×

জাতীয়

আরও ৯ মরদেহ উদ্ধার, অপেক্ষায় স্বজনরা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৮:৫৭ এএম

আরও ৯ মরদেহ উদ্ধার, অপেক্ষায় স্বজনরা

পঞ্চগড়ে নৌকাডুবিতে নিহতের স্বজনদের অপেক্ষা। ছবি: ভোরের কাগজ

পঞ্চগড়ে নৌকাডুবিতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫৯ এখনো নিখোঁজ অন্তত ১৮

পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় করতোয়া নদী পার হতে গিয়ে নৌকা ডুবে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৫৯ জনে দাঁড়িয়েছে। আজ মঙ্গলবার (২৭ সেপ্টেম্বর) সকালে উদ্ধার করা হয় আরও ৯ জনের মরদেহ। গতকাল সোমবার ভোর থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত ২৫টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল, এর মধ্যে পার্শ্ববর্তী জেলা দিনাজপুরের দুই উপজেলা থেকে উদ্ধার হয় ৮ জনের মরদেহ। আগেরদিন রবিবার আরো ২৫ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনায় এখনো ১৮ জনের বেশি নিখোঁজ রয়েছে বলে জানিয়েছেন পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) দীপঙ্কর রায়।

এদিকে করতোয়া নদীর আউলিয়ার ঘাটে নৌকাডুবির ঘটনায় নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজে নিকটাত্মীয়দের আহাজারি থামছে না। দুর্ঘটনার পর থেকেই নদী তীরে অবস্থান করছেন অনেকে। গতকাল ভোর থেকেও অনেকে এসে জড়ো হচ্ছেন নদীর ঘাটে। অপেক্ষার প্রহর গুনছেন মৃত স্বজনের মরদেহ বুঝে পেতে। কেউবা আশায় বুক বেঁধে আছেন- জীবিতই ফিরে পাবেন প্রিয় মানুষটিকে। কোনো মরদেহ উদ্ধারের খবর জানতে পারলেই নদীর পাড় থেকে স্বজনরা ছুটে যাচ্ছেন স্থানীয় মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়ন পরিষদে। সেখানেই রাখা হচ্ছে উদ্ধারকৃত মরদেহ।

সকাল থেকে আউলিয়া ঘাট এলাকায় অবস্থান করে দেখা যায়, স্থানীয় লোকজন এবং ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দলের তিনটি ইউনিট উদ্ধার কার্যক্রম চালাচ্ছে। সেখানে ভিড় করেছেন নিখোঁজদের স্বজনরা। কেউ কেউ নৌকা নিয়ে নদীতে খুঁজে বেড়াচ্ছেন প্রিয়জনকে। কারো হাতে নিখোঁজ স্বজনের ছবি, তা নিয়ে নদী তীরের বাসিন্দাদের দেখাচ্ছেন আর বিলাপ করছেন। এছাড়া হাজার হাজার উৎসুক মানুষের ঢল নেমেছে নদীর পাড়ে।

ষাটোর্ধ্ব কৃষ্ণ চন্দ্র রায় ভাই ও ভাতিজার খোঁজে এসেছেন আউলিয়া ঘাটে। তিনি বলেন, নদীর অন্য পাড়ে বদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়া পূজায় যোগ দিতে তার ভাই নরেশ ও ভাতিজা সিন্টু বাড়ি থেকে বের হয়ে আর

ফেরেনি। নৌকাডুবির পর থেকেই এখানে আছি। নাতির খোঁজে উপজেলার পাঁচপীর এলাকা থেকে এসেছেন বৃদ্ধ সুমল চন্দ্র। তিনি বলেন, নাতির মরদেহটা পেলে অন্তত নিজেরা সৎকারের কাজটা করতে পারতাম। মাড়েয়া বটতলি এলাকার ধীরেন বাবুর দুই প্রতিবেশীসহ সাতজন নিকটাত্মীয় এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। গতকাল থেকে তিনি নদীর পাড়ে অপেক্ষা করছেন। ধীরেন বাবু বলেন, বদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়া পূজায় যোগ দিতে ভাতিজা, ভাতিজার বউ, ভাতিজার শ্বশুর, শ্যালিকা এবং আমার ভাতিজি নৌকায় ওঠে দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। এখন পর্যন্ত কারো খোঁজ পাইনি। এখন তাদের লাশের জন্য অপেক্ষা করছি।

