×

মুক্তচিন্তা

নোংরা-কদাকার নাম সাফ জরুরি

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০২২, ১২:৪০ এএম

পঞ্চগড়ের করতোয়া নদীতে নৌকাডুবি, প্রাণহানির খবর পরিপূর্ণ করতে দুয়েকবার হলেও এসে যাচ্ছে বোদা এলাকার নাম। জায়গাটিতে নৌকাডুবির তথ্য দিতে গিয়ে নাম উচ্চারণ করতে গেলে ঠোঁট-জিহ্বা আটকে যায়। অথচ মৌজা, সিএস, আরএস, কাগজে-কলমে, সাইন বোর্ডে বোদা বাংলাদেশের একটি প্রশাসনিক এলাকা। থানা-উপজেলা। রংপুর বিভাগের পঞ্চগড় জেলার অন্তর্ভুক্ত এ উপজেলাটি ২র্র্র্র্৬র্ ০র্৫ উত্তর অক্ষাংশ হতে ২র্র্র্র্৬র্ ২র্৩ উত্তর অক্ষাংশের এবং ৮র্র্র্র্৮র্ ২র্৭ পূর্ব দ্রাঘিমা হতে ৮র্র্র্র্৮র্ ৪র্৬ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত। ৩৪৯.৪৭ বর্গকিমি আয়তনের এই উপজেলাটি উচ্চারণ শুনতে-বলতেই সমস্যা নয়, নাম লিখে গুগল সার্চ করলেই ভেসে ওঠে দুঃখজনক যত ছবি। বাংলাদেশে কিছু এলাকা বা অঞ্চল রয়েছে যেখানে, এ শব্দটি কেবল অসুন্দর নয়, চরম অশ্লীলও। কতক্ষণ সম্ভব একটি নাম উল্লেখ না করা? না মুখে না কলমে। কোনোভাবেই নয়। কঠিন এ বাস্তবতায় জায়গাটির নাম পরিবর্তনের দাবি উঠেছে অনেকবার। কিন্তু দাবি জোরালো হয়নি। আমলও পায়নি সরকারের ওপর মহলে। তবে ‘মানুষমারা জায়গাকে ‘মানুষগড়া’ করার দৃষ্টান্ত আছে। ১০ কাজের এক কাজের মতো তা করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। নীলফামারী সদরের ‘মানুষমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’-এর নাম পাল্টে নতুন নামকরণ হয়েছে ‘মানুষগড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। এ মর্মে প্রজ্ঞাপন জারির মধ্য দিয়ে শুধু স্কুল নয়, পাল্টে গেল জায়গাটির নামও। এই নাম নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন মহলের আপত্তি অনেক দিনের। চিত্ত-পিত্ত দুটোই পুড়ছিল তাদের। অবশেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তা আমলে নিয়ে বিশ্রি নামটি পাল্টে দিয়েছে। চমৎকারের চেয়েও চমৎকার এমন কাজটি করা হয়েছে বিশেষত শিক্ষাসংশ্লিষ্টতার কারণে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পৃক্ত না হলে এমন সিদ্ধান্ত আসত কি না, বলা যায় না। বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রাম এবং অসংখ্য জায়গার মধ্যে ‘মানুষমারা’র চেয়েও কুৎসিত, বীভৎস, উচ্চারণ অযোগ্য বহু নাম রয়েছে। কোনো কোনোটি ভদ্র-শিক্ষিত কারো সামনে উচ্চারণ করা কষ্টকর-লজ্জাকর। কোনো কোনোটির নাম উচ্চারণ এড়াতে অর্ধেক বলে থেমে যেতে হয়। অথবা কাগজে লিখে দেখাতে হয়। মনে-প্রাণে ঘৃণা করলেও নামগুলো দলিল-মৌজা, খতিয়ান এমনকি বইপত্রসহ মুদ্রণে অটুট থাকছে। উপজেলা, থানা, গ্রাম, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মক্তব, হাট-বাজারের সঙ্গেও লেপ্টে আছে জঘন্য যত নাম। বড় অক্ষরে লেখা আছে সাইন বোর্ডেও। বড় বড় সাইন বোর্ড-পিলারে