×

মুক্তচিন্তা

বৈশ্বিক অর্থনীতিতে আসন্ন মন্দা : বিপদ এড়াতে বাংলাদেশের করণীয়

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০১:৪২ এএম

বিশ্ব অর্থনীতি এখন কোন পথে যাচ্ছে- এক কথায় এর উত্তর দেয়াটা সহজ নয়। সাধারণত পরপর দুই প্রান্তিকে অর্থনীতি সংকুচিত হলে তাকেই মন্দা বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে পরপর দুই প্রান্তিকেই অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে, যদিও এখনো মন্দার ঘোষণা আসেনি। তবে মন্দা যে আসছে, তাতে সবাই কমবেশি একমত। সুতরাং প্রশ্ন হচ্ছে, অর্থনীতি কি মন্দার পথে, নাকি ফিরে যাচ্ছে মন্দা পেরিয়ে মহামন্দার দিকে? চলতি বছরের শেষ নাগাদ বা আগামী বছরের শুরুতে বিশ্ব মন্দার ঝুঁকি আরো গুরুতর হবে। ব্লুমবার্গের অর্থনৈতিক মডেল বলছে, ২০২৪ সালে মন্দা দেখা দেয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। জার্মানির ডয়েচে ব্যাংকের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মন্দা দেখা দেবে ২০২৩ সালের মাঝামাঝিতে। যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ওয়েলস ফারগো এন্ড কোম্পানির মতে, মন্দা হবে ২০২৩ সালের শুরুতে আর জাপানের আর্থিক কোম্পানি নমুরা হোল্ডিং বলছে, মন্দা দেখা দেবে চলতি ২০২২-এর শেষ দিকেই। বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিলে বাংলাদেশকেও মেনে নিতে হবে। সুতরাং এর অভিঘাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় বা কৌশল ঠিক করাই হবে প্রধান কাজ। ‘বিশ্বে কি মন্দা আসন্ন’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। অর্থনৈতিক সংকটে বিশ্ব। দিন দিন বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো নীতি সুদহার একযোগে বাড়িয়েই চলেছে। এর জেরে বিশ্ব অর্থনীতি ২০২৩ সালে মন্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্ব মন্দা হলে রপ্তানির ওপর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস এ নিয়ে বলছেন, বিশ্বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ব্যাপকভাবে কমে আসছে। ভবিষ্যতে যখন বিভিন্ন দেশ মন্দার কবলে পড়বে, তখন এই গতি আরো কমে আসতে পারে। তার শঙ্কা, প্রবৃদ্ধি কমে আসার যে হাওয়া বইছে, তা অব্যাহত থাকবে। বিশ্বব্যাংকের দেয়া তথ্য বলছে, সরবরাহ ব্যবস্থার সংকট এবং শ্রমবাজারের ওপর থাকা চাপ যদি প্রশমিত না হয়, তাহলে ২০২৩ সালে জ¦ালানি খাত বাদে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়াবে ৫ শতাংশে। এই অঙ্কটা করোনা মহামারির আগের পাঁচ বছরের গড় মূল্যস্ফীতির প্রায় দ্বিগুণ। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সুদের হার অতিরিক্ত ২ শতাংশ বাড়ানোর প্রয়োজন পড়তে পারে। তবে চলতি বছর এরই মধ্যে এ হার গড়ে ২ শতাংশের বেশি বাড়িয়েছে তারা। বিশ্বব্যাংকের শঙ্কা, একে তো চলছে অর্থনৈতিক সংকট, তারপর সুদের হার বৃদ্ধির এই পরিমাণ ২০২৩ সালে বিশ্বে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ কমিয়ে দিতে পারে বা শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ মাথাপিছু আয় সংকোচন করতে পারে। এমন পরিস্থিতিকেই সংজ্ঞাগতভাবে বৈশ্বিক মন্দা বলা হয়ে থাকে। আসন্ন মন্দার ঝুঁকি এড়াতে ভোগ কমানোর চেয়ে বরং উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দেয়া উচিত। একই সঙ্গে বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে, বাড়াতে হবে উৎপাদনশীলতা। আগের বিভিন্ন সময়ের মন্দা আমাদের দেখিয়েছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যখন দুর্বল থাকে, তখন লম্বা সময় ধরে মূল্যস্ফীতি বাড়তে দেয়া কতটা ঝুঁকির হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ১৯৮২ সালের মন্দার উদাহরণ দেয়া যায়। তখন বিভিন্ন দেশের ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা হারানোর ৪০টির বেশি ঘটনা ঘটেছিল। এছাড়া উন্নয়নশীল অনেক দেশ এক দশক ধরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হারিয়েছিল। সম্প্রতি বিভিন্ন দেশের আর্থিক ও রাজস্ব-সংক্রান্ত নীতিমালা আরো কঠোর করা হয়েছে। এই কৌশল মূল্যস্ফীতি কমাতে কাজে লাগতে পারে। তবে এসব পদক্ষেপের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেগুলো পরিস্থিতি জটিল করে তুলতে পারে এবং বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির গতি আরো কমিয়ে দিতে পারে। সমস্যা সমাধানে কিছু পরামর্শও দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তারা বলছে, মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে তাদের নীতিগত সিদ্ধান্ত আরো সুস্পষ্টভাবে জানাতে হবে। একই সঙ্গে নীতিনির্ধারকদের এমন সব মধ্যমেয়াদি রাজস্ব পরিকল্পনা করতে হবে, যেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা থাকবে এবং দরিদ্র ও দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে আছে এমন পরিবারকে সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে। বিশ্বব্যাংক গবেষণায় মূলত বৈশ্বিক প্রবণতাকেই তুলে ধরেছে। সেখানে