×

জাতীয়

রহিমার রহস্যজনক নিখোঁজ থেকে উদ্ধার নিয়ে নানা প্রশ্ন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৮:৪১ এএম

রহিমার রহস্যজনক নিখোঁজ থেকে উদ্ধার নিয়ে নানা প্রশ্ন

ছবি: ভোরের কাগজ

আদালতে জবানবন্দি দেয়ার পর মেয়ের জিম্মায় রহিমা

খুলনা থেকে রহস্যজনক নিখোঁজের ২৯ দিন পর ফরিদপুর থেকে শপিং ব্যাগসহ উদ্ধার হওয়া রহিমা বেগমের দিনলিপি ছিল প্রশ্নবিদ্ধ ও রহস্যজনক। পানি আনতে নেমে নিখোঁজ হওয়া, প্রতিবেশীদের নামে অপহরণ মামলা দায়ের ও গ্রেপ্তার এবং পুরানো ভাড়াটের বাড়িতে তার আশ্রয় নেয়াসহ পুরো ঘটনার পেছনে কী রহস্য লুকিয়ে আছে- তা উদ্ঘাটনের চেষ্টা করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। বিশেষ করে রহিমা বেগমের মেয়ে মরিয়ম মান্নানের ঢাকায় কোটাবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেয়া, উশৃঙ্খল জীবনযাপন এবং ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগের পর তিনি বিতর্কিত ও সমালোচিত। মায়ের ‘নিখোঁজ’ হওয়া নিয়ে মরিয়ম মান্নানের আকুতি, ময়মনসিংহে উদ্ধার হওয়া অজ্ঞাত লাশ মায়ের বলে দাবি ও পরবর্তী তৎপরতা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

এদিকে, রহিমা বেগমকে অপহরণ করা হয়েছিল বলে আদালতে জানিয়েছেন তিনি। পরে এই মামলার বাদী রহিমা বেগমের মেয়ে আদুরী আক্তারের জিম্মায় তাকে ছেড়ে দিয়েছেন আদালত। গতকাল রবিবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ২ দফা তাকে খাস কামারায় নিয়ে জবানবন্দি নেয়ার পর এ সিদ্ধান্ত দেন আদালত।

রহিমা বেগমের আইনজীবী মো. আফরুজ্জামান টুটুল জানান, বিকাল ৫টা ২৫ মিনিটে খুলনা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট-৩ এর বিচারক মো. আল আমিনের খাস কামারায় তার ২২ ধারায় জবানবন্দি নেয়া হয়। সেখানে তিনি বলেন, ঘটনার দিন তাকে ৭/৮ জন মুখ বেঁধে অপহরণ করে। পরে তারা চট্টগ্রামের উদ্দেশে নিয়ে য়ায়। সেখান থেকে তিনি নিজে ফরিদপুর বোয়ালমারী উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামে তার আত্মীয় কুদুসের বাড়িতে আশ্রয় নেন। আইনজীবী টুটুল আরো বলেন, বিকাল ৫টা ৫০ মিনিটে দ্বিতীয় দফায় রহিমা বেগমকে খুলনা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট-৪ এর বিচারক সরওয়ার আহমেদের খাস কামরায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে এই মামলার বাদী রহিমা বেগমের মেয়ে আদুরী আক্তারের জিম্মায় তাকে ছেড়ে দেয়ার আদেশ দেন আদালত।

