×

জাতীয়

লোডশেডিং দীর্ঘায়িত হওয়ার শঙ্কা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২২, ০৭:৪১ এএম

দফায় দফায় কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না, গ্যাসের স্বল্পতা ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে উৎপাদন ব্যাহত

গ্যাস সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কথা বলে গত ১৯ জুলাই ঘোষণা দিয়ে দেশে লোডশেডিং শুরু করে সরকার। সে সময় দিনে ১ ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের কথা বলা হলেও শুরু থেকেই শিডিউল মানা সম্ভব হয়নি। রাজধানীতে কিছুটা সহনীয় থাকলেও প্রত্যন্ত এলাকায় দুঃসহ অবস্থার সৃষ্টি হয়। তখন সরকারের মন্ত্রীরা আশ্বাস দিয়েছিলেন অক্টোবরের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বরং আরো অবনতি হয়েছে। এখন রাজধানীসহ সারাদেশেই দফায় দফায় লোডশেডিং হচ্ছে এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেখা মিলছে না বিদ্যুতের। এই সংকটের শেষ কোথায়? এর জবাবে তেমন কোনো আশার কথা শোনাতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। বরং ‘লোডশেডিং আরো দীর্ঘায়িত হবে’ বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন খোদ বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী। বিদ্যুৎ বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে বেড়েছে লোডশেডিং এবং তা আরো বাড়তে পারে। তাদের মতে, ঘোড়াশাল গ্রিড ট্রিপ করার পর এখনো পুরোপুরি চালু না হওয়ায় সমস্যা আরো প্রকট হয়েছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একদিকে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া এবং অন্যদিকে গ্যাস, ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলের সংকট মোকাবিলা করতে না পারার কারণেই বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে এবং লোডশেডিং বেড়েছে। দ্রুত এই পরিস্থিতি উত্তরণের পথ দেখা যাচ্ছে না।

লোডশেডিং কী কারণে শুরু হয়েছিল তা ব্যাখ্যা করেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ নিজেই। তিনি জানান, মূলত গ্যাস সংকটের কারণেই দেশের বিদ্যুৎ খাতে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন পুনরায় স্বাভাবিক হবে। তখন লোডশেডিং থাকবে না বলেও তিনি জানিয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, অনেকগুলো ফ্যাক্টর একত্রিত হয়ে বর্তমান সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। অভ্যন্তরীণ গ্রিডে লোড সমস্যা, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া, গ্যাস ও অন্যান্য জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়া, ঘোড়াশাল গ্রিড ট্রিপ করাসহ আরো কিছু উপাদান যুক্ত হয়েই সংকট জট পাকিয়েছে। তিনি বলেন, সমস্যা সমাধানের সহজ কোনো উপায় আমি দেখছি না। মূলত জ্বালানির অভাবেই এই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে।

এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, এলএনজি দিয়ে গ্যাসের সমস্যা অনেকটাই সমাধান হতো, যদি দামের ঊর্ধ্বগতি না হতো। দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন না থাকায় সরকার এলএনজিতে গেল। কিন্তু এরপর অল্প সময়ের মধ্যেই এলএনজির দাম বাড়তে শুরু করল। ৬ ডলার থেকে বেড়ে ৬০ ডলারে পৌঁছল। এরফলে ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে দামের প্রতিযোগিতায় আমরা পেরে উঠলাম না। গ্যাসের সমস্যা আরো তীব্র হওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হয়। এই সংকট কবে মিটবে তা এখনি বলা যাচ্ছে না, আরো অপেক্ষা করতে হবে।

পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, গ্যাসের স্বল্পতার কারণেই বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। গ্যাস সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে সরকার এলএনজি আমদানি শুরু করে। কাতার ও ওমানসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে এলএনজি কেনার জন্য চুক্তিও রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী সরবরাহও চলছে। এর পাশাপাশি খোলাবাজার থেকেও এলএনজি কেনা হচ্ছিল। তখন এলএনজির দাম ছিল ৭-৮ ডলার। এই এলএনজি জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করার পর গ্যাসের সংকট অনেকটাই কমে আসে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোও স্বাভাবিক উৎপাদন করে আসছিল। কিন্তু রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে ডলারের দাম বেড়ে যায়। আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম হু হু করে বেড়ে যায় ইউরোপীয় দেশগুলোতে চাহিদা বাড়ার কারণে। এতে জ্বালানি খাতে ধাক্কা লাগে। সংকটে পড়ে বাংলাদেশ। বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণেই এখন লোডশেডিং হচ্ছে।

পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, দিনে ৩৮০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের প্রয়োজন রয়েছে। এখন পাওয়া যাচ্ছে ২৬৭ কোটি ঘনফুট। এরমধ্যে এলএনজি থেকে ৩৮ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এলএনজির দাম ৬০ ডলারে পৌঁছার পর গত জুলাই থেকে খোলা বাজার থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে দাম কমে ২৫ ডলারে নেমে এলেও আপাতত আমদানির সম্ভাবনা নেই। এ সময় ডলারের দাম রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় সরকার এই সিদ্ধান্ত নেয়। অন্যদিকে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে উৎপাদন কমে যায়। পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ করতে না পারার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর উৎপাদনও কমে যায়। এই অবস্থায় লোডশেডিং দেয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না।

বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের বিদ্যুৎ খাত পরিকল্পনা মতোই চলছিল। বিদ্যুতের কোনো সংকট ছিল না। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সরকারের সব পরিকল্পনা ওলট-পালট করে দিয়েছে। বৈশ্বিক সংকটের প্রভাব, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির উচ্চমূল্য ও সরবরাহ না পাওয়ায় বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও সমস্যায় রয়েছে। সরকার সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরমধ্যে গত ৪ অক্টোবর ঘোড়াশাল জাতীয় গ্রিড ট্রিপ করার কারণে সংকট আরো প্রকট হয়েছে। এই গ্রিড এখনো সচল হয়নি। গ্রিডটি চালু চলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে এবং তখন লোডশেডিং কমে আসবে।

লোডশেডিংয়ের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, বিদ্যুতের চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম হওয়া। অর্থাৎ সিস্টেমে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম হলে সিস্টেমকে স্টেবল রাখতে বাড়তি চাহিদাকে উৎপাদনের সঙ্গে সমন্বয় করা হয় লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে। সমন্বয় না করলে সিস্টেম ফ্রিকোয়েন্সি কমে পুরো গ্রিডে ব্ল্যাক আউটের মতো ঘটনা ঘটে। এমন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন গ্রিড সাব-স্টেশনগুলোকে তার চাহিদা অনুপাতে বরাদ্দ দেয়া হয় এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে বরাদ্দ অনুসরণ করতে হয়। এ ধরনের লোডশেডিংকে শিডিউল লোডশেডিং বলা যেতে পারে। গত কয়েকদিন ধরে সারাদেশে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। শিল্প-কারখানায় উৎপাদনে বিঘ্নিত হচ্ছে।

জানা গেছে, এই অবস্থায় ব্যক্তি মালিকানাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাও কমেছে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র ফার্নেস অয়েল ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে ব্যক্তি মালিকানাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো কম পরিমান ফার্নেস অয়েল কিনছে। এরফলে তাদের উৎপাদনও কমেছে। এছাড়া তারা বাড়তি দামে ফার্নেস অয়েল কেনায় সরকারের কাছে ডলারের বর্তমান মূল্য ধরে বিল চেয়েছিল। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এতে সুপারিশ করেছিল। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় বেসরকারি কোম্পানিগুলোর চাহিদামতো অর্থ ছাড় দেয়নি। উপরন্তু এখন বিল দিতেও দেরি করছে। অর্থ সংকটের কারণে তারা উৎপাদন বাড়াতে পাড়ছে না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App