×

খেলা

চার জায়গায় বাংলাদেশের ঘাটতি দৃশ্যমান হলো

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০২২, ১২:১৬ এএম

চার জায়গায় বাংলাদেশের ঘাটতি দৃশ্যমান হলো

বোলার হাসান মাহমুদ কিছু ঝলক দেখিয়েছেন

পাকিস্তানের বিপক্ষে আজকের ম্যাচে পরাজয় বরণ করার মধ্য দিয়ে নিউজিল্যান্ডে হওয়া ত্রিদেশীয় টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট সিরিজের চারটি ম্যাচেই হারলো বাংলাদেশ।

ক্রাইস্টচার্চের ওই ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বাধীন দল ৭ উইকেটে হেরেছে। খবর-বিবিসির।

চলতি বছর বাংলাদেশ শক্তিশালী-দুর্বল সব রকমের দলের বিপক্ষে খেলেছে, কিন্তু র‍্যাংকিংয়ের নিজেদের ওপরের সারির কোনও দলের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে কোনও জয় পায়নি।

অস্ট্রেলিয়ায় এ মাসেই শুরু হচ্ছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, আর বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি স্কোয়াড ওই বিশ্ব আসরের মূল মঞ্চে খেলার আগে শেষ ম্যাচটি আজ খেলে ফেললো।

ক্রাইস্টচার্চে আজ বাংলাদেশ শুরুতে ব্যাট করে ১৭৩ রান তুলতে পেরেছিল, তবে পাকিস্তান বেশ সহজেই ওই চ্যালেঞ্জের জবাব দেয়। এক বল আর সাত উইকেট হাতে রেখেই জয় তুলে নেয় বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ।

চলতি ২০২২ সালে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ১৫টি টি টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছে, আর এর মধ্যে ১১টি ম্যাচেই হেরেছে দলটি।

সবচেয়ে খারাপ খবর হলো, যে চারটি ম্যাচে বাংলাদেশ ২০২২ সালে জিতেছে, সেই জয়গুলো বাংলাদেশের করুণ অবস্থাকেই কেবল তুলে ধরছে। চলতি বছর বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত একটি করে ম্যাচ জিতেছে আফগানিস্তান ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, আর সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে জিতেছে দুটি ম্যাচ।

বাকী সব ম্যাচে বাংলাদেশ কেবল হেরেছে তাই নয়, কোন কোন ম্যাচে হেরেছে বেশ বড় ব্যবধানে।

তাই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে দলের সঠিক কম্বিনেশন কী হবে, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারা ম্যাচ জেতাতে পারবেন, কিংবা কোন ১১ জন মাঠে নামলে জেতার মতো ফলাফল পাওয়া যাবে, এসব প্রশ্ন এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে বাংলাদেশের সামনে।

কিন্তু দলটি এতো খারাপ কেন করছে, তা বিশ্লেষন করে পাওয়া যাচ্ছে বেশ কিছু কারণ।

ডেথ ওভারের বোলার

একটা সময় এমন মনে করা হতো যে শেষের ওভারগুলোতে বল করার যে চ্যালেঞ্জ, তা উত্তর হলো মুস্তাফিজুর রহমান - এবং তিনিই তার জাদু দিয়ে যে কোনও ম্যাচের পরিস্থিতি বাংলাদেশের পক্ষে আনতে পারবেন। কিন্তু সেই মুস্তাফিজুর রহমানকে এখন আর মাঠে পাওয়া যায় না।

মুস্তাফিজ গত এক বছরে ১৫টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ৪০ গড়ে বল করেছেন।

বাংলাদেশের আর কোনও বোলারের গড় এর চেয়ে খারাপ ছিল না এই সময়ে।

নিউজিল্যান্ড ও পাকিস্তানকে নিয়ে অনুষ্ঠিত চলমান ত্রিদেশীয় সিরিজে ক্রাইস্টচার্চের প্রথম ম্যাচে খেলে মুস্তাফিজ ৪ ওভার বল করে ৪৮ রান দিয়েছিলেন।

স্বাভাবিকভাবেই তিনি বাদ পড়েছেন। কিন্তু সমস্যা হলো, যারা তার জায়গায় এসেছেন, তারাও ভালো করতে পারছেন না।

যেমন মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন। অগাস্টে হওয়া এশিয়া কাপের বাংলাদেশ টিমে সুযোগ পাওয়ার আগে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সর্বশেষ খেলেছিলেন।

গত বছরে হওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূল পর্বের প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একটি ওভারে ২২ রান দিয়েছিলেন তিনি, আর তার ফলে ওই ম্যাচে বাংলাদেশের জয়ের সম্ভাবনা কার্যত শেষ হয়ে গিয়েছিল।

