্ছি, চিকিৎসকরাও অ্যান্টিবায়োটিক, স্টেরয়েড এবং অ্যান্টিভাইরাল দিচ্ছে। এতে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন জীবাণু তৈরি হচ্ছে। এর ফলশ্রæতিতে অধিকাংশ অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়েছে। রিজার্ভ একটি অ্যান্টিবায়োটিক করোনা মহামারির সময় হাসপাতালগুলোতে দেদার ব্যবহার হয়েছে। এখন নতুন অ্যান্টিবায়োটিক মজুতও নেই। আমাদের প্রয়োজন ওয়ান হেলথ এপ্রোচ। মানব স্বাস্থ্য, প্রাণীর স্বাস্থ্য ও প্রকৃতি এই ৩টি বিষয়কে সমান গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা যেসব প্রাণীর মাংস বা শাকসবজি খাই – সেইসব প্রাণীর শরীরে বা সবজির উৎপাদনে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে। খাদ্যের মাধ্যমে আমাদের শরীরে ঢুকে যাচ্ছে। মাছ, মাংস, শাকসবজি ও ফলের মধ্য দিয়ে আমাদের শরীরে ঢুকে যাচ্ছে। এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়া হাসপাতালের আইসিইউতে অক্সিজেনসহ যে নল ব্যবহার করা হয় সেগুলোর মধ্য দিয়েও জীবাণুতে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি আছে। হয়তো নাকের কাছের নলগুলো পরিবর্তন করা হয় কিন্তু মূল পাইপ বা অনান্য পাইপ বা নলগুলো পরিবর্তন করা হয় না। ফলে ঝুঁকি থাকছেই।

সমাধান কোন পথে- এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রথমত প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি বন্ধ করা দরকার। পশুসম্পদে, বিশেষ করে মুরগিতে মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার বন্ধ করা। হাসপাতালগুলোতে সরকারের নজরদারি বা টিম করে দিতে হবে, যাতে সেখানে সংক্রমণ রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগুলো নিশ্চিত করা।

অ্যান্টিবায়োটিকের অপপ্রয়োগ রোধে সরকারও নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। চলতি মাসের শুরুর দিকে এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, সহজে শনাক্তের জন্য অ্যান্টিবায়োটিকের মোড়ক হবে লাল রঙের। একই সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার রোধে আইন হচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ন্ত্রণে সচেতনতার পাশাপাশি তদারকিও বাড়াতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App