×

জাতীয়

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খুনোখুনির নেপথ্যে কারা?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৯:০০ এএম

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খুনোখুনির নেপথ্যে কারা?

ছবি: ভোরের কাগজ

বর্তমানে সক্রিয় অন্তত আটটি সশস্ত্র গ্রুপ

আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজির অর্থের ভাগাভাগি নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চলা ক্রমশ রক্তক্ষয়ী সংঘাতের লাগাম টানা যাচ্ছে না কিছুতেই। উল্টো রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে গড়ে উঠছে বিভিন্ন সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ, যারা বিভিন্ন পাহাড়ে আস্তানা গড়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্প অশান্ত করে তুলেছে। একের পর হত্যা করছে রোহিঙ্গা নেতা, মাঝি ও স্বেচ্ছাসেবকদের। ডাকাতি ও অপহরণের ঘটনাও ঘটছে অহরহ। সেইসঙ্গে রাতের আঁধারে সশস্ত্র মহরা তো আছেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র জানিয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী গ্রুপ গড়ে উঠলেও বর্তমানে সক্রিয় রয়েছে অন্তত ৮টি। যারা কথায় কথায় মানুষ খুন করতেও দ্বিধা করছে না। ওইসব গ্রুপের বেশ কয়েকজন সদস্য আগে গ্রেপ্তার হলেও, বর্তমানে যারা সক্রিয় রয়েছে তাদের গ্রেপ্তারে বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি।

এদিকে, রোহিঙ্গা নেতা ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর আলোড়ন সৃষ্টি হয় বিশ্বজুড়ে। ক্যাম্প ঘিরেও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে পুলিশ। এরপরেও থামেনি খুনোখুনির ঘটনা। পুলিশের তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মুহিবুল্লাহকে হত্যার পর গত এক বছরে আরো ২৭টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। গত ৪ মাসেই ঘটেছে ১৫টি হত্যাকাণ্ড। এর মধ্যে সিক্স-মার্ডার ও ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডে নিহতের ঘটনায় আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসার) অস্তিত্ব নিয়ে কথা ওঠে।

এছাড়াও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), নবী হোসেন গ্রুপ, মুন্না গ্রুপ ও ইসলামী সংগঠন মাহাজের সশস্ত্র কর্মকাণ্ড ক্যাম্পে এখন ওপেন সিক্রেট। এই গ্রুপগুলো ক্যাম্পে শুধু হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটাচ্ছে তা নয়, বিভিন্ন অপরাধ চক্রে যুক্ত হতে রোহিঙ্গাদের বাধ্য করছে। এসব কারণে ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের চরম নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাতে হচ্ছে। বিশেষ করে নতুন আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে ইসলামী সংগঠন মাহাজের সক্রিয় তৎপরতা। এরই মধ্যে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ফেসবুক লাইভে এসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এক মাসে চার মাঝিকে খুনের বিষয়ে ফেসবুক লাইভে বর্ণনা দেন মোহাম্মদ হাশিম (২০) নামে এক যুবক। তিনি নিজেকে ‘ইসলামী মাহাজ’ নামে একটি সংগঠনের সদস্য বলে দাবি করেন।

হাশিম জানান, তার মতো ২৫ জন যুবককে অস্ত্র দিয়েছে ইসলামী সংগঠন মাহাজ। যাদের কাজ হলো হত্যার মিশন বাস্তবায়ন করা। এ কাজের জন্য আমাদের দেয়া হতো মোটা অঙ্কের টাকা। আমাদের মূল কাজ ছিল যারা প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করে, তাদের হত্যা করা। তার দাবি, ১৮ নম্বর ক্যাম্পের হেড মাঝি জাফর, ৭ নম্বর ক্যাম্পের ইসমাঈল, কুতুপালং ক্যাম্প-৪ এর এক্সটেনশনের এইচ ব্লকের এরশাদ ও হেড মাঝি আজিমুল্লাহকে হত্যা করেন তিনি। এ সময় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ ইসলামী মাহাজ সংগঠনের চার মুখপাত্রের নামও বলেন হাশিম। তারা হলেন- জিম্মাদার সাহাব উদ্দিন, রহমত উল্লাহ, হেড মাঝি ভূঁইয়া ও মৌলভী রফিক। লাইভে মোহাম্মদ হাশিম আরো জানান, তাদের সামনে বড় মিশন ছিল। কিন্তু তিনি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন। তাই এই খারাপ জগৎ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চান।

মাহাজের পাশাপাশি জমিউয়তুল মুজাহিদীন নামে আরেকটি জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতাও বেড়েছে। মাহাজ ও জমিউয়তুল মুজাহিদীনের সদস্যরা জাল নোট তৈরি এবং ইয়াবা ব্যবসায়ও জড়িয়ে পড়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

