×

মুক্তচিন্তা

প্রশাসনিক সংস্কারের রূপরেখা প্রণেতা এ টি এম শামসুল হক

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০২২, ১২:৪১ এএম

২০ জুলাই প্রয়াত হলেন ১৯৬০ ব্যাচের সিএসপি কর্মকর্তা, সাবেক সচিব এ টি এম শামসুল হক। একই ব্যাচের সাবেক সচিব নুরুন্নবী চৌধুরী কিছুকাল আগে বিদায় নিয়েছেন। চাকরিসূত্রে আমার চেয়ে আড়াই যুগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এ টি এম শামসুল হকের সঙ্গে আমার কমই যোগাযোগ হয়েছে। ১৯৯০-এর দশকের শেষভাগে তিনি জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। প্রশাসনের রাজনীতিকীকরণ রোধ করতে কিংবা আরো বৃদ্ধি করতে কী করণীয় এ নিয়ে আমার কিছু কথা তাকে শোনাতে চেয়েছি ও পেরেছি। তিনি যে তা গ্রহণ করতে অসম্মত, তা তাৎক্ষণিকভাবে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। আমি বলি, তাহলে বরং প্রশাসনের রাজনীতিকীকরণকে স্বীকৃতি দিয়ে আমরা ‘স্পয়েল সিস্টেম’-কে কবুল করে নিই। আমার প্রস্তাব শুনে তিনি বললেন, ‘ইটস টুও আর্লি, গ্রাউন্ড ইজ নট রেডি’। একদা তিনি যে চেয়ারে বসেছেন, তিন দশক বছর পর সেই ঢাকার ডেপুটি কমিশনার ও ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের চেয়ারে আমিও বসি। তিনি ফোন করতেই বললাম, স্যার, আপনার পুরনো অফিসটা দেখে যান। তিনি জবাব দিলেন, সময়টা তখন ভালো ছিল না, স্মৃতিগুলো খুব ভালো নয়, কাজেই আসতে চাই না। ১৯৩৭-এর জানুয়ারি কুমিল্লার দেবিদ্বারে তার জন্ম। স্মৃতিকথা লিখেছেন ‘মোজাইক অব মেমোরিজ’। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর সংবাদ যে বিষণ্নতার ছায়া ফেলেছিল তার স্মৃতিকথার শুরুটা তখন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের টুকরো স্মৃতিও তিনি ধারণ করে আছেন। মেধাবী ছাত্র ছিলেন, সুতরাং, সামনের পথ ছিল অবারিত। ৩৩ বছর আমলাতন্ত্রের অংশীদার ছিলেন, আন্তর্জাতিক সংস্থায় নির্বাহী প্রধান ছিলেন, আইন ব্যবসায়ও নাম লিখিয়েছেন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন রেখে যেতে পেরেছেন। আমার লেখাটি দুই পর্বের- প্রথম পর্বে তার ইংরেজিতে রচিত স্মৃতিকথনের কিছু অনুবাদ/অনুস্মৃতিও দ্বিতীয় পর্বে তার কমিশনের সুপারিশ করা সংস্কার প্রস্তাব এবং এসব প্রস্তাবের নিয়তি।

স্মৃতির মোজাইক ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে ডেপুটি কমিশনার হিসেবে আমার পোস্টিং হলো বরিশাল (জেলা সদর এবং বাকেরগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় নাম বরিশাল)। ১৯৬১-৬২ সহকারী কমিশনার হিসেবে এখানেই কাজ করেছি- এটা বরিশালে আমার দ্বিতীয় পোস্টিং। কাজেই জায়গাও নতুন নয়, আর জেলার নেতৃস্থানীয় অনেকের সঙ্গেই আমার পরিচিতি পুরনো। …ডিসির পুলে তিনটি অত্যন্ত ভালো ও নির্ভরযোগ্য লঞ্চ ছিল- মেরি কইন, মার্গারেট এবং উইনিফ্রেড। শেষেরটা সমুদ্রগামী। তখনকার বরিশাল জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল আজকের বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী এবং বরগুনা- এখনকার ছয়টি জেলা। ভোলা যাওয়ার পথে পটুয়াখালীর আগুনমুখা নদীর যে উত্তাল ঢেউয়ের মুখোমুখি আমাদের হতে হতো, তা স্পষ্টই মনে পড়ছে। তারপরও বরিশালে ডিসি থাকা অবস্থায় আমি মাসে এক পক্ষকাল সফরেই থাকতাম। সে সময় আমি অবিভক্ত বরিশালের তখনকার ৩৪টি থানার প্রত্যেকটিতে সফর করেছি- এটা একটা দুর্লভ কৃতিত্ব। সহস্র অপরাধীর আখড়া হিসেবে তখন বরিশাল সুপরিচিত। সবচেয়ে জঘন্য ধরনের অপরাধে জড়িত