×

সারাদেশ

দৌলতপুর সীমান্তে প্রতিমা বিসর্জনে দুই বাংলার মানুষের ঢল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২২, ১১:০৮ পিএম

দৌলতপুর সীমান্তে প্রতিমা বিসর্জনে দুই বাংলার মানুষের ঢল

কুষ্টিয়ার দৌলতপুর সীমান্তে মাথাভাঙ্গা নদীর দুই পাড়ে দুই বাংলার মানুষের উপস্থিতি। ছবি: ভোরের কাগজ

দৌলতপুর সীমান্তে প্রতিমা বিসর্জনে দুই বাংলার মানুষের ঢল

প্রতিমা বিসর্জনে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর সীমান্তের মাথাভাঙ্গায় ওপার বাংলার মানুষের অবস্থান। ছবি: ভোরের কাগজ

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজার বিজয়া দশমীর আনুষ্ঠানিকতার পর প্রতিমা বিসর্জনকে ঘিরে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর সীমান্তে জড়ো হয়েছিল দুই বাংলার হাজারো মানুষ।

বিজয়া দশমীর উৎসব ভাগাভাগির পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে তারা নিজ নিজ সীমান্তে আসেন। মিলিত হন উৎসব আয়োজনে। প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে সাঙ্গ হয় দুর্গোৎসব। এ সময় দুই বাংলার বসবাসরত মানুষের মধ্যে উৎসবের পাশাপাশি অন্যরকম এক আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

এ পারে দৌলতপুর উপজেলার আদাবাড়িয়া ইউনিয়নের ধর্মদহ সীমান্ত আর ওপারে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার করিমপুর থানার শিকারপুর সীমান্ত। দুই দেশের মাঝে বিভাজন রেখা টেনে দিয়েছে পদ্মার শাখা নদী মাথাভাঙা। প্রতিমা বিসর্জন উপলক্ষে দুই বাংলার মানুষজনের জন্য নিজ নিজ সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। প্রতি বছরেই এই দিনে হাজারো মানুষের সমাগম ঘটে মাথাভাঙা নদীর দুই পাড়ে। শুধু সীমান্ত এলাকার মানুষজনই নন, ছুটে আসেন দূর-দূরান্তের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারাও। এ বছরেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। একটি দিনের খানিক সময়ের জন্য মানুষের ঢল নেমেছিল। দুই বাংলার মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল।

[caption id="attachment_373567" align="aligncenter" width="700"] প্রতিমা বিসর্জনে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর সীমান্তের মাথাভাঙ্গায় ওপার বাংলার মানুষের অবস্থান। ছবি: ভোরের কাগজ[/caption]

বছরে এই একবারই সীমান্তরক্ষীদের বিনা বাধায় দুই বাংলার হাজারো নারী-পুরুষ মাথাভাঙার দুই পাড়ে জড়ো হন। প্রতি বছরের মতো বুধবার (৫ অক্টোবর) বিকালে তারা সীমান্তের নিজ নিজ ভূখণ্ডে অবস্থান নেন, উৎসব করেন। প্রতিমা বিসর্জন দেন। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ছাড়াও মুসলমান ধর্মের লোকজনও নদী পাড়ে আসেন। উদ্দেশ্য, আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করা। এতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আরেক নিদর্শন তৈরি হয়। যদিও নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে তারা শুধু চোখের দেখার সুযোগ পান। সরাসরি সাক্ষাতের সুযোগ থাকে না।

পাশের জেলা পাবনার ইশ্বরদী থেকে আসা জামাল উদ্দিন বলেন, আপন চাচাত ভাই জয়নাল শেখের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন তিনি। জয়নাল পশ্চিমবঙ্গের করিমপুর থানা এলাকার বাসিন্দা। প্রতিবছর এখানে আসেন শুধুমাত্র দেখা করার জন্য তারা।

মেহেরপুর থেকে বিলকিস খাতুন এসেছেন মামার সঙ্গে দেখা করতে। তারাও প্রতি বছরই ছুটে আসেন, এবারও এসেছেন। তাদের মতো প্রাণের টানে ছুটে আসা প্রত্যেকেই মাথাভাঙ্গাকে মাঝখানে রেখে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকেন। আর দূর থেকেই হাত উঁচিয়ে ইশারা-ইঙ্গিতের মাধ্যমে একে অপরের খোঁজখবর নেয়ার চেষ্টা করেন। কেউ আবার স্বজনদের সঙ্গে গলা ছেড়ে কথাও বলেন। বছর ঘুরে ফের আত্মীয়-স্বজনদের দেখা পাওয়ায় অনেকের চোখেই আনন্দ অশ্রু ঝরে পড়ে। এ সময় মাথাভাঙ্গার দুই প্রান্তে জড়ো হওয়াদের মধ্যে অন্যরকম এক আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

প্রতি বছর এই দিনটির জন্য উন্মুখ হয়ে অপেক্ষায় থাকেন দুই বাংলার মানুষেরা। সীমান্তের জিরো পয়েন্ট বা নোম্যান্স ল্যান্ডে এই দিনটিকে ঘিরে বিজিবি ও বিএসএফের তৎপরতা অনেক বেশি লক্ষ্য করা যায়। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা কড়া নজরদারিতে রাখেন উপস্থিত হওয়া মানুষজনকে। তারা কেউ যেন নদী পেরিয়ে এপার-ওপার হতে না পারেন সে জন্য সীমান্তরক্ষীদের খুবই সতর্ক দৃষ্টি থাকে। এখানে আত্মীয়-স্বজনরা একে অপরকে ছুঁয়ে দেখার, বুকে জড়িয়ে ধরার কিংবা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একটু কথা বলার জন্য আবেগে উদগ্রীব হয়ে উঠলেও আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইনের বাধ্যবাধকতায় তাদের সেই আবেগ অনুভূতি ‘তুচ্ছ’ হয়ে দাঁড়ায়। তবে অনেকে মোবাইল ফোনে ছবি তুলে রাখেন।

একটি বিকেলকে ঘিরে দুই বাংলার মানুষজন আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠেন। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পূজা মণ্ডপগুলো থেকে একে একে দেবী দুর্গাকে বিসর্জনের জন্য মৃতপ্রায় মাথাভাঙা নদীর তীরে নিয়ে আসা হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দল বেঁধে ঢাকের তালে তালে নাচানাচি করে প্রতিমা নিয়ে সেখানে উপস্থিত হতে থাকেন। উভয় দেশের সীমান্ত এলাকার ২০টির মতো প্রতিমা মাথাভাঙায় বিসর্জন দেয়া হয়। এর মধ্যে বেশিরভাগই ছিল ওপার বাংলার প্রতিমা।

সূর্য যত পশ্চিমে গড়াতে থাকে মাথাভাঙা নদীর পাড়ে মানুৃষের উপস্থিতিও বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় দুই পাড়। প্রতিমা বিসর্জন দিতে কারা কখন আসবেন সে জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকেন সবাই। ঢাকের বাড়ি শুনলেই পূলকিত হয়ে ওঠেন তারা। প্রতিমাগুলো সন্ধ্যা লাগার আগেই এসে হাজির হয় নদীর পাড়ে। শেষ বিদায় জানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। সন্ধ্যায় মাথাভাঙ্গা নদীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শারদীয় দুর্গোৎসব সাঙ্গ হয়। নেমে আসে বিষাদের ছায়া। নদী পাড়ে ছুটে আসা মানুষজন ফের আগামী বছর মিলিত হওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে অশ্রুসজল নয়নে ফিরে যান তাদের আপন ঠিকানায়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App