পুলিশ ও এপিবিএন সূত্র জানায়, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে ২০২২ সালে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে ২০টি ঘটনায় ২৭ জন নিহত হন। এরমধ্যে কুতুপালং ক্যাম্পে একসঙ্গে সিক্স-মার্ডারের ঘটনা আলোচিত ছিল। তবে গত চার মাসে ক্যাম্পে ১৫ রোহিঙ্গা হত্যার শিকার হন। এদের মধ্যে মাঝি ও স্বেচ্ছাসেবকরা ছিলেন। সর্বশেষ ২২ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ এরশাদ (২২) নামে ক্যাম্পের এক স্বেচ্ছাসেবক খুন হন। ২১ সেপ্টেম্বর খুন হন মোহাম্মদ জাফর (৩৫) নামের এক নেতা (মাঝি)। ১৮ সেপ্টেম্বর প্রাণ হারান আরেক স্বেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ ইলিয়াস (৩৫)। ৯ আগস্ট দুই রোহিঙ্গা নেতা, ৮ আগস্ট টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক স্বেচ্ছাসেবক খুন হন।

গত ১ আগস্ট একই ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক নেতা মারা যান। ১ আগস্ট উখিয়ার মধুরছড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবক, গত ২২ জুন কথিত আরসা নেতা মোহাম্মদ শাহ এবং ১৫ জুন একই গ্রুপের সদস্য মো. সেলিম (৩০) সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। এছাড়া ১৬ জুন রাতে উখিয়া ক্যাম্পে স্বেচ্ছাসেবক, ১০ জুন কুতুপালংয়ে চার নম্বর ক্যাম্পের আরেক স্বেচ্ছাসেবক, ৯ জুন এক রোহিঙ্গা নেতা, জুনের শুরুতে ও মে মাসে খুন হন রোহিঙ্গা নেতা সানা উল্লাহ (৪০) ও সোনা আলী (৪৬)। এসব ঘটনায় ১২টি মামলায় ২৩ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

এদিকে, গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর লম্বাশিয়া ক্যাম্পের এআরএসপিএইচ কার্যালয়ে রোহিঙ্গাদের অন্যতম শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড এবং বালুখালীর ১৮ নম্বর শিবিরের দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ নামের মাদ্রাসায় আরসাবিরোধী মাদ্রাসা শিক্ষক মৌলভী আকিজসহ ছয় জন খুন হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো তৎপরতা বাড়ায়। এতে ক্যাম্পে সন্ত্রাসীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। তবে গত অক্টোবর থেকে ক্যাম্পে চালু হওয়া স্বেচ্ছাপাহারা ব্যবস্থাকে অকার্যকর করতে সংশ্লিষ্ট রোহিঙ্গা নেতা ও স্বেচ্ছাসেবীদের টার্গেট করে হামলার ঘটনা ঘটছে।

এ বিষয়ে কুতুপালংয়ের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা মোহাম্মদ রফিক বলেন, মাস্টার মুহিবুল্লাহ হত্যার এক বছর হয়েছে। বিষয়টি পুরো বিশ্ব আলোড়ন সৃষ্টি করলেও ক্যাম্পে রোহিঙ্গা মাঝিদের (নেতা) হত্যা বন্ধ হয়নি। এতে আমরা যারা মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করি, তারা খুবই বিপদে আছি। তবে এটাও সত্য, এপিবিএন পুলিশ সদস্যরা আমাদের জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করছে। তিনি আরো বলেন, ‘ক্যাম্পে হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজিই শুধু নয়, বিভিন্ন অপরাধ চক্রে যুক্ত হতে রোহিঙ্গাদের বাধ্য করা হয়।

এআরএসপিএইচ-এর নেতা সৈয়দ মাহামুদ বলেন, আমরা যারা প্রত্যাবাসনের পক্ষে এবং মাদক ও মানবপাচারসহ রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন অপরাধ ঠেকাতে কাজ করছি, তারা সবাই প্রতিমুহূর্তে প্রাণ হারানোর ভয়ে আছি। তবে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা বলেছেন, মিয়ানমারের মুসলিম সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আরসা এবং মাদক ও মানবপাচারে জড়িত গোষ্ঠীগুলোর বিপক্ষে সদা সোচ্চার রয়েছেন তারা। কক্সবাজার পিপলস্ ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল জানান, রোহিঙ্গারা স্বাভাবিকভাবে নেতা মানতে চান না। এ সুযোগকে কাজ লাগিয়ে নেতৃশূন্য করার কোনো মিশন সশস্ত্র গোষ্ঠী বা ভিন্ন কোনো মহল করছে কিনা তা খতিয়ে দেখা জরুরি।

এসব বিষয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) পুলিশ সুপার (এসপি) মো. হাসান বারী নূর ভোরের কাগজকে বলেন, কিছু বিপদজনক গ্রুপ রয়েছে এটা সত্য। তারা অধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটানোর চেষ্টা করে। তবে, ক্যাম্পের সামগ্রিক পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে। যখনই কোনো ঘটনা ঘটছে, দ্রুত সময়ের মধ্যে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। এপিবিএন-১৬ এর এসপি হারুন-অর-রশিদ ভোরের কাগজকে বলেন, রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো যাতে কোনো অপকর্মে লিপ্ত হতে না পারে, সেজন্য গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি নিয়মিত ফুট পেট্রল, মোবাইল পেট্রল ও ওয়াচ টাওয়ার থেকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি আস্তানায় হানা দিয়ে বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।

জানতে চাইলে ৮-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সহকারী পুলিশ সুপার (অপস) মো. ফারুক আহমেদ জানান, এপিবিএনের আওতাধীন ক্যাম্পগুলোতে প্রতি রাতে প্রায় চার হাজার স্বেচ্ছাসেবী রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। এতে ক্যাম্পের অপরাধীরা অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App