বহুসংখ্যক গ্যাং কেইস সেসন্স কিংবা হাইকোর্টে বিচারের অপেক্ষায় বহু বছর ধরে পড়ে থাকছে। কেমন করে কমবয়সি নিষ্পাপ তরুণদের অপরাধ কর্মে হাতেখড়ি দেওয়া হয় সে কাহিনী তো মুখে মুখে প্রচলিত। এমনকি বাবা, চাচা ও বড় ভাইয়ের মতো নিকটাত্মীয়রা (বলাবাহুল্য তারাও ডাকাতি ও অপরাধমূলক পেশায় জড়িত) তরুণদের অপরাধ জগতে টেনে আনে। যতদিন না এই তরুণদের বিরুদ্ধে কিছু মামলা রুজু হচ্ছে, যতদিন না তারা জেলহাজত খাটছে তাদের সাবালক মনে করা হয় না। কোনো কোনো অপরাধের আগে তারা রিহার্সেল করতে মিথ্যে অভিযোগ এনে নিকটাত্মীয়দেরও খুন-জখম করে থাকে। আরো দক্ষিণে, ঐতিহাসিকভাবেই পর্তুগিজ জলদস্যু ও আরাকানি ডাকাতরা লুটপাট করেই জীবনধারণ করত। তাদের উত্তরসূরিদের এখনো শনাক্ত করা যায়। বরিশালের ইতিহাসে এমন কোনো ডিসি পাওয়া যাবে না যাকে কোনো না কোনো সময় জলোচ্ছ¡াস ও সাইক্লোন মোকাবিলা করতে হয়নি। আমিই সেই ভাগ্যবানদের একজন, অতিকায় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি না হয়ে কার্যকালটা পার করতে পেরেছি। আমি বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও উন্নয়নমূলক কাজ করা সময় পেয়েছি। সে সময় দুর্লভ এইচ বেভারিজের ‘দ্য ডিস্ট্রিট অব বাকেরগঞ্জ’ গেজেটিয়ার পুনর্মুদ্রণ করেছি। (উন্নয়ন কর্মের বিস্তারিত বিবরণ গ্রন্থ আছে)। বরিশাল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য বরাবরই আকুল, এমন এক ক্ষেত্র। তখন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অনেকেই কারান্তরালে। জেলখানায় তাদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা ষোলো আনাই দেওয়া হচ্ছে। তাদের একজন আবদুর রব সেরনিয়াবাত, ১৯৭৫-এর অভ্যুত্থানে পরিবারের ক’জন সদস্যের সঙ্গে নিহত হন। তিনি তার মেয়ের বিয়েতে আমাকে নিমন্ত্রণ করতে এলেন এবং জানালেন তার ব্রাদার-ইন-ল শেখ মুজিবুর রহমান বিয়েতে আসবেন। তিনি আমাকে জানালেন, তার থাকার জন্য যেন একটি সুবিধাজনক ব্যবস্থা করি। আমি বললাম, সার্কিট হউসের এক নম্বর রুম তার জন্য সংরক্ষিত থাকবে। বিরোধী নেতাদের ব্যাপারে সরকারের উদার হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। টাঙ্গাইল জেলা পরিষদ বাংলোর ব্যাপারে এসডিও হিসেবে আমি একই নীতি অনুসরণ করতাম। শেখ মুজিব আমার সঙ্গে তোফায়েল আহমেদের পরিচয় করিয়ে দিলেন, তার বাড়ি ভোলা এবং তিনি একজন নেতৃস্থানীয় ছাত্রনেতা, তিনি জেলা প্রশাসনের জন্য কখনো কোনো সমস্যা সৃষ্টি করেননি। আমি তাকে যেমন পেয়েছি তাতে তিনি যুক্তিসম্মত মানুষ এবং আচরণে বিনয়ী। গণঅভ্যুত্থান যখন তুঙ্গে তখন সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হলো। একবার একটা বড় মিছিল এসে কালেক্টরেট ভবন ঘেরাও ভয়ঙ্কর রকম ইটপাথর ছুড়তে শুরু করে। যখন বুঝিয়ে শুনিয়ে তাদের নিরস্ত্র করা গেল না, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল, সেনাবাহিনীর জওয়ানরা গুলি চালাল। এতে অনেকে আঘাত পেল, একজন ছাত্রের মারাত্মক জখম হলো। আমার অবস্থান নেতৃবৃন্দ জানতেন বলেই আমি যখন আহত ছাত্রকে দেখতে হাসপাতালে যাই কোনো সমস্যা হয়নি। ২৫ মার্চ ১৯৬৯ জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন জারি করলেন। সামরিক আইনের ঘোষণার কয়েক দিন আগেই আমি জেনেছি বরিশাল শহরের কাছাকাছি একটি জায়গায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঘাঁটি গেড়েছে। ঘোষণার পরপরই পরিপাটি পোশাক পরা একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল আমার সঙ্গে দেখা করতে ডিসি বাংলোতে এলেন। সে সময়ও সেনা কর্মকর্তারা সামাজিক পদসোপানে তাদের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। সামরিক আইনের আওতায় দায়িত্ব পালন করতে তিনি আমার সহায়তা চাইলেন। তিনি বরিশালের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন বলে জানালেন। সে সময় আমার সঙ্গে তিনজন কনিষ্ঠ পশ্চিম পাকিস্তানি সিএসপি অফিসার কাজ করছিলেন- পিরোজপুর ও পটুয়াখালীর এসডিও এবং বাকেরগঞ্জের এডিসি জেনারেল। বরিশালে আমার চাকরি জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সময় কেটেছে, একবার শিক্ষানবিশকালে এবং পরে জেলা প্রশাসক হিসেবে মোট তিন বছর। ১৯৬৯-এর ১ জানুয়ারি বৃহত্তর বাকেরগঞ্জ জেলা দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল- বরিশাল ও পটুয়াখালী (একই দিনে টাঙ্গাইলও জেলায় রূপান্তরিত হয়)। নতুন জেলা পটুয়াখালীতে অনুষ্ঠিত একটি বড় উৎসবের মধ্যে আমি দায়িত্ব হস্তান্তর করলাম। এদিকে বরিশাল নাম নিয়ে আপত্তি উঠল। ঐতিহাসিক পরম্পরায় বাকেরগঞ্জ রাখার দাবিই উঠল। ১০ দিন পর সরকারি ঘোষণার মাধ্যমে বরিশালের নাম হলো বাকেরগঞ্জ। ডিসির নামের বোর্ডে তিনবার আমার নাম উঠল- অবিভক্ত বাকেরগঞ্জ জেলার শেষ ডিসি, বরিশাল জেলার একজন ডিসি, বিভক্ত বাকেরগঞ্জ জেলার প্রথম ডিসি। (২৬ জানুয়ারি ১৯৭০ টেলিফোনে জানলেন এবং টেলিগ্রামও পেলেন যে তাকে ঢাকার ডিসি হিসেবে বদলি করা হয়েছে।)

ঢাকা পর্বের একাংশ-একাত্তরের ডিসি বেসামরিক প্রশাসন একেবারেই নখদন্তহীন। তার পরও আমরা বাঙালি চাকরিজীবী ও জনগণকে যতটা সম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাবের বন্দুক লুট ঠেকাতে ব্যর্থতার জন্য নারায়ণগঞ্জের এসডিও হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। মুন্সীগঞ্জ মালখানার অস্ত্র স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি লুট করে নিয়ে গেছে তা রক্ষা করতে ব্যর্থতার দায় বর্তেছে মুন্সীগঞ্জের এসডিওর ওপর। ১৯৬৫ ব্যাচের ইপিসিএস কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুস সামাদ ঢাকা জেলার (এখন নরসিংদী) রায়পুরার থানা ম্যাজিস্ট্রেট ২৫ মার্চের আগে থেকেই আন্দোলনকারীদের সহযোগী ছিলেন এই অভিযোগে সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ তাকে বাগে পেতে চাচ্ছিল। কিন্তু এ সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই ছিল না। একাত্তরের এপ্রিলের শেষ কিংবা মে মাসের প্রথম দিকে তিনি দেখা করতে আমার আবাসিক অফিসে এলেন। তার ব্যাপারে সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের ধারণা তাকে জানালাম এবং আমার সঙ্গে গাড়িতে অফিসে এনে বললাম, যেন তিনি দ্রুত জনতার সঙ্গে মিশে নিরুদ্দেশ হয়ে যান, যতক্ষণ না নিজের নিরাপত্তা সম্বন্ধে নিশ্চিত হচ্ছেন যেন দেখা না দেন। সামাদ পরে আমাকে নিশ্চিত করেছেন যে ১৬ ডিসেম্বরের পরই তিনি মুক্তাঙ্গনে বেরিয়ে এসেছেন। আমার কনিষ্ঠ সিএসপি সহকর্মী এবং আমার অধীনে শিক্ষানবিশ কর্মকর্তা সৈয়দ রেজাউল হায়াত ছিলেন মাদারিপুরের এসডিও (পরে সরকারের সচিব) তাকে ঢাকায় এনে বন্দি করা হয়। টাঙ্গাইলের ডিসি জালালউদ্দিন আহমেদকেও (পরে সরকারের সচিব) তাই করা হয়। তিনিও সিএসপিদের একজন, কর্মজীবনের শেষভাগ তিনি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে কাজ করেছেন। শত শত এ ধরনের ঘটনার কয়েকটি মাত্র উল্লেখ করলাম- এসব আমাদের নজরে এসেছে আমরা চেষ্টা করেছি কোনো না কোনোভাবে তাদের