এরপর তিনি বাংলাদেশের হয়ে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ফেরেন ২০২২ সালের এশিয়া কাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে। ওই ম্যাচেও লো-স্কোরিং টার্গেট ডিফেন্ড করার সময় সাইফুদ্দিন একটি ওভারে ২২ রান দেন। এরপর বাংলাদেশ আর ম্যাচে ফিরতে পারেনি।

ক্রাইস্টচার্চে আজও সাইফুদ্দিন ইনিংসের মাঝের একটি ওভারে নো বল, ওয়াইড বল-সহ মোট ১৯ রান দিয়েছেন।

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অনেক সময় উইকেট নেয়ার চেয়ে কম রান দেয়া গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। কীভাবে আরও বেশি ডট বল দেয়ার মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে কম রান দেয়া যায়, সেটি নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্টকে নতুন করে ভাবতে হবে।

গতকালই একটি সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের কোচ অ্যালান ডোনাল্ড বলছিলেন যে ত্রিদেশীয় সিরিজটি বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু ব্যাপার ঝালিয়ে দেখার ভালো একটি ক্ষেত্র, আর সেখানে এমন বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছে দল।

অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও নিজের বোলিং নিয়ে সন্তুষ্ট নন।

আজকের ম্যাচ শেষে তিনি বলেছেন, দিনের শুরুতে যদি কেউ বলতো ১৭০ রান ডিফেন্ড করতে হবে, তাহলে খুশি মনেই বল করতাম। কিন্তু আমার বোলিং ভালো হয়নি, এটা নিয়ে কাজ করতে হবে।

ওপেনিং জুটি নিয়ে সংশয়

ত্রিদেশীয় এই সিরিজে বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি ওপেনিং জুটি মাঠে নামিয়েছিল, কিন্তু এখনও ঠিক প্রত্যাশামতো শুরুটা পায়নি।

নাজমুল হোসেন শান্ত এবং সৌম্য সরকার - দুয়েকটা ম্যাচে ভালো শুরু করলেও নিজেদের ইনিংস ঠিকমতো টেনে নিয়ে যেতে পারেননি।

সৌম্য দীর্ঘদিন পর জাতীয় দলে ফিরেছেন।

লিটন দাস সাধারণত বাংলাদেশের হয়ে ওপেন করলেও এবারে তাকে তিন নম্বরে নামানো হয়েছে, যে পজিশনে নিয়মিত খেলেন সাকিব আল হাসান।

এই একটা জায়গায় বাংলাদেশের পরিকল্পনা কাজে লেগেছে বলা যায় - লিটন দাস ও সাকিব দু'জনই ত্রিদেশীয় সিরিজে ভালো ব্যাট করেছেন।

সাকিব ৩ ম্যাচে ৫১ গড় ও ১৫১ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করেছেন। লিটন দাসও ১৪০ এর ওপর স্ট্রাইক রেট বজায় রেখেছেন এই সিরিজে।

কিন্তু টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে একটা ভালো ওপেনিং জুটি না হলে পাওয়ারপ্লে ঠিকমতো কাজে লাগানো কঠিন হয়ে যায় বলে মনে করেন বাংলাদেশের ঘরোয়া লিগের ক্রিকেটার ও ক্রিকেট বিশ্লেষক সৈয়দ আবিদ হুসেইন সামি।

উদাহরণ হিসেবে আসে নাজমুল হোসেন শান্ত'র কথা। বাংলাদেশের এই ওপেনারের ব্যাট হাতে ব্যর্থতা ছিল চোখে পড়ার মতো।

আজকের ম্যাচেও শান্ত তার ইনিংসে শুরুর ৯ বলে রান করেছিলেন এক রান - শেষ পর্যন্ত ১৫ বল খেলে ১২ রান করে আউট হয়েছেন তিনি।

আবিদ হুসেইন মনে করেন, শান্তর নেটে এবং মাঠের পারফরমেন্স একদম আলাদা।

তিনি বলেন, অনুশীলনে বাংলাদেশের কোচদের প্রিয়পাত্রদের একজন শান্ত। খুবই ভালো সেশন কাটান তিনি। কিন্তু মাঠে সেটার বাস্তবায়ন এখনও পর্যন্ত হয়নি। তাই নেট সেশন দেখে তাকে নিয়ে আশাবাদী হলেও টিম ম্যানেজমেন্ট মাঠে তার আশানুরূপ ফল দেখতে পাচ্ছেন না।

পাকিস্তানের বিপক্ষে আজকের ম্যাচে প্রথম ওভারে কোনও রানই করতে পারেননি নাজমুল হোসেন শান্ত। আর এটি সবারই জানা যে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে একটা মেইডেন ওভার ম্যাচের ফলাফলে বড় প্রভাব ফেলতে পারে।