ফরিদপুরে উদ্ধারের পর গতকাল প্রেস ব্রিফিংয়ে পিবিআই খুলনার পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বলেন, রহিমার কাছ থেকে সাদা রঙের একটি শপিং ব্যাগ উদ্ধার করা হয়েছে। যার মধ্যে ওড়না ছিল, হিজাব ছিল, আয়না, শাড়ি, আইড্রপ ও ওষুধ ছিল। তার পরিধেয় সালোয়ার-কামিজ ছিল, সঙ্গে ছোট একটি অর্নামেন্টাল পার্টস ছিল। স্বাভাবিকভাবে একজনকে অপহরণ করে নিয়ে গেলে এই জিনিসগুলো থাকার কথা নয়। পুলিশ সুপার বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে রহিমা বেগম অপহৃত হয়েছেন বলেই দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, তাকে চারজন মিলে অপহরণ করে নিয়ে যান। কিন্তু তারা কারা বা কোথায় নিয়ে যান, সে ব্যাপারে তিনি কিছু বলতে পারেননি। একপর্যায়ে তারা সাদা (খালি) স্ট্যাম্পে কিছু স্বাক্ষর নেন। স্বাক্ষর নেয়ার পর তাকে একটা নির্জন জায়গায় ছেড়ে দেন। কিন্তু জায়গাটা কোথায় সেটা তিনি বুঝতে পারেননি। এরপর তিনি মনি নামের একটি মেয়ের বাড়িতে ছিলেন। তবে সেই মেয়ের বাড়ি কোথায় তিনি বলতে পারছেন না। এরপর ওই মেয়ে তাকে এক হাজার টাকা সংগ্রহ করে দেন। পরে তিনি মকসুদপুরে চলে আসেন। সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বলেন, যখন যেখানে ছিলেন, তারা তাকে কাপড়চোপড় দিয়েছেন বলে জানান রহিমা। সেগুলো তিনি সংগ্রহে রেখেছিলেন। মুকসুদপুর থেকে তিনি বোয়ালমারীতে আসেন।

এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর তার বাড়ির ২৮ বছর আগের ভাড়াটিয়া আবদুস কুদ্দুস মোল্লার বাড়িতে যান। কুদ্দুস এক সময় খুলনার দৌলতপুরের সোনালি জুট মিলে চাকরি করতেন। তিনি ভেবেছিলেন, সেখানে গেলে আশ্রয় পাওয়া যেতে পারে। খুলনায় না গিয়ে ফরিদপুরে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে রহিমা বেগম পুলিশকে জানান, খুলনায় আসতে ভয় পেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, কুদ্দুসের বাড়ি যাওয়ার পর মেয়েদের খবর দেবেন। এরপর মেয়েদের সঙ্গে চলে যাবেন। সৈয়দ মুশফিকুর রহমান জানান, সৈয়দপুরে অবস্থানকালে ঘটনাটি আলোচিত হলে ওই এলাকার একটি ছেলে বিষয়টি স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধির নজরে আনেন। ওই জনপ্রতিনিধি বিষয়টি খুলনার দৌলতপুরের এক কাউন্সিলরকে জানান। তিনি ঘটনাটি দৌলতপুর থানা-পুলিশকে জানান।

এরপর দৌলতপুর থানার পুলিশ শনিবার ওই এলাকায় গিয়ে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। পুলিশ সুপার জানান, রহিমা বেগমকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। আদালতে তিনি জবানবন্দি দেবেন। এরপর আদালতের সিদ্ধান্ত মতো কার্যক্রম চলবে। পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বলেন, রহিমা বেগম অপহরণের অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া ছয়জনের বিষয়ে আদালতে সিদ্ধান্ত হবে। এ ছাড়া রহিমার সঙ্গে ফরিদপুর থেকে পুলিশি হেফাজতে নেয়া আরো তিনজনের বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে।

খুলনার দৌলতপুর থানার ওসি মো. নজরুল ইসলাম জানান, খুলনার মহেশ্বর পাশা এলাকার নিখোঁজ হওয়া রহিমা বেগমকে অক্ষত অবস্থায় ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার সদর ইউনিয়নের সৈয়দপুর গ্রামের কুদ্দুস মোল্যার (৫৫) বাড়ি থেকে উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শনিবার রাত পৌনে ১১টার দিকে রহিমা বেগমকে উদ্ধার করে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ। এরপর রাত ২টার দিকে তাকে নিয়ে আসা হয় দৌলতপুর থানায়।