রক্ষা করতে, তাদের অনেকেই সৌভাগ্যবশত বেঁচে গেছেন। সাব-মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একটি সভায় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না নেয়ার কারণে আমাকে দোষারোপ করা হয়। শুরুর দিকে ছোটখাটো সাহায্য চাওয়া ছাড়া সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ আমাকে কোনো জ¦ালাতন করেনি। দু-তিন মাস পর এক বিকালে পশ্চিম পাকিস্তানি একজন পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট ডিসির বাসভবনে এসে আমাকে দেয়ার জন্য তার ভিজিটিং কার্ড দিলেন। আমি নিচতলায় নেমে আসতেই স্মার্ট স্যালুট টুকে আমার সঙ্গে বন্ধুসুলভ হতে চেষ্টা করলেন। প্রাথমিক সৌজন্য বিনিময়ের পর তিনি আমার কাছে ২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউনের আগের ও পরের ঘটনা শুনতে চাইলেন। প্রথম দিন আলাপ দীর্ঘ না করে তিনি মাঝে মাঝেই আমার সঙ্গে দেখা করবেন বলে জানালেন। ধীরে ধীরে তার নোংরা চেহারা বেরিয়ে এলো। আমাকে মিন্টো রোডে ইন্টারোগেশন সেল-এ যেতে বলা হলো। আমি বুঝতে পারলাম আমাকে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলায় সাক্ষী বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। জানানো হলো যে আমাকে বলতে হবে শেখ মুজিবের ইচ্ছেতে ভারত থেকে ইকবাল হলে অস্ত্র ও গোলাবারুদ আনা হয়েছে। আমাকে আরো সাক্ষ্য দিতে হবে যে, শেখ মুজিবের নির্দেশেই নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাব লুট হয়েছে- এ ধরনের আরো বিষয়। বেশ কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদের পর তারা বুঝতে পারল আমাকে টলানো সহজ হবে না, তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। শেষ দিন একটি দীর্ঘ বিবৃতি, যাতে আমাকে জড়িত করা হয়েছে এমন একটির তলায় ডটেড লাইনের ওপর আমাকে স্বাক্ষর করতে বলা হয়। আমাকে দ্বিধান্বিত দেখে তাদের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা চিৎকার করে জানালেন যে আমি তাদের সহযোগিতা করছি না। কাজেই আমার সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া উচিত এবং অসহযোগিতার পরিণতি আমাকে টের পেতে হবে। যখন হাজার হাজার মানুষ জওয়ানদের ভয়ে তটস্ত এমন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার হুমকিতে আমি সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লাম। এখন আমি যখন পেছন ফিরে তাকাই কেমন করে যে সেই কক্ষ থেকে বেরিয়ে পুলিশ বডিগার্ডকে নিয়ে গাড়িতে উঠি, তা মনে করতে পারি না। ড্রাইভারকে বলি স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি মেজবাহউদ্দিনের বাড়িতে যেতে; তিনি আল্লাহভক্ত মানুষ এবং আমার প্রতিবেশী। আমার কাছে সব শুনে তিনি বললেন সবকিছুর জন্য আল্লাহ অসীম রহমতের ওপর ভরসা করে দ্রুত যেন চিফ সেক্রেটারি শফিউল আজমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তিনি জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে আমার একটি বৈঠক করিয়ে দিতে পারবেন। আমি সচিবালয়ে আসি এবং চিফ সেক্রেটারির সঙ্গে সাক্ষাতের অনুরোধ জানাই। আসলে আমি ভাবছিলাম সম্ভবত আমার দিন শেষ হয়ে এসেছে। এত মানুষ ও এত অফিসারদের যেখানে হত্যা করা হচ্ছে সেখানে আমাকে তুলে কোনো নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে হত্যা না করার কোনো কারণ নেই। শফিউল আজমের ভায়রা সিরাজগঞ্জের এসডিও এবং আমাদের কনিষ্ঠ কর্মকর্তা শামসুদ্দিন আহমেদকে ক’দিন আগে