বোদা, সোনাখাড়া, সোনাপোতা, ধনবাড়ী, ধনাগোদা, আঙুলদিয়ার মতো নামে চোখ ফেলা ভীষণ কষ্টের। মুখে আনা আরো পীড়াদায়ক। জিহ্বা হার্ডব্রেক হয়ে যায় নিমিষেই। লাজশরমের মাথা হেট হয়ে আসে। জায়গার নাম বলে মুখ লুকাতে হয়। শ্রোতাও থমকে যায়। পঞ্চগড়ের ‘বোদা’ নামটি উচ্চারণ করতে মন-মননে গুরুচরণ দশা হয় সেখানকার মানুষের। তারা নাম পাল্টানোর দাবি করেছে বহুবার। কিন্তু উচ্চকণ্ঠে নয়। মিউমিউ স্বরে। মিনমিন করে মুখ লুকিয়ে। কারণ আন্দোলন তেজি করতে গেলেও শব্দটি বারবার মুখে আনতে হয়। বোদা গার্লস স্কুল, বোদা মহিলা কলেজ উচ্চারণ করতে গিয়ে কী বেদনা সইতে হয়, তা ভুক্তভোগীরা হাড়ে হাড়ে টের পান। ওই এলাকার সাবেক এক সংসদ সদস্য কখনো এলাকার নাম মুখে নিতেন না। বারবার বলতেন, আমার এলাকা, আমার এলাকা। কখনো বলতেন, পঞ্চগড়-২। বোদার মতো বালধরা, সোনাখাড়া, ধনবাড়ী নামগুলোও ওইসব এলাকার মানুষ ঠেকায় পড়ে উচ্চারণে বাধ্য হয়। উচ্চারণ না করে কেউ কেউ ইশারায়ও এলাকার নাম বোঝানোর চেষ্টা করে। কুত্তামারা, সোনাডাঙ্গা, ছাগীপাড়া স্পষ্ট উচ্চারণও বিব্রতকর। চৌকিদেখি, ভাঙ্গা, হাঁটুভাঙ্গা, ভেড়ামারা, ঠেঙ্গামারা, ছেঙ্গারচর, কাউয়ারচর, ফাজিলপুর, ভুয়াপুর, ভূরুঙ্গামারী, ধরি কিলা, ভূতেরগলি, শনিরআখড়া, পাগলা ধরনের নাম বলতে-শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেলেও কিছুটা অস্বস্তি থেকেই যায়। যতই বলা হোক, নামে কিছু যায়-আসে না। আসলে নামে অনেক কিছুই যায়-আসে। নামের ভ্যালু থাকার কারণে মানুষ নামের পেছনে কম ছোটে না। তা নাম বা বানানের সঙ্গে কাজের মিল না থাকলেও। নামের বাহার কখনো কখনো অবান্তর-অসহ্য লাগলেও। ইতিহাস বা হাল ঠিকানার কারণে ঢাকা শহরের অন্যতম অশান্তির জায়গা হাঁটু পানিতে ডুবে থাকা শান্তিনগরের নাম পাল্টাতে গেলে হয়তো লঙ্কাকাণ্ড ঘটবে। ভূতেরগলি নাম শুনলে মনে হতে পারে এ রাস্তায় বা গলিতে ভূতেরা চলাফেরা করত। একটি কাঁঠাল গাছও খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ নাম তার কাঁঠাল বাগান। এমন অনেক বাগ বা বাগান আছে ঢাকায়। পরিবাগ, মালিবাগ, মীরবাগ, শান্তিবাগ, গোলাপবাগ, হাজারীবাগ, চামেলিবাগ, সবুজবাগ, রায়েরবাগ, গোপীবাগ, পেয়ারাবাগ, ইসলামবাগ, গুলবাগসহ কত বাগ! সারি সারি দালানকোঠায় ভরা এলাকার নাম মহাখালী। একচিলতা খালি জায়গাও নেই মহাখালীতে। পুরান ঢাকার এক গলির নাম পাতলা খান লেন। মোটা মানুষ কি সেই লেনে ঢুকতে পারে না? আবার চট্টগ্রামে এক শহরের মাঝে কমপক্ষে ২০ শহর। ষোলশহর এবং হালিশহর। উত্তরবঙ্গে আছে কুড়িগ্রাম। একইভাবে বিশাল উপজেলা ও নির্বাচনী এলাকা কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম। একটু হাসি-রসিকতা থাকলেও এসব নাম সয়ে গেছে। এছাড়া এগুলো তত কদাকারও নয়। কিন্তু বোদা, সোনাখাড়া, ধনবাড়ী উচারণই কঠিন। তেরখাদা, পাগলা, মতলব, বুড়িমারী, চ্যাংড়াবান্ধা, ঠ্যাঙ্গামারা, ঠেঙ্গারচর, চর কুকড়িমুকড়ি এ ধরনের নামের কখনো কখনো মানেই খুঁজে