×

আন্তর্জাতিক

অস্ত্র যখন ‘পণ্য’ হয় যুদ্ধ তখন বিজ্ঞাপন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২২, ০৮:৩৩ এএম

অস্ত্র যখন ‘পণ্য’ হয় যুদ্ধ তখন বিজ্ঞাপন

ইউক্রেন যুদ্ধ। ফাইল ছবি

বিশ্বজুড়ে যুদ্ধের উন্মাদনা। হুমকি-পাল্টা হুমকিতে আতঙ্কিত মানুষ। মিসাইল আর ক্ষেপণাস্ত্র যখন তখন উড়ে পড়ছে নিরপরাধ মানবিক বসতির মধ্যে। নীল আকাশে পাকাচ্ছে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। চারিদিকে বারুদের গন্ধ বিদীর্ণ করে সজীব নিঃশ্বাস। নীল সমুদ্র সাঁজোয়া রণতরির ছুটে চলায় উত্তাল-অস্থির। প্রশ্ন হলো- কেনো এই যুদ্ধে আয়োজন? কী সেই আক্রোশ? শুধুই কী আক্রোশ, জিঘাংসা নাকি ভেতরে অন্যকিছু?

যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা, আড়ালে অস্ত্র বাণিজ্য: প্রতিটি বন্দুক তৈরিতে, প্রতিটি রণতরি জলে ভাসাতে, প্রতিটি রকেটে আগুন ধরানোর অর্থই হলো- যারা ক্ষুধার্থ, যারা শীতে কুঁকড়ে আছে, কিন্তু গায়ে গরম বস্ত্র নেই, রোগাক্লিস্ট যাদের পথ্য নেই- মূলত তাদের ভাগ থেকেই চুরি করা অর্থ দিয়েই এসব হয়। এ কথা বলেছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার। ইতিহাস জানে, সাম্রাজ্য অটুট রাখতে আধিপত্যবাদিরা বরাবরই সামরিক শক্তির ওপর ভরসা রেখেছেন। এজন্য চাই অস্ত্র। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এটাই নিয়ম। রোম সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বেলায়ও তেমনি। অস্ত্রের কারবারিরা চায় বিশ্বজোড়া সামরিক আধিপত্য। চায় প্রতিটি ইঞ্চি জমিতে থাকবে উত্তেজনা, আকাশে উড়বে যুদ্ধবিমান আর মিসাইল। আড়ালে খেলবে অস্ত্রবাজ, কারিগররা। বাড়বে অস্ত্র ব্যবসা। মূলত এ কারণেই দেশে দেশে যুদ্ধের উন্মাদনা।

পৃথিবীজুড়ে বাড়ছে অস্ত্র ব্যবসা: স্টকহোমের আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণাকেন্দ্রের রিপোর্টে দেখা গেছে, ২০০২ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে গোটা পৃথিবীতে অস্ত্র ব্যবসার পরিমাণ বেড়েছে ৪৭ শতাংশ। ২০১৮ সালে বিশ্বের প্রধান ১০০টি অস্ত্র প্রস্তুতকারী সংস্থা ৪২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবসা করেছে। শুধু তাই নয়, সংস্থাটি জানিয়েছে, অস্ত্র ব্যবসা সব চেয়ে বেশি বেড়েছে আমেরিকায়। ইউরোপ এবং রাশিয়াকে পেছনে ফেলে আমেরিকার প্রথম ৫টি অস্ত্র প্রস্তুতকারী সংস্থা গত এক বছরে ব্যবসা বাড়িয়েছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। রিপোর্টটিতে আরো একটি জরুরি কথা উল্লেখ করেছে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে মার্কিন অস্ত্র ব্যবসায় মন্দা আসার কোনো আশঙ্কা নেই।

গণতন্ত্রের অস্ত্রাগার : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডেলানো রুজভেল্ট আমেরিকান অস্ত্রশিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘গণতন্ত্রের অস্ত্রাগার’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। কোম্পানিগুলোর মুনাফা এবং মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির ওপর তাদের প্রভাব গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। মার্কিন ঠিকাদাররা বিশ্বব্যাপী অস্ত্র ব্যবসার ৩৯ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। ওয়াশিংটনে সবচেয়ে বড় লবিস্ট বা তদবিরকারীদের মধ্যে রয়েছে প্রতিরক্ষা ঠিকাদাররা। ২০১৯ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দেখিয়েছে, যেসব দেশে দমনপীড়নমূলক শাসনব্যবস্থা রয়েছে; সেসব দেশে অস্ত্র বিক্রি অনুমোদন দিতে কীভাবে তারা কংগ্রেস সদস্যদের রাজি করায়। দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ইসরায়েলের দাপুটে ৫টি লবি গ্রুপ আমেরিকান-ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির তুলনায় কংগ্রেসে লবিংয়ের ক্ষেত্রে তিন থেকে পাঁচ গুণ বেশি সময় ব্যয় করে। যুক্তরাষ্ট্রের সমরাস্ত্রশিল্প খাত মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির আদলে একটি গোপন হাত হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এমনকি অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধ বাধানোর ক্ষেত্রেও। মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার ১৯৬১ সালে তার বিদায়ী ভাষণে এ বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। তার কথার সত্যতা মেলে পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম যুদ্ধে ভয়ঙ্করভাবে জড়িয়ে পড়ে। সেই পরাজয়ের গøানি ¤øান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবারো অনেক ব্যয়বহুল ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধে জড়িয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র। উচ্চপদস্থ মার্কিন নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের বিরোধিতাকে উড়িয়ে দিয়ে ৯০ দশকের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিরক্ষা ঠিকাদাররা ন্যাটো সম্প্রসারণের পক্ষে ওকালতি করেছিল। স্নায়ুযুদ্ধ শেষে বিশ্বে অস্ত্রের চাহিদা কমে আসছিল। প্রতিরক্ষা ঠিকাদাররা তখন ন্যাটোর সম্প্রসারণ চায়। ন্যাটোতে হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড ও চেকপ্রজাতন্ত্রের যোগদানের জন্য মার্কিন সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর জোর লবিং ছিল। এই ব্যাপক অস্ত্র ব্যবসার বিষয়টি ডেমোক্রেটিক ইউএস সিনেটর টম হারকিনের চোখ এড়ায়নি। তিনি ১৯৯৭ সালে সিনেটের এক শুনানিতে ক্লিনটন প্রশাসনের ন্যাটো স¤প্রসারণের জন্য চাপকে ‘প্রতিরক্ষা ঠিকাদারদের জন্য একটি মার্শাল প্ল্যান’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। ফিনল্যান্ড ও সুইডেনকে ন্যাটোতে যুক্ত করা একইভাবে মার্কিন প্রতিরক্ষা ঠিকাদারদের জন্য একটি নতুন বাজার। ইউক্রেনে হিমার্স সহায়তা তো প্রকাশ্যেই ঠিকাদারদের তৎপরতা হিসেবেই দেখছে বিশেষজ্ঞরা। স্টকহোমের আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণাকেন্দ্রের রিপোর্ট বলছে ইউক্রেনকে সহযোগিতার জন্য হাই মোবিলিটি আর্টিলারি রকেট সিস্টেমস বা হিমার্সের উৎপাদন বাড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