গতকাল রাতে পঞ্চগড় ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক সৈয়দ মাহাবুবুল আলম জানান, দ্বিতীয় দিনের উদ্ধার কাজ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় সমাপ্ত করা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার ভোর সাড়ে ৫টা থেকে আবারো উদ্ধার কাজ শুরু হবে। পঞ্চগড় ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি রংপুর, কুড়িগ্রাম ও রাজশাহী থেকে ডুবুরি দল এসে উদ্ধার কার্যক্রমে যোগ দিয়েছে। ঘটনাস্থল করতোয়ার আউলিয়ার ঘাট থেকে ৩০ কিলোমিটার ভাটির দিকে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা টহল দিচ্ছেন, নজর রাখছেন।

এদিকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ঢাকা সদর দপ্তরের পরিচালক অপারেশন লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান জানিয়েছেন, পানিতে ডুবে থাকা যে কোনো মানুষ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই ভেসে উঠবে। সে মোতাবেক ২৭ সেপ্টেম্বর (আজ) সন্ধ্যা পর্যন্ত অভিযান চলবে।

এই দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারের স্বজনদের দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এক লাখ টাকা এবং হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে সহায়তার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এছাড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সৎকারের জন্য মরদেহ পিছু ২০ হাজার টাকা করে দেয়া হচ্ছে।

গতকাল সোমবার দুপুরে রেলপথ মন্ত্রী ও পঞ্চগড়-২ আসনের সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম সুজন, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান, ঠাকুরগাঁও-১ আসনের সংসদ সদস্য ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভাপতি রমেশ চন্দ্র সেন, দিনাজপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য মনোরঞ্জনশীল গোপাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এ সময় তারা নিহত কয়েকজনের বাড়িতে গিয়ে স্বজনদের সান্ত¡না দেয়ার পাশাপাশি সার্বিক বিষয়ে খোঁজ খবর নেন।

গতকাল সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহত ৫০ জনের একটি নামের তালিকা দেয়া হয় সাংবাদিকদের। সেই তালিকা অনুযায়ী নিহতরা হলেন- হাশেম আলী (৭০) শ্যামলী রানী (১৪), লক্ষ্মী রানী (২৫), অমল চন্দ্র (৩৫) শোভা রানী (২৭), দিপঙ্কর (৩) পিয়ন্ত (২.৫) রুপালি ওরফে খুকি রানী (৩৫), প্রমিলা রানি (৫৫) ধনবালা (৬০) সুনিতা রানী (৬০), ফাল্গুনী (৪৫), প্রমিলা দেবী, জ্যোতিশ চন্দ্র (৫৫), তারা রানী (২৫), সানেকা রানী (৬০), সফলতা রানী (৪০) বিলাশ চন্দ্র (৪৫), শ্যামলী রানী ওরফে শিমুলি (৩৫), উশোশি (৮), তনুশ্রী (৫), শ্রেয়সী, প্রিয়ন্তী (৮), সনেকা রানী (৬০), ব্রজেন্দ্র নাথ (৫৫), ঝর্ণা রানী (৪৫), দীপ বাবু (১০), সূচিত্রা (২২), কবিতা রানী (৫০), বেজ্যে বালা (৫০), দিপশিখা রানী (১০), সুব্রত (২), জগদীশ (৩৫), যতি মিম্রয় (১৫), গেন্দা রানী, কনিকা রানী, সুমিত্রা রানী, আদুরী (৫০), পুষ্পা রানী, প্রতিমা রানী (৫০), সূর্যনাথ বর্মন (১২), হরিকেশর বর্মন (৪৫), নিখিল চন্দ্র (৬০), সুশীল চন্দ্র (৬৫), যুথি রানী (০১), রাজমোহন অধিকারী (৬৫), রূপালী রানী (৩৮), প্রদীপ রায় (৩০), পারুল রানী (৩২) ও প্রতীমা রানী (৩৯)। এদের মধ্যে ২৯ জন বোদা উপজেলার, ১৮ জন দেবীগঞ্জের এবং বাকি ৩ জন আটোয়ারী, পঞ্চগড় সদর ও ঠাকুরগাঁও সদরের বাসিন্দা।

প্রসঙ্গত, মহালয়া উপলক্ষে গত রবিবার জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নৌকায় করে বোদা উপজেলার বরদেশ্বরী মন্দিরে যাচ্ছিলেন উৎসবে যোগ দিতে। দুপুরের দিকে মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়া ঘাট এলাকায় একটি নৌকা উল্টে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ৩০-৪০ জন ধারণ ক্ষমতার নৌকাটিতে দেড় শতাধিক যাত্রী ছিল। কিছু মানুষ সাঁতরে নদীর তীরে ফিরতে পারলেও অনেকে নিখোঁজ থাকেন।

নৌকাডুবির পরপরই স্থানীয়রা নৌকা নিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করেন। পরে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা নামেন তল্লাশিতে। এ ঘটনায় রাতে পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দ্বীপংকর রায়কে প্রধান করে একটি ৫ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে জেলা প্রশাসন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App