×

মুক্তচিন্তা

রাজনৈতিক অঙ্গনে সুস্থতা ফিরে আসুক

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২২, ০১:৩৭ এএম

জাতীয় নির্বাচনের আর বছর দেড়েক বাকি। এরূপই রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। ২০২৪-এর জানুয়ারির মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করার আইনি বাধ্যবাধকতা আছে। ২০২৩-এর ডিসেম্বরেও নির্বাচন হতে পারে। রোডম্যাপ ঘোষিত হলেও নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আছে নানা টানাপড়েন, আছে নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিরোধী বলয়ের বিস্তর সংশয় ও অনাস্থা। নির্বাচনকেন্দ্রিক সভা সমাবেশ মিটিং মিছিলে সম্প্রতি ‘লাঠি’ ইস্যুও আমাদের ভাবিত করে তুলেছে। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার পুরোটাই আপাত অসুস্থ। বিএনপি নেতাদের উত্তেজক বক্তব্য এবং সাধারণ কর্মীদের প্রতি নির্দেশনা রাজনৈতিক অঙ্গনে সহনশীলতার পরিবর্তে অস্থিরতাই বেশি সৃষ্টি করছে। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকায় বিএনপি যেন মাত্রাহীন হাঁপিয়ে উঠেছে- তাদের নানারূপ উচ্চবাচ্যে তাই প্রমাণিত। দলটির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকর্মী থেকে রাজপথের আন্দোলনে দাঁড়ানোর কর্মীরাও সেই অস্থির উত্তেজনার বাগাড়ম্বরে যারপরনাই তৎপর! বাগাড়ম্বরের উত্তেজনায় শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের নামে ইতোমধ্যে একাধিক জায়গায় পুলিশের ওপর আক্রমণ করেছে। পুলিশের প্রতি-আক্রমণে ইতোমধ্যে কেউ কেউ মৃত্যুবরণও করেছেন। কোথাও আবার নিজেদেরই ইটপাটকেলের আঘাতেও কোনো কোনো কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। নিজেদের আঘাতে মৃত্যুবরণকারীকে বিএনপি নেতারা গণতন্ত্র রক্ষার অসম সাহসী শহীদ হিসেবে আখ্যা দিয়ে নয়াপল্টনে রাজনৈতিক জানাজাও সম্পন্ন করেছেন! এই রাজনৈতিক জানাজা মৃতের উদ্দেশ্যে নিবেদিত শ্রদ্ধার চেয়ে বিএনপির পুরনো কৌশলের ‘লাশের রাজনীতিই’ সাধারণের চোখে স্পষ্ট হয়েছে। কিন্তু অদৃষ্টের কী নির্মম পরিহাস, যেসব নেতা গণতন্ত্রের জন্য নিজেদের জীবনবাজির কথা জনসভায় ঘোষণা করেন তারা পর্দার অন্তরালেই রয়ে যান! আর নির্মমভাবে নিজেদেরই কর্মী-সমর্থকদের কাছে প্রাণ হারাতে হয় জীবনযুদ্ধে কঠোর পরিশ্রমী নিম্ন-আয়ের কোনো পরিবারের উপার্জনক্ষম একমাত্র ব্যক্তিটিকেই! বড় বড় কথা ‘বলনে-ওয়ালারা’ কেবল লাশকে শহীদের মর্যাদায় অভিষিক্ত করার মধ্য দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন! বিএনপির আন্দোলনের অংশ হিসেবে সম্প্রতি আমরা কয়েকটি অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি, যা মোটেই সুস্থতার লক্ষণ নয়। সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি এখনো জনমত সংগঠিতসহ আন্দোলনের পরিবেশ যে তৈরি করতে পারেনি তা তাদের কর্মকাণ্ড থেকেই বোঝা গেছে। আর পুলিশকে প্রতিপক্ষ করে যখন আন্দোলনের কৌশল সাজানো হয় তখন তা রাজনৈতিকভাবে অবশ্যই পরাজিত হবে। তাও প্রমাণিত হয়েছে। বিএনপির একাধিক জনসভা কিংবা বিক্ষোভে অতি তৎপরতার অভিযোগ এনে নেতাকর্মীরা যখন পুলিশের ওপর চড়াও হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে যায়। তখনই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে। অস্বাভাবিক কোনো মৃত্যুই আমাদের কাম্য নয়। কিন্তু বিএনপি নেতাকর্মীরা যেভাবে পুলিশকে আক্রমণ করে তা থেকে ‘আত্মরক্ষা’র অধিকার শুধু পুলিশ কেন, যে কোনো নাগরিকেরই আছে। কিন্তু বেকায়দা হলো পুলিশের কাছে অস্ত্র থাকে। তাই তাদের আত্মরক্ষার প্রচেষ্টা সাধারণ মানুষের মতো হয় না। ফলে ঘটে