এদিকে পিবিআইর কাছে মুখ খুলেছেন রহিমা বেগম। তার দাবি, গত ২৭ আগস্ট রাতে পানি আনতে গিয়ে তিনি অপহৃত হন। চার ব্যক্তি তাকে জাপটে ধরে নাকে রুমাল চেপে ধরেন। এতে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। এরপর তার কিছু মনে নেই।

অন্যদিকে রহিমাকে অপহরণ মামলায় আটক ছয়জনের পরিবারের সদস্যরা দাবি করেছেন, জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে পরিকল্পিতভাবে আত্মগোপন করেছিলেন রহিমা বেগম। বিষয়টি জানতেন তার মেয়ে মরিয়ম মান্নানসহ পরিবারের সদস্যরা। এ সময় তিনি মোবাইল ফোনও ব্যবহার করেননি। রহিমাকে উদ্ধারের খবর পেয়ে শনিবার রাতে দৌলতপুর থানায় ছুটে যান এ মামলায় আটক রফিকুল আলম পলাশ ও নুরুল আলম জুয়েলের বাবা আনসার উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, তার ছোট ছেলে রফিকুল আলম পলাশ চাকরি করেন এবং বড় ছেলে নুরুল আলম জুয়েল মুদি দোকানি। তার দুই ছেলে রহিমাকে কথিত অপহরণের মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তারা হয়রানির শিকার হয়েছেন।

তিনি বলেন, তাদের সঙ্গে জমির সীমানা নিয়ে মতবিরোধ থাকায় মামলা দিয়ে হয়রানি ও সম্মানহানি করা হয়েছে। রহিমা ও তার সন্তানরা কেন এই অপহরণের নাটক সাজালো সে ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান তিনি। এ মামলায় আটক মহিউদ্দিন ও গোলাম কিবরিয়ার বড় ভাই নজরুল ইসলাম বলেন, রহিমা বেগমের তিন বিয়ে। মেয়ের ঘটকালি করতে আসে বেলাল, সর্বশেষ রহিমা বেগম তাকে বিয়ে করেন। তিনি বলেন, তার ছোট ভাই গোলাম কিবরিয়া রহিমার সৎ ছেলের কাছ থেকে জমি কেনে। সেই জমিতে যাতে যেতে না পারে সেজন্য আত্মগোপন করে অপহরণ মামলা দিয়ে তাকে আটক করিয়েছে রহিমা। তিনি আরো বলেন, মরিয়ম মান্নান নাটকবাজ।

পুলিশ ও সাংবাদিকদের মিথ্যা কথা বলে প্রায় এক মাস বিভ্রান্ত করেছে। সে মাদকাসক্ত। ময়মনসিংহে গিয়েও অন্য নারীর লাশ নিয়ে সে নাটক সাজিয়েছে। তিনি আটকদের মুক্তি এবং রহিমা বেগম ও তার পরিবারের সদস্যদের শাস্তির দাবি করেন। এ মামলায় আটক হেলাল শরীফের মেয়ে নবম শ্রেণির ছাত্রী আন্তারা ফাহমিদা বলে, তার বাবা কোনো অপরাধ করেনি, অথচ তারপরও তাকে জেল খাটতে হচ্ছে। তাদের পরিবারের সদস্যরা নানা কটূক্তির শিকার হয়েছে। এ ব্যাপারে রহিমা বেগমের বড় ছেলে মোহাম্মদ সাদী বলেন, তার মা উদ্ধার হওয়ায় তারা খুশি। তার কোনো বোন অপহরণ নাটক সাজিয়েছে বলে তার কাছে মনে হয় না। তারপরও তার মাকে জিজ্ঞাসা করা হোক, যদি কেউ প্রমাণ করতে পারে যে তারা অপহরণ নাটক সাজিয়েছে তাহলে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হোক।