ইয়াসির, আফিফ, মোসাদ্দেক - হুট করেই অফ ফর্মে

চলতি বছরে টি-টোয়েন্টি ম্যাচগুলোতে বাংলাদেশের খারাপ পারফরমেন্স নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে - এবং এক্ষেত্রে সবার আগে চোখে লাগে বাংলাদেশের টপ অর্ডারের ব্যর্থতা।

তবে এখন উদ্বেগ তৈরি হয়েছে লোয়ার মিডল অর্ডার নিয়েও। এসব পজিশনে কখনো আফিফ হোসেন বা মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত কিছু ভালো ইনিংস খেলে দলকে মোটামুটি অবস্থানে নিয়ে যেতেন।

কিন্তু নিউজিল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজে একমাত্র ইয়াসির আলীর ২১ বলে ৪২ রানের একটি ইনিংস বাদে লোয়ার অর্ডার থেকে তেমন ভূমিকা দেখা যায়নি।

আফিফ ১০১ স্ট্রাইক রেটে চার ম্যাচে ৬৪ রান করেছেন। আর নুরুল হাসান সোহান করেছেন ৪ ম্যাচে ৩৭ রান।

অন্যদিকে, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত ৩ ম্যাচে মাঠে নেমে মাত্র ১১ রান করেছেন।

আজও যেমন বাংলাদেশ শেষ দশ বলে মাত্র সাত রান তুলতে সক্ষম হয়েছে।

ফিল্ডিং বরাবরই বাংলাদেশের দুশ্চিন্তার কারণ

ফিল্ডিংয়ের দূর্বলতা কাটাতেই পারছে না বাংলাদেশ। আপাত সহজ কয়েকটি ফিল্ডিং মিস হয়েছে আজও বাউন্ডারি লাইনে, যা ম্যাচের সমীকরণে পাকিস্তানের জয়ের পথ সুগম করে দিয়েছে।

বাবর আজম যখন ব্যাট করছিলেন, সাইফুদ্দিন বাউন্ডারি লাইনে সহজ একটা ক্যাচ ছেড়েছেন।

এই সিরিজে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট দল এই একটা জায়গায় তাক লাগিয়ে দিয়েছে। প্রায় প্রতি ম্যাচেই বাউন্ডারি লাইনে বেশ কিছু রান তারা বাঁচিয়েছে।

আজকের ম্যাচে ফিল্ডিংয়ে ভালো করার বাড়তি তাড়না দেখা যায়নি বাংলাদেশের ফিল্ডারদের মধ্যে - কিছুটা সময় মোহাম্মদ রিজওয়ান ও মোহাম্মদ নাওয়াজ সহজেই ত্রিশ গজের বাইরে বল ঠেলে দিয়ে দৌঁড়ে দুই রান নিয়েছেন।

জয় ছাড়াই বিশ্বকাপে যাত্রা

ত্রিদেশীয় সিরিজ বাংলাদেশের জন্য ছিল আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর একটি ক্ষেত্র, কিন্তু সেই মিশনে দল কতটা সফল তা হয়তো ফলাফলই বলে দিচ্ছে।

একে একে চারটি ম্যাচ হারার পর আর যাই হোক কোন দলের আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে না।

ক্রিকেট বিশ্লেষক তৌসিয়া ইসলাম বলেন, এই টুর্নামেন্টে অন্তত একটা ম্যাচে জয় বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল।

সেই প্রত্যাশিত জয় আসেনি। তবে তৌসিয়া ইসলামের মতে এটা শাপে বর হতেও পারে।

তিনি বলেন, ২০২১ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আমরা দেখেছি, বাংলাদেশে নিজেদের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে একটা মিথ্যা আত্মবিশ্বাস নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে গিয়েছিল।

গত বিশ্বকাপে বাংলাদেশের করুন অবস্থার কথা স্মরণ করছিলেন তিনি। ওই টুর্নামেন্টের মূল পর্বে বাংলাদেশ সবগুলো ম্যাচ হেরে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছিল।

নিজের কথার পক্ষে যুক্তি দিয়ে তৌসিয়া ইসলাম বলেন, সেই অবস্থা থেকে অন্তত বাংলাদেশ বেড়িয়ে আসতে পারবে (ত্রিদেশীয় সিরিজে ব্যর্থ হওয়ার পর), নিজেদের ঘাটতি সম্পর্কে সচেতন থাকতে পারবে।

‘বাংলাদেশ একটা ভুয়া আত্মবিশ্বাস নিয়ে ঘরের মাটিতে ক্রিকেট খেলেছিল, যেটা এবারে হবে না। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সমস্যাগুলো এখন স্পষ্ট,’ যোগ করেন এই বিশ্লেষক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App