যায় বিপত্তি- প্রাণ যায় নিরীহ মানুষের। লাশ হতে হয় সাধারণ মানুষকে। কিন্তু লাশ হয়েও সাধারণের নিস্তার নেই- লাশ নিয়ে শুরু হয় রাজনীতির সেই চিরপরিচিত খেল! বিএনপি নেতাকর্মীদের মিছিলের একটি মৃত্যুদৃশ্য সম্প্রতি ভাইরাল হয়েছে। কী নির্মম সেই মৃত্যু! সিসিটিভি ফুটেজ থেকে পরিষ্কার বোঝা গেল ইটপাটকেল ছোড়ার সময় নিজ দলের কর্মীর ছোড়া পাথরের আঘাতেই প্রাণ গেল দলীয় আরেক কর্মীর! অথচ রুহুল কবির রিজভী থেকে মির্জা ফখরুলের মতো সবাই তাকে শহীদের মর্যাদায় অভিষিক্ত করলেন! নিন্দুকেরা (!) ইতোমধ্যেই বলতে শুরু করেছেন, নিজেদের খুনের দায় সরকারের ওপর চাপানোর এই কৌশলও বিএনপির পুরনো! ঘটা করে গ্রাম থেকে লাশ এনে রাজধানীর পার্টি অফিসের সামনে জানাজা পড়ানো সেই ও পুরনো অসুস্থ রাজনীতিরই ধারাবাহিকতামাত্র। আমরা চাই নিহত ব্যক্তি পারলৌকিক জীবনে শান্তি লাভ করুন। কিন্তু ইহলোকে লাশ নিয়ে এই যে বিএনপির প্রতারণামূলক আচরণ, রাজনীতির নোংরা খেলা, তা দেশের রাজনীতিকে অস্থির পথেই নিয়ে যাবে! উপরন্তু তাদের বক্তব্য-ভাষণে আমরা ঘুরেফিরে ২০১৩-১৪ সালের ঘটনাবলিকেই উসকে দিতে দেখছি। এ ধারা অব্যাহত থাকলে রাজনৈতিক অঙ্গনে সহসা সুস্থতা ফিরবে না। রাজনীতিকে অসুস্থ করে তোলার জন্য সম্প্রতি আবার বাঁশের লাঠির ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি পেতে দেখা যাচ্ছে! গণতন্ত্রচর্চায় যা মর্মান্তিক পরিণতিরই জন্ম দেবে বলে আশঙ্কা। গত মাসের ২৫ তারিখে আমরা দেখেছি বিএনপি নেতাকর্মীরা লাঠির মাথায় জাতীয় পতাকা বেঁধে মিছিল সমাবেশে অংশ নিয়েছে। জাতীয় নির্বাচন যখন আসন্ন-প্রায় তখন বিএনপির এমন যুদ্ধংদেহী আত্মপ্রকাশ তাদের বিগত স্বভাবকেই মূর্ত করছে বলে সাধারণের ধারণা। সেই জ্বালাও-পোড়াও-অগ্নিসন্ত্রাসকে বিএনপি যেন মনস্তাত্ত্বিকভাবে মানুষের মনে সক্রিয় করে তোলার প্রয়াস গ্রহণ করেছে। তাদের এই প্রয়াস রুহুল কবির রিজভীর কথায় আগুনে ঘি ঢালার মতো পরিবেশ তৈরি করেছে। তিনি তার বক্তব্যে বাঁশের লাঠি যেন খাটো না হয় সেজন্য কর্মীদের উৎসাহিত করেছেন! অর্থাৎ বাঁশের লম্বা লাঠি নিয়ে মিছিল সমাবেশে কর্মীদের অংশগ্রহণে এটিকে তার নির্দেশও বলা যায়! বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একাধিক নেতা মিটিং মিছিল সমাবেশে বাধা আসলে সাধারণ কর্মীদের তা প্রতিরোধেরও নির্দেশ দিয়েছেন। তারই অংশ হিসেবে কেবল ঢাকা শহরেই নয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নেতাকর্মীরা লাঠির মাথায় জাতীয় পতাকা বেঁধে মিছিল সমাবেশসহ দলের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করছেন। মির্জা ফখরুলও আবার তাদের পক্ষ অবলম্বন করে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে, কর্মীরা আত্মরক্ষার্থে দলীয় কর্মসূচিতে এভাবে অংশগ্রহণ করছেন! বলতেই হয় ‘কী বিচিত্র এই দেশ, সেলুকাস!’ দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে লাঠিসহ মিছিল সমাবেশ কতটা ঝুঁকিপূর্ণ তা মির্জা ফখরুলের না জানার কথা নয়। যদিও তিনি বলেছেন, ‘আমাদের এরকম কোনো সিদ্ধান্ত নেই। এটা আমাদের কর্মীরা অনেকেই নিজস্ব আত্মরক্ষার জন্য যেটাতে পতাকা বাঁধে সেটা নিয়ে যায়। [..] মার খেতে তারা এখন পতাকা নিয়ে মিছিল করছে। পতাকা নিয়ে মিটিংয়ে যাচ্ছে। অন্য কোনো সমস্যা তো তারা করেনি।’ একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল থেকে তার মতো ব্যক্তি যদি এমন কথা বলেন তাহলে বুঝতে হবে ক্ষমতা দখলের কোনো বিকল্পই এখন আর বিএনপি চিন্তা করছে না। ভাববার সময় এসেছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে আমরা কোন পথে যাচ্ছি? দেশের একজন সাধারণ মানুষ এ কথা তো ভাবতেই পারেন, বিএনপির মতো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল এ দেশে আরো অনেক আছে। আছে তাদের একমাত্র প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগও। সব রাজনৈতিক দল যদি নিজ নিজ শক্তি প্রদর্শনের জন্য লাঠিসহ মিটিং, মিছিল, সমাবেশ শুরু করে দেয় তবে দেশের ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে ঠেকবে? আর যে গণতন্ত্রের জন্য সবার ত্রাহি-চিৎকার তারই বা কী অবস্থা হবে! দুঃখজনক যে, বিএনপির এরূপ শক্তি প্রদর্শনের লাঠি মিছিল নিয়ে সুশীল সমাজেরও কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়নি! তার অর্থ যদি এই হয় যে, যে কোনো পন্থায় আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করা তবে আওয়ামী লীগও তো তার শক্তিটুকু দেখানোর অবকাশ পাবে। আর এমন শক্তি প্রদর্শনের পাল্টাপাল্টি পতাকাবাহী লাঠি মিছিলের মধ্য থেকে জাতি কী ইতিবাচক সুফল পাবে তা কল্পনা করতেও আমাদের কষ্ট হয় না! নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ যে অবস্থানে এসেছে তার কোনো স্বীকৃতি বিএনপি যেমন দিতে চায় না তেমনি সুশীল সমাজও অত্যন্ত কার্পণ্যের চোখে কৃপাসুলভ দৃষ্টিতে আওয়ামী লীগ ও তার অর্জনকে দেখার চেষ্টা করে! এর চেয়ে দুঃখজনক কিছু নেই। আওয়ামী লীগের সবকিছু ভালো, সবকিছু বিশ্বসেরা, সবকিছুই প্রশ্নহীন এমন ভাবনা আওয়ামী লীগ নিজেও ভাবে না। আওয়ামী লীগ নিজেও মনে করে, সমাজের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে দুর্নীতির যে অনুপ্রবেশ সমূলে তার উৎপাটন করতে পারলে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে আরো সহজেই পৌঁছানো সম্ভব হতো। কিন্তু আমরা গঠনমূলক সমালোচনা যেমন দেখি না তেমনি আবার আওয়ামী লীগের অনেক সীমাবদ্ধতা দেখেও রুষ্ট না হই! ‘সরকার ইচ্ছা করলে কী না করতে পারে’- এরূপ একটি ‘মিথ’ সাধারণের মনে বদ্ধমূল! কখনো কখনো সরকার চেষ্টাও করে। কিন্তু সরকারের এরূপ অনেক প্রয়াস ও প্রচেষ্টা কেন যেন মাঝপথেই থেমে যায় তাও আমরা ভেবে পাই না! সাধারণের মনে ছোটখাটো অনেক বিষয়ে রুষ্টতা রয়েছে। কিন্তু তা থেকে মুক্তির কোনো সদুত্তর কিংবা ইতিবাচক বার্তা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সব সময় পাওয়া যায় না, তাই সাধারণের মনে অভিমান আছে, আছে কিছুটা হতাশাও। এই রুষ্ট মনোভাব ও হতাশাবোধ থেকে সরকারবিরোধী ক্ষোভ-সংক্ষোভ তৈরি হয়। আর বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দল কিংবা সুশীল সমাজ সবাই মিলে সেই ক্ষোভ-সংক্ষোভ, অসন্তোষ-অসন্তুষ্টির মিলিত সমস্বরকেই সরকারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার প্রয়াসে তৎপর। সব ধরনের যৌক্তিক ক্ষোভ-সংক্ষোভ, অসন্তোষ-অসন্তুষ্টির প্রতি সরকারের সহনশীল একটি মনোভাব থাকাও জরুরি। কারণ বেলাশেষে সরকারেরও মানুষেরই সমর্থন প্রয়োজন- সাধারণ মানুষের ভালোবাসা প্রয়োজন। আমরা চাই সুষ্ঠু গণতন্ত্রচর্চার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি রাষ্ট্র পরিচালনা করবে এবং অব্যাহত উন্নয়নের ধারাবাহিকতাকে একটি চূড়ান্ত পরিণতি দানের মধ্য দিয়ে একটি নির্দিষ্ট সময়ে দেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ করে তুলবে। লাঠিনির্ভর কোনো অসুস্থ প্রতিযোগিতা নয়- বরং গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি প্রদানের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যাবে দেশ। আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক চিন্তার জগতে সুস্থতা ফিরে আসুক, লাঠি নির্ভরতার অবসান ঘটুক। আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App