×

অর্থনীতি

শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপের ফাঁদে অস্থির পণ্যবাজার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২২, ০৯:০০ এএম

শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপের ফাঁদে অস্থির পণ্যবাজার

ছবি: ভোরের কাগজ

নানা অজুহাতে হঠাৎ করেই অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে নিত্যপণ্যের বাজার। কোনো ধরনের অজুহাত পেলেই কিছু সুযোগ সন্ধানী ব্যবসায়ী বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে অতিমুনাফা করেন। গত কয়েক বছর ধরে এ ধরনের সিন্ডিকেট খুবই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। সাধারণত খাদ্যপণ্য নিয়ে এমন সিন্ডিকেট বেশি হয়ে থাকে। আর দেশের বড় বড় কিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর খপ্পরে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে পণ্যবাজারে। যার প্রমাণ মিলেছে ভোক্তা অধিকার এবং প্রতিযোগিতা কমিশনের কর্মকাণ্ডে। বাজারে অস্থিরতা তৈরির অভিযোগে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের তলব করেছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। প্রথম ধাপের শুনানি শেষের পথে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানকে। তবে বাজার স্বাভাবিক রাখতে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলার সঙ্গে সঙ্গে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়ার দাবিও জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

সূত্র জানায়, গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকে চাল, ময়দা, ডিম, মুরগি, সাবান, ডিটারজেন্ট, শ্যাম্পুর বাজারে কারসাজির অভিযোগে ৩৬টি কোম্পানি ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে মোট ৪৬টি মামলা দায়ের করেছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। এদের মধ্যে রয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি, মিলার, পোল্ট্রি ফার্ম, প্রসাধন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। গত ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে এসব মামলার শুনানি শুরু হয়েছে। এদের মধ্যে আদানি উইলমারের বিইওএল, ইউনিলিভার বাংলাদেশ, বসুন্ধরা, স্কয়ার, সিটি গ্রুপ, ব্র্যাক, প্রাণ, মেঘনা, আকিজ, টিকে, এস আলমসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা কমিশন মামলা করেছে। আর পোল্ট্রি খাতে সিপি বাংলাদেশ, কাজী ফার্মস, প্যারাগনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়েছে। কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য এবং প্রসাধনী সামগ্রীর দামের কারসাজিতে জড়িত থাকার অভিযোগে ছয়টি ব্যবসায়িক সংস্থাকে গত ২৮ সেপ্টেম্বর জিজ্ঞাসাবাদ করেছে প্রতিযোগিতা কমিশন। কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে বসুন্ধরা ফুড এন্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেড, এরফান গ্রুপ, ডায়মন্ড এগ লিমিটেড এবং নুরিশ পোল্ট্রি এন্ড হ্যাচারি। আটটি মামলায় পাঁচটি কোম্পানি ও ব্যক্তিকে গত ২৯ সেপ্টেম্বর জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কোম্পানি ও ব্যক্তিদের মধ্যে এসিআই লিমিটেড, জহুরা অটো রাইস মিল লিমিটেডের আবদুল হান্নান, আলাল পোল্ট্রি এন্ড ফিশ ফিড লিমিটেডের আলাল আহমেদ, সগুনা ফুড এন্ড ফিডস বাংলাদেশ লিমিটেডের পরিচালক, আলাল এগ্রো এন্ড ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা সিইও এবং পিপলস ফিড লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী ছিলেন। এছাড়া গত ৩ অক্টোবর ব্র্যাক সিড এন্ড এগ্রো এন্টারপ্রাইজ, টিকে গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ, সিপি বাংলাদেশ এবং নূরজাহান অ্যাগ্রোর জোহিরুল হাসান প্রতিযোগিতা কমিশন কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত শুনানিতে অংশ নেয়ার কথা থাকলেও টিকে গ্রুপ ছাড়া সবাই উপস্থিত ছিলেন।