রহিমাকে আশ্রয় দেয়া কুদ্দুস মোল্যা বর্তমান বোয়ালমারী উপজেলা ডোবরা জনতা জুটমিলের একজন কর্মচারী। তার ভাগিনা জয়নাল জানান, তার মামা কুদ্দুস বিশ্বাস খুলনা শহরের মীরেরডাঙ্গা সোনালি জুটমিলে চাকরির সুবাদে খুলনা নগরের মহেশ্বরপাশা এলাকার নিখোঁজ হওয়া রহিমা বেগমের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। তিনি ফেসবুক ও ইউটিউবের মাধ্যমে রহিমা বেগমের মেয়ে মরিয়ম মান্নানের স্ট্যাটাস থেকে বিষয়টি জানতে পারেন। তারপর ওই ছবিটি রহিমা বেগমকে দেখিয়ে জানতে চান এটা তার ছবি কিনা; ওই সময় রহিমা বেগম হতভম্ব হয়ে বলেন, আমার ছবির মতোই তো লাগতেছে। তার মেয়ের ফেসবুক স্ট্যাটাসে দেয়া দুইটি মোবাইল নাম্বার (০১৭৭১১০০২০২, ০১৫৫৮৩৪৯৯০৫) যোগাযোগ করলে রহিমা বেগমের ছেলে মিরাজের স্ত্রী ফোনটি রিসিভ করেন। রহিমা বেগমের বিষয়টি তাদের বললে তারা ওই নাম্বারের আর ফোন দিতে নিষেধ করেন। জয়নাল বলেন, ওই ঘটনার পর আমার সন্দেহ হলে রহিমা বেগমকে না জানিয়ে তার (রহিমা) বিষয়টি শনিবার দুপুরে স্থানীয় ইউপি সদস্য মোশারফ হোসেনকে জানাই।

এরপর তিনি খুলনা মহানগরের ২ নম্বরের ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সাইফুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হন নিখোঁজ হওয়া রহিমা বেগমই ওই নারী। শনিবার রাতে পুলিশ যখন বোয়ালিয়ায় কুদ্দুসের বাড়িতে পৌঁছে তখন রহিমা সেখানে কুদ্দুসের স্ত্রী ও ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে গল্প, হাসি-আড্ডায় ছিলেন। পুলিশ দেখার পরই তিনি নির্বাক হয়ে যান। এ সময় কুদ্দুস বাড়িতে ছিলেন না। তাই কুদ্দুসের স্ত্রী ও ছেলে এবং ভাইয়ের বউকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। রহিমা তাদের এখানে আসার কারণ কী বলেছে তা জানার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তারা তেমন কিছুই জানতে পারেনি। তারা রহিমার কাছে এসব জানার চেয়ে সাবেক বাড়িওয়ালাকে সেবাযতœ করতে তৎপর ছিলেন। ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর রাত পৌনে ১১টা পর্যন্ত সাত দিন রহিমা ওই বাড়িতে ছিলেন। রহিমা তাদের জানান, গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর ও চট্টগ্রাম ঘুরে তিনি ফরিদপুরে এসেছেন। রহিমার সঙ্গে প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় থাকায় তারা তেমন কেনো সন্দেহ করেনি। আর রহিমার ছেলেমেয়েদের সঙ্গেও কথা বলেননি। কারণ, তাদের কাছে মনে হয়েছিল রহিমা বেড়াতে এসেছেন।

প্রসঙ্গত, গত ২৭ আগস্ট নগরীর মহেশ্বরপাশা এলাকার বাড়ির সামনে থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন রহিমা বেগম। তাকে অপহরণ করার অভিযোগ তুলে পরদিন থানায় মামলা করেন রহিমার মেয়ে আদুরি আক্তার। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন সময় স্ট্যাটাস দিয়ে ভাইরাল হয়েছেন অপর মেয়ে মরিয়ম মান্নান।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App