×

জাতীয়

আকস্মিক বন্ধ নিয়ে নানা প্রশ্ন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২২, ০৮:৩৬ এএম

আকস্মিক বন্ধ নিয়ে নানা প্রশ্ন

ছবি: ভোরের কাগজ

জাতীয় সংসদের গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনের ভোটগ্রহণ বন্ধের আকস্মিক ঘোষণায় নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সক্ষমতা ও ক্ষমতা নিয়েও। রাজনৈতিক দলগুলোর অসহিষ্ণু মনোভাব, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষপাতিত্ব এবং নির্বাচনী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন নিয়ে ইসির প্রস্তুতি- বিশেষত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আগেই মতবিনিময়ের মাধ্যমে ভোটকেন্দ্রের অনিয়ম প্রতিহতের ব্যবস্থা করতে পারেনি ইসি। এর ফলে ভোটগ্রহণের মাঝপথে নির্বাচন বন্ধ করতে হয়েছে। এটি ইসির দুর্বলতাও হতে পারে। মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এই নির্বাচন বন্ধের নেপথ্যে দীর্ঘমেয়াদি ষড়যন্ত্র দেখছে। তবে কেউ কেউ বলছেন, ভোটকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় নির্বাচন কমিশন ভোট বন্ধের সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মাধ্যমে স্বাধীন সংস্থাটি আগামীতে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে তাদের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে।

প্রয়াত ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়ার গাইবান্ধা-৫ আসনে উপনির্বাচনের ভোটগ্রহণ ছিল গতকাল বুধবার। ভোটগ্রহণের সময় সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা। শুরু থেকেই রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবন থেকে সিসিটিভির ফুটেজ অনলাইনে প্রত্যক্ষ করছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য কমিশনাররা। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে নির্বাচন কমিশনের পদস্থ কর্মকর্তারা সিইসিকে অনেক কেন্দ্রে সিসিটিভি ক্যামেরার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার কথা জানান। এর ফলে জাতীয় পার্টিসহ অন্য ৪ প্রার্থী একসঙ্গে ভোট বয়কটের ঘোষণা দেন।

ভোটগ্রহণ চলাকালে অর্ধেকেরও বেশি আসনে একটি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী কর্তৃক বুথ দখল, ইভিএম ওপেন করে জোর করে ভোট দেয়ার জন্য প্রিজাইডিং অফিসারকে বাধ্য করা, কেন্দ্রের সিসি ক্যামেরা খুলে ফেলা, ইন্টারনেট কানেকশন বন্ধ করা, জোর করে অন্য দলের এজেন্টদের বের করে দেয়া এবং ভোটারদের ভোটদানে বাধা দেয়ার ঘটনা ঘটায় নির্বাচন কমিশন এ উপনির্বাচনটি বন্ধ করতে বাধ্য হয়।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ভোটকেন্দ্রের পরিস্থিতি ‘নিয়ন্ত্রণের বাইরে’ চলে যাওয়ায় গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনের উপনির্বাচনে ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। বেলা সোয়া ২টার দিকে ঢাকায় নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের সামনে এসে তিনি এ ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ায় আমরা পরিশেষে গাইবান্ধা-৫ নির্বাচনী এলাকার ভোট কার্যক্রম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হয়েছে (রিটার্নিং কর্মকর্তাকে)। পরবর্তীতে বিধি-বিধান অনুযায়ী কী করতে হবে, দেখব। কমিশন বসে সিদ্ধান্ত নেবে।

এর আগে দুপুর ১টা নাগাদ নির্বাচন কমিশন প্রথমে ৪৪টি কেন্দ্রের, পরে ৫৪টি কেন্দ্রের এবং বেলা আড়াইটায় সিইসি ভোটগ্রহণ বন্ধ ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, আরপিও ৯১ অনুচ্ছেদের ‘ক’ অনুধারায় বলা হয়েছে, ভোট নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে হতে হবে। কমিশন যদি মনে করে নির্বাচন সঠিকভাবে হচ্ছে না, তাহলে একটি কেন্দ্র বা সব কেন্দ্রে নির্বাচন বন্ধ করার দায়িত্ব কমিশনকে দেয়া হয়েছে। সেই বিধানের আলোকে আমরা এ উপনির্বাচন বন্ধের সিদ্ধান্ত নিচ্ছি।

নির্বাচনে অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, প্রাথমিক পদক্ষেপ নিয়েছি। এ ব্যাপারে পুলিশ, জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছি। ইভিএম নিয়ে অভিযোগ এসেছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইভিএমের কোনো দোষ-ত্রুটি দেখতে পাচ্ছি না। মানবিক আচরণের ত্রæটির কারণে এমনটা হচ্ছে। একই ধরনের প্রতীক দেয়া গেঞ্জি পরে অনেককে ভোট দিতে দেখেছি। তারাই ভোটকেন্দ্রের ডাকাত কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, এরাই ডাকাত। এরাই দুর্বৃত্ত। যারা আইন মানেন না, তাদেরই আমরা ডাকাত বলতে পারি, দুর্বৃত্ত বলতে পারি। নির্বাচন কমিশন এখানে বসে সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে পারবে না।

এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বলেন, নির্বাচন কমিশন নিশ্চয়ই দেখেছেন নির্বাচনে অনিয়ম হচ্ছে, ভোট করার পরিবেশ নেই। এমন পরিবেশ প্রত্যক্ষ করেই ইসি নির্বাচন বন্ধ করেছে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন যখন বিঘ্নিত হচ্ছে তখন নির্বাচন বন্ধ করে দেয়ায় আমি তাদের সাধুবাদ জানাচ্ছি। আর এ নিয়ে যারা নির্বাচনে কারচুপি বা অসহিষ্ণু মনোভাব দেখাতে চায় তাদের ও তাদের সমর্থকদের প্রতি কমিশন একটি সতর্কবার্তা দিয়েছেন। এর মাধ্যমে সিইসি সত্যি সাহসিকতা ও আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ করেছেন।