ইউরোপও পিছিয়ে নেই: গত ৫ বছরে ইউরোপে অস্ত্রের ব্যবসা বেড়েছে কয়েকগুণ। সুইডেনভিত্তিক স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিপরি) বলছে, বিশ্বের অন্যান্য এলাকায় করোনার কারণে অস্ত্র ব্যবসা কমলেও ইউরোপে বেড়েছে প্রায় ২০ গুণ। সিপরির ডিরেক্টর ইয়ান এন্টনি ডয়েচে ভেলেকে বলেছেন, ২০১৪ সালের পর থেকে ইউরোপের প্রতিটি দেশেই অস্ত্রের উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুণ। গত ৫ বছরে রাশিয়ার অস্ত্র বিক্রি কমলেও জার্মানির অস্ত্র ব্যবসা বেড়েছে ৫ গুণ। গত মে মাসে ইইউ প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর জন্য ১৯ হাজার ৯০০ কোটি মার্কিন ডলারের অনুমোদন দেয়।

শান্তির কথা যারা বলেন : সম্প্রতি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ভাষণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত জোর গলায় বলেছেন, অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে। এর আগেও তিনি বিভিন্ন ফোরামে বর্তমান বিশ্বের যুদ্ধ উন্মাদনার পেছনে অস্ত্র ব্যবসাকেই নেপথ্য কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এছাড়া বিশ্বজুড়ে শান্তির কথা বলছেন অনেকে- বিশিষ্টজন থেকে রাষ্ট্রনেতা সবাই। কিন্তু বাস্তবে কি তার কোনো প্রভাব পড়ছে? বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশ্ব নেতারা শান্তির কথা বলেন। অস্ত্র নয়, মানুষের মুখে খাবারের কথা বলেন। কিন্তু তাদের কথায় এবং কাজে যে বিস্তর ফারাক। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা তা চোখে আঙুল দেখিয়ে দিলেন। রিপোর্ট বলছে, করোনা মহামারির কারণে গোটা বিশ্ব যেখানে বিপর্যস্ত, অর্থনীতি ছিল সংকটে, তখনো বন্ধ হয়নি অস্ত্র ব্যবসা। বরং ২০২০ সালে বিশ্বজুড়ে বেড়েছে অস্ত্র ব্যবসা, কেনাবেচা। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মতে, ২০২০ সালে বিশ্বের অর্থনীতি হ্রাস পেয়েছে ৩ শতাংশ; অথচ অস্ত্রের ব্যবসা বেড়েছে ১ দশমিক ৩ শতাংশ।

প্রাণের চেয়ে বারুদের মূল্য বেশি: এই মুহূর্তে বিশ্বে ৫ দিনের অস্ত্র কেনার জন্য যে খরচ হয়, তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০ বছরের গুটি বসন্তের উচ্ছেদ কর্মসূচির খরচের সমান। বিশ্বে প্রতি এক লাখ লোকের বিপরীতে আছে ৫৫৬ জন সেনা। কিন্তু এই লাখ মানুষের জন্যে আছে মাত্র ৮৫ জন ডাক্তার। প্রতিটি সেনার জন্য বছরে খরচ হয় ২০ হাজার ডলার; অথচ প্রতিটি স্কুলগামী শিশুর জন্য খরচ হচ্ছে বছরে ৩৮০ ডলার। এক সপ্তাহের সামরিক খরচ দিয়ে সারাবিশ্বের মানুষের এক সপ্তাহের খাবারের ব্যবস্থা করা যায়।

গণতন্ত্রের সবক: মার্কিন এসব অস্ত্র কারখানার ঠিকাদাররা বা তাদের নিযুক্ত কর্মকর্তারা অনেক দেশেই যখন গণতন্ত্র বা মানবাধিকার নিয়ে, সুশাসন নিয়ে, শান্তি নিয়ে প্রচারণা চালান বা নিষেধাজ্ঞা দেন; তখন বিশেষজ্ঞরা বলেন- এভাবে অস্ত্র ব্যবসা বাড়তে থাকলে ভবিষ্যতে আরো বড় অশান্তির আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App