পাওয়া যায় না। মানুষের ক্ষেত্রে কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন, বোবার নাম সুকথন, কুচকুচে কালো লোকটির নাম লালমিয়া রাখতে বারণ নেই। বরং অবারিত স্বাধীনতা আছে। আমের নাম হিমসাগর-কহিতুর, ফুলের নাম গাঁদা-অপরাজিতা, পাখির নাম বউকথা কও, মিষ্টির নাম বালিশ, বৃষ্টির নাম ইলশেগুঁড়ি, মাছের নাম রূপচাঁদা, ধানের নাম বিন্নি, খেলার নাম গোল্লাছুট, তেলের নাম জবাকুসুম, বাঁশির নাম মোহন, ঝড়ের নাম কালবৈশাখী, সাপের নাম শঙ্খচূড় বা কালনাগিনী হওয়ার পেছনেও বাধা নেই। এসবের পেছনে ইতিহাস-যুক্তি-ঘটনা রয়েছে। কিন্তু জায়গার নামে মনগড়া কাণ্ড কাম্য হতে পারে না। তা হতে হয় প্রেক্ষিত, ইতিহাস-ঐতিহ্য দৃষ্টে। লকানিবাজার, কসাইবাজার, দালালবাজার, মদনপুর-বলদপুর, ফাজিলপুর, হাতিবান্ধা, গাইবান্ধা, ভেড়ামারা, ঘোড়ামারা, ছাগীপাড়া, ছাগলনাইয়া, চ্যাংড়া বান্ধা, ডিংগাডোবার কিছিমের নামের ক্ষেত্রে নানা মিথ থাকলেও গ্রহণ করা কষ্টকর। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের মতো বরিশালের গুয়াটন, ভোলার চরফ্যাশন বা চট্টগ্রামের লাভলেইন- এ ধরনের ইংরেজি নামেরও রহস্য আছে। তা মোটেই বাংলা সিনেমার মতো- ঘাড় তেড়া, মাথা গরম, ক্ষেপা বিশু, পাগলা দিওয়ানা, ভালোবাসা দিবি কিনা বল, ইটিশ পিটিস প্রেম নামকরণের মতো খেয়ালীপনা নয়। আলোচিত ‘মানুষমারা’ নিয়েও কিছু কিচ্ছা ছিল। এরপরও সম্প্রতি সেই নাম পাল্টানো ছোটর মধ্যে একটি মোটাদাগের ঘটনা। প্রতিবাদের টুঁ শব্দও হয়নি। বরং সন্তুষ্টি ব্যাপক। দেশে বিভিন্ন সরকার নতুন করে ক্ষমতায় এলে বিভিন্ন স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠানের নাম বদলের হিড়িক পড়ে। জায়গার নামও পাল্টানো হয়েছে বিভিন্ন সরকার আমলে। পিরোজপুরে ইন্দুরকান্দিকে জিয়ানগর, ঢাকার পাশে বিক্রমপুরকে মুন্সীগঞ্জ, জয়দেবপুরকে গাজীপুর করার রাজনীতি অনেকেরই জানা। পিরোজপুরের স্বরূপকাঠীকে নেছারাবাদ করাও ছিল তেমনই রাজনীতি। কিন্তু নোংরা-কদাকার নামগুলো বদলের রাজনীতি হয়নি। এ নিয়ে তাগিদ আসছে না রাজনীতিকদের মাঝে। বরং সেগুলো অটুট রেখে বিকৃতাচারকে জিইয়ে রাখা হয়েছে। যে কারণেই হোক সরকার সাহস করে বছরখানেক আগে দেশের পাঁচ জেলার নামের ইংরেজি বানান আপডেট করেছে। এ নিয়ে টুকটাক কথা হলেও গুরুতর আপত্তি আসেনি। তখন উপরোল্লিখিত বিভিন্ন জায়গার কদাকার, নোংরা বিদঘুটে নামগুলোরও একটা এফিডেবিট সেরে ফেলা যেত। বছর কয়েক আগে ঘটনাচক্রে বদলে দেয়া হলো মানুষমারাকে। শুধু ওই এলাকা নয়, সব এলাকার মানুষই একে ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছে। মানুষমারাকে মানুষগড়ায় আনার নান্দনিক উদ্যোগে নানান বিশ্রী নামগুলোর ব্যাপারে একটা হিল্লার আশা করা যায়। নির্দ্বিধায় বলা যায়, পুলকিত হয়ে মানুষ তা ইতিবাচকভাবে লুফে নেবে। অনেকের অপেক্ষাও সেই প্রত্যাশায়।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App