×

শিক্ষা

শিক্ষা প্রশাসনের ‘বিলাসী’ প্রকল্প

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২২, ০৮:৩৭ এএম

শিক্ষা প্রশাসনের ‘বিলাসী’ প্রকল্প

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড (মাউশি)

ডিআইএ ভেঙে হচ্ছে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা অধিদপ্তর > সৃষ্টি হচ্ছে প্রধান শিক্ষা পরিদর্শকের পদ > দুই কমিটি গঠন

পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরকে (ডিআইএ) ভেঙে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা অধিদপ্তর ও প্রধান শিক্ষা পরিদর্শকের জন্য দুটো দপ্তর স্থাপনের মতো এক ‘বিলাসী’ প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে হাঁটা শুরু করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যেখানে কম টাকায় বর্তমান ডিআইকে আধুনিক ও গতিশীল করে পুরো কাজ হাসিল হতো সেখানে কোটি কোটি টাকা খরচ করে আরেকটি দপ্তরের জন্ম দিয়ে ‘মাথাভারি প্রশাসন’ গড়ে তোলার ফন্দিফিকির করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ রকম পরিস্থিতির মধ্যেই দুটি কমিটি গঠন করে বলে দেয়া হয়েছে, দপ্তর দুটোর কাঠামো এবং কাজের পরিধির বিস্তারিত রূপরেখা প্রণয়ন করে জমা দিতে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমন নির্দেশনা পেয়ে গঠিত কমিটি গত বৃহস্পতিবার বৈঠক করলেও কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি। শিক্ষা প্রশাসনের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

বিশ্লেষকরা বলেছেন, বর্তমানে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি), শিক্ষাবোর্ড এবং পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একাডেমিক বিষয় পরিদর্শন করে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে কাজ করে। এমনিতেই ত্রিপক্ষীয় পরিদর্শনের জেরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নাস্তানাবুদ হচ্ছে। এরই মধ্যে নতুন করে প্রধান শিক্ষা পরিদর্শকের পদ সৃষ্টি হলে বহুমাত্রিক সিদ্ধান্ত ও পরিদর্শনের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঠিক কোন চিত্র বেরিয়ে আসবে তা নিয়ে গভীর সন্দেহ প্রকাশ করছেন তারা। সবমিলিয়ে খণ্ড খণ্ড প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি হলে সুফলের পরিবর্তে সমন্বয়হীনতা বাড়ার কথা বলেছেন তারা।

জানতে চাইলে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরকে (ডিআইএ) ভেঙে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা অধিদপ্তর গঠনের রূপরেখা প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ও মাউশির পরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক শাহেদুল খবির চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, সবকিছু পর্যবেক্ষণে নিয়ে, অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ করে আমরা সরকারের কাছে সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদন জমা দেব। তারপর কোন প্রেক্ষাপটে কী বিবেচনায় কাজ হবে তা সরকারের সিদ্ধান্ত।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বর্তমানে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একাডেমিক, প্রশাসনিক ও আর্থিকসহ সব বিষয়ে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা করে মন্তব্য ও সুপারিশসহ সরকারের কাছে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পেশ করে থাকে। সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা থাকলেও বছরের পর বছর ধরে তা ফেলে রাখে। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অপকর্ম থামানো যায় না। এ রকম পরিস্থিতিতে শিক্ষানীতি-২০১০ এর দোহাই দিয়ে সরকার ডিআইএকে ভেঙে দুটো দপ্তর করতে চায়। এর একটির নাম অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা অধিদপ্তর এবং অন্যটির নাম প্রধান শিক্ষা পরিদর্শকের দপ্তর। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মতে, প্রধান শিক্ষা পরিদর্শকের দপ্তর শুধু মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একাডেমিক কার্যক্রম পরিদর্শন করবে। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর এবং মাদ্রাসা, কারিগরি স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একাডেমিক বিষয়গুলো কারা পরিদর্শন করবে তা বলা নেই। আর অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা অধিদপ্তর শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক বিষয়ে পরিদর্শন করবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেছেন, যেখানে কম টাকায় ডিআইএকে আধুনিক করে গড়ে তোলার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিদর্শন করালে ভালো সুফল পাওয়া যেত। কিন্তু তা না করে ডিআইএকে ভেঙে দুটো দপ্তর স্থাপন করার জন্য যে কমিটি করা হয়েছে সেই কমিটির ‘মিটিং-ফিটিংয়ের’ নামে বহু টাকা খরচ হবে। নানা চড়াই-উতরাই পার হওয়ার পর যদি দপ্তরগুলো প্রতিষ্ঠিতও হয় সেক্ষেত্রে জাতির কী লাভ হবে- তা কী শিক্ষা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা বিশ্লেষণ করেছেন? নিজের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তিনি নিজেই বলেন, নিশ্চিত করে বলতে পারি শিক্ষা প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্তরা এসব বিষয় ভাবেননি। একে তিনি ‘বিলাসী’ প্রকল্প নাম দিয়ে অকার্যকর খাতে টাকা খরচের একটি পদ্ধতি বলে অভিহিত করেছেন।

শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মতে, আলাদা দপ্তর দুটো না করে ডিআইএ’র অধীনে দুটো উইং করা যেতে পারে। এর একটি হচ্ছে পরিদর্শন উইং আরেকটি হচ্ছে নিরীক্ষা (অডিট) উইং। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আগের সচিব মো. মাহবুব হোসেনের নির্দেশে ডিআইকে আধুনিকীকরণের জন্য একটি কর্মশালাও করা হয়েছিল এবং সেটির খসড়াও প্রস্তুত হয়। কর্মকর্তারা বলেছেন, সেই খসড়া বাস্তবায়ন করাই যৌক্তিক ছিল। কিন্তু তা না করে নতুন দপ্তর করলে বাস্তবায়ন করতে কমপক্ষে যেমন ১০ থেকে ১২ বছর লাগবে; তেমনি বছরে সেই দপ্তরের পরিচালন খরচ আসবে ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা। অথচ সরকার এখন ব্যয় সংকোচন নীতি বাস্তবায়ন করছে। এ অবস্থায় এমন সিদ্ধান্তকে হঠকারী বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা।

জানতে চাইলে পরিদর্শন ও নীরিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক অলিউল্লাহ্ মো. আজমতগীর ভোরের কাগজকে বলেন, সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলায় এ বিষয়ে কোনো কিছু বলা সমীচীন হবে না। তার মতে, ডিআইএকে বিভক্ত না করে উপযুক্ত সুপারিশগুলো কার্যকর করা গেলে সুফল পাওয়া যেতে পারে।

শিক্ষা প্রশাসনের নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এর আলোকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন করে একাডেমিক মান নির্ণয় ও প্রতি বছর এগুলোর র‌্যাঙ্কিং নির্ধারণের জন্য প্রধান শিক্ষা পরিদর্শকের কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে চায় সরকার। একইসঙ্গে এই কার্যালয়ের কার্যাবলী এবং সাংগঠনিক কাঠামো নির্ধারণ করা। পাশাপাশি বিদ্যমান পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরকে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা অধিদপ্তরে রূপান্তর করা। এর দায়িত্ব হবে শিক্ষানীতি-২০১০ এর প্রস্তাবনা মোতাবেক আর্থিক নিরীক্ষার দায়িত্ব পালন করা।

সংশ্লিষ্টরা এই প্রস্তাবনাগুলোকে বিশ্লেষণ করে বলেছেন, ডিআইএ এখন একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একাডেমিক, প্রশাসনিক ও আর্থিকসহ সব বিষয়ে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা করে। কিন্তু প্রধান শিক্ষা পরিদর্শকের দপ্তর স্থাপন হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই ধরনের পরিদর্শন হবে। এতে সমন্বয়হীনতাও বাড়বে। সিদ্ধান্তও যাবে দুরকম।

শিক্ষা প্রশাসনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, এ বিষয়ে সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপুমনির সভাপতিত্বে একটি বৈঠক হয়েছে। সেই বৈঠকের কার্যবিবরণী সংগ্রহ করে দেখা গেছে, সভাপতি বক্তব্যের শুরুতেই বলেন, ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত ডিআইএ’র কোনো সংস্কার বা পুনর্গঠন হয়নি। এরপর শিক্ষার মানোন্নয়নে ‘সেসিপ’ নামের একটি প্রকল্পের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ মামুন মিয়া ডিআইএ পুনর্গঠন সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি সভায় উত্থাপন করেন। এ সময় তিনি ডিআইএকে ভেঙে প্রধান শিক্ষা পরিদর্শকের কার্যালয় ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ওই প্রতিবেদন সম্পর্কে সভায় বলেন, শিক্ষা বোর্ডগুলোতে দীর্ঘকাল ধরে শিক্ষা পরিদর্শকের পদ রয়েছে, এক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে। অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাজে লাগানো যেতে পারে। তবে তারা কেউই আলাদা দপ্তর গঠনের বিষয়ে সরাসরি কিছু বলেননি।

শিক্ষা প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, বিদ্যমান আইনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একাডেমিক বিষয়ের পরিদর্শন শিক্ষা বোর্ড, মাউশির অধীনে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এবং পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর করে থাকে। ত্রিপক্ষীয় এই পরিদর্শনের জেরে একাডেমিক পরিদর্শন শুধু ‘ফটোফিচারের’ মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন দপ্তরের বিভিন্ন রকম নির্দেশনায় এমনিতেই জেরবার হয়ে থাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। এখন আবার নতুন করে প্রধান শিক্ষা পরিদর্শকের পদ সৃষ্টি করলে নতুন করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। এছাড়া পরিদর্শনের সময় ‘ঘুষ’ নেয়ার আরেকটি নতুন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে বলেও অনেকেই মনে করছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App