কমিশনের মতে, চাল, আটা, পোল্ট্রি পণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামে হেরফের করে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে কোম্পানি ও ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। এছাড়াও প্রানসহ আরো ৩টি কোম্পানির শুনানি গত ৪ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয়। আগামী সোমবার প্রথম ধাপের শুনানি শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যান মো. মফিজুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, সারাবিশ্বে প্রতিযোগিতা কমিশন বাজার স্বাভাবিক রাখতে কাজ করে। আমরাও করছি। এক্ষেত্রে যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা চলছে, তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলে শাস্তির আওতায় আনা হবে। এক্ষেত্রে প্রচুর তথ্য-উপাত্তের প্রয়োজন রয়েছে। আর বিষয়টি সময়সাপেক্ষ।

বাজার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তেল, চিনি থেকে শুরু করে চাল, ডাল, আটা, ময়দা, ডিমের বাজারে বেসরকারি খাতের অংশীদারত্ব ৯০ শতাংশেরও বেশি। যে কারণে সরকার চাইলেও এসব বাজারের সরবরাহ ব্যবস্থা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে না। যেমনটি ঘটেছে সয়াবিনের বাজারে। বৈশ্বিকভাবে তেলের দাম বাড়ানোর পর হুট করে উধাও হয়ে যায় বাজারের সয়াবিন। যদিও পরবর্তীতে ভোক্তা অধিকারের অভিযানে সারাদেশে মিলে সয়াবিন তেল। আর ভোক্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকার করছাড় দিলেও কোনো লাভ হয়নি। তারা তাদের মতো করে দাম নির্ধারণ করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতি চাপ সৃষ্টি করে। উপায়ান্তর না দেখে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নতুন দাম নির্ধারণ করে। কিন্তু সরকার তেলের দাম কমানোর পরও ‘আগে কেনা’র অজুহাতে দুদিনেও কমেনি সয়াবিনের দাম।

এদিকে, চালের বাজারের আরো বেহাল অবস্থা। চালের আমদানি শুল্ক কমানো থেকে শুরু করে বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানির অনুমতি দেয়ার পরও বাজারের অস্থিরতা কাটেনি। বাড়তি দামেই চাল কিনতে হচ্ছে ভোক্তাকে। কারণ দেশের চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন গুটি কয়েক ব্যবসায়ী। এক্ষেত্রে রশিদ চাল এজেন্সির বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাজার অস্থিতিশীল করার অভিযোগে কুষ্টিয়ার বিখ্যাত চাল সরবরাহকারী রশিদ রাইস এজেন্সি থেকে শুরু করে উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের নামে মামলা করেছে প্রতিযোগিতা কমিশন।

এ বিষয়ে কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, কিছু বড় বড় শিল্প গ্রুপের কারণে পণ্যবাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। এসব ব্যবসায়ী বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে অতিমুনাফা করতে চায়। এর প্রমাণ প্রতিযোগিতা কমিশনের মামলায় মিলেছে। যারা ভোক্তাকে জিম্মি করে অতিরিক্ত মুনাফা করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবিও জানান তিনি।

প্রতিযোগিতা কমিশন আইনের ১৫ ও ১৬ ধারা অনুযায়ী, দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, বাজারে প্রভাব বিস্তার করে একপক্ষীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি করলে তারা শাস্তির আওতায় আসবে। আর এই আইনের ১৬ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো পণ্যের বাজারজাত বা উৎপাদনে শীর্ষে থাকার সুযোগ কাজে লাগিয়ে পণ্যের দামে কারসাজি করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইনে সতর্ক ও ভর্ৎসনা করা ছাড়াও অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বাৎসরিক টার্নওভারের শতকরা ১০ ভাগ পর্যন্ত জরিমানা করা যাবে। শুনানি শেষে অপরাধ প্রমাণ হলে শাস্তির মুখোমুখি হবে এসব প্রতিষ্ঠান।

পণ্যবাজারের অস্থিতিশীলতার বিষয়ে কনসাস কনজুমার সোসাইটির (সিসিএস) নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ ভোরের কাগজকে বলেন, বড় বড় কিছু প্রতিষ্ঠানের জন্যই পণ্যবাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যার প্রমাণ মিলে প্রতিযোগিতা কমিশনের মামলায়। মামলা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। তাই এই মামলার সঙ্গে সঙ্গে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হলে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে। ভোক্তা অধিকার ইতোমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারের এসব পদক্ষেপ অব্যাহত থাকলে বাজারকে কোনো প্রতিষ্ঠানই অস্থিতিশীল করতে পারবে না বলেও মনে করেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App