একটি উপনির্বাচন কেনো ইসির নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইসি তো একা নির্বাচন করে না। আসলে কমিশন, দল, দলগুলোর প্রার্থী-সমর্থক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, নির্বাচনী কর্মী- সবার ওপর নির্ভর করতে হয়। সেখানে যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে প্রতিপালন না করে, প্রার্থী ও সমর্থকরা যদি রাজনৈতিক শিষ্টাচার না মেনে জেতার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে এবং ভোটকর্মীরাও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় তাহলে ভোটগ্রহণ বন্ধ করা ছাড়া ইসির করার কিছু থাকে না।

জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে তিনি বলেন, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের এখনো অনেক সময় রয়েছে। সেখানে ইসি নিশ্চয়ই সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রস্তুতি নেবে। তাদের ক্ষমতার পূর্ণ প্রয়োগ করবে। জাতীয় নির্বাচনে আমরা সেনাবাহিনী ডেকেছিলাম। প্রায় সব নির্বাচনে তারা স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে থাকে। জাতীয় নির্বাচনে ইসি তাদের ব্যবহার করতে পারে। তবে যতদিন দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ও তাদের প্রতিনিধিদের মধ্যে সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কৃতি না আসবে ততদিন দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন করা কঠিন হবে।

আরেক সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহম্মদ শাহনেওয়াজ বলেন, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব সুষ্ঠু নির্বাচন করা। গাইবান্ধার উপনির্বাচনে তাদের কঠোর মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে। আর এর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল বা যারা নির্বাচনে কারচুপি ও পেশী প্রদর্শন করছিল তাদের প্রতি একটা কঠোর বার্তাও দিয়েছে হাবিবুল আউয়াল কমিশন। এজন্য তারা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।

সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এ নির্বাচনটা বন্ধ করে ইসি যে নিরপেক্ষ তা প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। তারা চাইছে, সুষ্ঠু নির্বাচন। কিন্তু কিছু বিতর্কিত কথাবার্তা, ইভিএমে ভোট করা নিয়ে তারা বিতর্কিত হয়েছে। তারা নানা ধরনের মন্তব্য করে দল ও জনগণের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। তবে গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচন বন্ধ করে তারা দেখাল- তাদের সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হবে। কোনো ধরনের বিতর্কিত নির্বাচন তারা করতে চায় না।

ফুটেজ দেখে ভোট বন্ধের সিদ্ধান্ত ইসি কীভাবে নিল- প্রশ্ন হানিফের: অনিয়মের অভিযোগে গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনের ভোটগ্রহণ বন্ধ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেছেন, গাইবান্ধায় কোনো কেন্দ্রেই নৈরাজ্য হয়নি। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে এতগুলো কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিতের সিদ্ধান্ত ইসি কীভাবে নিল- তা বোধগম্য নয়। রাজধানীর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে তিনি এ কথা বলেন।

তবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, গাইবান্ধার উপনির্বাচন বন্ধের মাধ্যমে ইসি প্রমাণ করেছে, তারা পুরোপুরি স্বাধীন। সরকার কোনোভাবেই ইসিকে নিয়ন্ত্রণ করে না। ইসির কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করে না। তবে ইসি ৪৫টি কেন্দ্রের ভোট স্থগিতের পর বাকি কেন্দ্রগুলোর ভোটগ্রহণ অব্যাহত রাখতে পারত। বিশেষ উদ্দেশ্য দেখছে বিএনপি: গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচন স্থগিতের পর সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনে ইসির সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিএনপি। দলটির নেতাদের ভাষ্য- মাত্র একটি আসনের নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে ইসি। এছাড়া নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিয়ে বিরোধী দলকে ভোটে আনতে ইসি বিশেষ উদ্দেশ্যে উপনির্বাচন বন্ধ করতে পারে বলেও সন্দেহ বিএনপির।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল গণমাধ্যমকে বলেন, আবারো প্রমাণ হয়েছে এই কমিশন নিরপেক্ষ ভোটগ্রহণে ব্যর্থ। যারা ১৪৫ কেন্দ্রে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ তারা হাজার হাজার কেন্দ্রে নিরাপত্তা দেবে কিভাবে? মানুষ যেন সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে পারে সেই দাবিতে বিএনপি এখন আন্দোলন করছে। বিএনপির আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে যারা প্রশ্ন তোলেন তারা গাইবান্ধা থেকে শিক্ষা নিতে পারেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, ইসি সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ। সিইসি কোনো কাজে সফল না হলেও অব্যাহতভাবে মিথ্যা বলে যাচ্ছেন। তিনি একটি আসনে ভোটারদের নিরাপত্তা দিতে যেখানে ব্যর্থ, সেখানে একইদিনে দিনে সারাদেশের ভোটকেন্দ্রে কীভাবে নিরাপত্তা দেবেন।

এদিকে গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচন বন্ধের পর এ আসনের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। তাদের দাবি, নির্বাচনে কোনো অনিয়ম হয়নি, সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন চলছিল। কেনো নির্বাচন কমিশন এ নির্বাচন বন্ধ করল?

প্রসঙ্গত, গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৯৮ জন। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী মাহমুদ হাসান, জাতীয় পার্টির (জাপা) মনোনীত এ এইচ এম গোলাম শহীদসহ উপনির্বাচনে ৫ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ইভিএমের মাধ্যমে ১৪৫টি কেন্দ্রে ৯৫২টি বুথে ভোটগ্রহণ করার কথা ছিল।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App