ক্যান্টনমেন্টে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। জানা যায় শফিউল আজম নিজেই তার ভায়রাকে সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে প্রভাবিত করেছেন- এই আশায় যেহেতু তিনি চিফ সেক্রেটারির আত্মীয় তার নিশ্চয়ই কোনো ক্ষতি হবে না। কয়েক দিন পর আত্মীয়রা যখন ক্যান্টনমেন্টে তার খোঁজ করলেন তাদের বলা হলো তিনি এখানে নেই। যখন কাউকে মেরে ফেলা হয়, তারা সাধারণত এই ভাষাই ব্যবহার করে থাকে। ভায়রাকে আত্মসমর্পণে প্রভাবিত করার জন্য আত্মীয়দের অনেকেই শফিউল আজমকেই দোষ দিয়ে থাকেন। আমি যখন আমার বিষয়টি শফিউল আজমকে বললাম তিনি তখনই হটলাইনে ফরমান আলীর সঙ্গে কথা বললেন। তিনি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে সম্মত হলেন। আমি গবর্নমেন্ট হাউসে (বঙ্গভবন) পৌঁছতেই আমাকে ফরমান আলীর কক্ষে ডাকা হলো, যদিও তিনি আমাকে চিনতেন। আমি দাঁড়িয়েছিলাম- আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন জয়েন্ট ইন্টারোগেশনের লোকদের সঙ্গে আমার অসহযোগিতার রিপোর্ট তিনি পেয়েছেন। আমি যখন সবিনয়ে বললাম নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাব কে লুট করেছে, কিংবা কে ইকবাল হলে ভারতীয় অস্ত্র এনে জমিয়েছে? ডিসি হিসেবে তা আমার জানার কথা নয়- তিনি নিশ্চুপ রইলেন। আমি বললাম, কেমন করে আমি নিজেকে জড়িয়ে বিবৃতিতে সই দেব? কিছুক্ষণ পর তিনি আমাকে চলে যেতে বললেন। তার মনে কি আছে তা বোঝা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তখনো আমি ঘোরের মধ্যে আছি। সব ধরনের আশঙ্কা নিয়ে আমি মিন্টো রোডে আমার বাসায় পৌঁছলাম। পরদিন ইসলামাবাদে আমার বদলির আদেশ পেলাম।

ঢাকা থেকে ইসলামাবাদে বদলির আদেশ পেয়েই আমি চিফ সেক্রেটারি শফিউল আজমের কাছে ছুটলাম। আমার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা, আমাকে যেন ছুটি দেওয়া হয়। আসলে আমার স্ত্রীর অবস্থা পশ্চিম পাকিস্তানে যাওয়া এড়াতে আমার জন্য একটি ভালো অজুহাত হয়ে গেল। শফিউল আজম আমাকে তার অফিস চেম্বারে ডাকলেন এবং তার অভ্যাস অনুযায়ী চড়া গলায় আমাকে শুনিয়ে দিলেন জীবন বাঁচাতে চাইলে পরবর্তী প্রথম ফ্লাইটে ইসলামাবাদ চলে যাও। এ টি এম শামসুল হক তাই করলেন। এ টি এম শামসুল হকের মতোই সিএসপি মুক্তিযোদ্ধা আকবর আলি খান, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পদত্যাগ করা উপদেষ্টা যে আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ লিখেছেন তাতে মুক্তিযুদ্ধে যোগ না দেয়া সিএসপি কর্মকর্তাদের বেদম ধোলাই করেছেন; তিনি মনে করেন স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেয়া ১৪ জন সিএসপি বাদে অন্য সবাই চাকরি অব্যাহত রেখে প্রকারান্তরে পাকিস্তান সরকারকে শক্তিশালী করেছেন। অন্যদিকে এ টি এম শামসুল হক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রিয়ভাজন ছিলেন, দ্রুত পদোন্নতি পেয়ে একাধিক মন্ত্রণালয়ে সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন, আওয়ামী লীগ তাকে সাগ্রহে মনোনয়ন দিয়েছে, তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য পদে নির্বাচন করেছেন এবং তার ভাষায় স্থানীয় পর্যায়ে দলীয় বিরোধিতার কারণে নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। আমার বিবেচনায় তার আমলাতান্ত্রিক ও রাজনীতিক কর্মকাণ্ডের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক সংস্কারের রূপরেখা প্রণয়ন।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App