নির্দিষ্ট কোনো দেশের কথা উল্লেখ নেই। তবে বিশ্বমন্দা হলে বাংলাদেশ এর বিরূপ প্রভাব থেকে বাইরে থাকতে পারবে না। কোভিডকালে, এমনকি রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ-পরবর্তী সময়ে বিশ্বে সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় পণ্য সরবরাহ বাধার মুখে পড়েছে। দেশে দেশে সরবরাহ ও উৎপাদন ব্যবস্থায় সংকটের কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে এবং মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে গিয়ে প্রায় সব দেশেই সুদের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব বিবেচনায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, বিশ্বব্যাংক কয়েক মাস ধরেই বিশ্বব্যাপী মন্দার আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছে। এমনকি বিশ্ব খাদ্য সংস্থা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও সম্প্রতি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনায় এ বিষয়ে সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন। বিশ্বমন্দা হলে অনেক ক্ষেত্রে আমদানিনির্ভর বাংলাদেশও তার বিরূপ প্রভাব এড়াতে পারবে না। অন্যদিকে বৈশ্বিক মন্দা বাংলাদেশকে কিছু সুবিধাও দিতে পারে। এ জন্য প্রয়োজনীয় নীতি ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশ্বমন্দা হলে ক্রেতা দেশে ক্রয়ক্ষমতা কমে গেলে আমাদের রপ্তানির ওপর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আবার মন্দা হলে জ¦ালানি তেলের দাম হয়তো কিছু কমবে; বিশ্ববাজারে পণ্যের দরও কমবে, যা বাংলাদেশের জন্য ভালো। মনোযোগ থাকতে হবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ওপরেও। সার্বক্ষণিক খাদ্য মজুত পরিস্থিতির ওপরেও নজর রাখতে হবে। বিশ্বব্যাপী আরেকটি মন্দা আঘাত হানুক বা না হানুক, মার্কিন প্রবৃদ্ধি ইতোমধ্যেই থমকে গেছে। চীনও চাপের মুখে আছে কোভিডের কারণে। ইউরোপে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কার্যত শূন্য। তাই, বিশ্ব অর্থনীতির প্রধান ইঞ্জিন যে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই। যদি আশঙ্কা বাস্তবে পরিণত হয়, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রভাবিত হবে। আমদানিভিত্তিক পণ্যের উচ্চমূল্য এবং রপ্তানি পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রভাবিত হবে। প্রথমত, দেশে পণ্যের মূল্য বাড়তে পারে এবং দ্বিতীয়ত, রপ্তানি আয় কমে যেতে পারে। যেহেতু বাংলাদেশ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কম দামি তৈরি পোশাক রপ্তানি করে এবং এগুলো মৌলিক চাহিদারই অংশ, তাই রপ্তানি খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত নাও হতে পারে। তবুও আগামী বাজেটে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পদক্ষেপ নেয়া দরকার। অতিরিক্ত খরচ কমাতে হবে। বাংলাদেশও প্রণোদনা হিসেবে কম সুদে ঋণ দিয়েছে। সহজে পাওয়া এসব ঋণের একটি অংশ খেলাপি হয়ে গেছে, অর্থাৎ উৎপাদনে ব্যবহার হয়নি। তবে বৈশ্বিক প্রভাবের সঙ্গে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থনৈতিক অব্যবস্থা দায়ী। দুর্নীতি, দেশ থেকে মুদ্রা পাচার, রাজনৈতিক বিরোধের ফলে পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিরোধীদের মতের অসহযোগিতা, সব মিলিয়ে যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি। দেশীয় জ্বালানি অন্বেষণ না করে বিদেশি জ¦ালানিনির্ভর হওয়া, ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও অর্ধ লাখ কোটি টাকা প্রদান, তথ্য মতে, ১১ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার ইত্যাদি মাত্রা যোগ করেছে। অধিকন্তু, বাংলাদেশের ২০১৫ সালের ৪ হাজার ৯১০ কোটি বৈদেশিক ঋণ ২০২২ সালে এসে বহু গুণ বেড়ে ৯৭ হাজার ৭৪০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এই ঋণের বেশির ভাগই মেগা প্রজেক্টের জন্য, যা এখনো সম্পূর্ণ হয়নি, ফলে এই প্রজেক্ট থেকে কোনো বেনিফিট শিগগিরই আসছে না। অথচ ২০২৩ সাল থেকেই এর সুদসহ ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে। এ অবস্থায় অর্থনীতির চাপ সামলাতে আগামী দিনগুলোতে সরকারকে গভীর মনোযোগ রাখতে হবে বিশ্ব অর্থনীতির দিকে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের চাপ কমাতে সরকার আইএমএফের কাছে ঋণসহায়তা পেতে চিঠি দিয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে, আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা ও ঋণ পাওয়ার শর্ত নির্ধারণ করা। শর্তের মধ্যে যদি থাকে জ¦ালানির দাম বাড়ানো, ভর্তুকি কমানো, তাহলে তা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে, সীমিত আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা আরো কঠিন হবে। অন্যদিকে, করব্যবস্থা ও আর্থিক খাত নিয়ে বড় ধরনের সংস্কার অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে, যদিও এ ক্ষেত্রে বাধা আসবে প্রভাবশালীদের দিক থেকে। সুতরাং বিশ্ব অর্থনীতির অভিঘাত থেকে দেশের অর্থনীতিকে কতটুকু রক্ষা করা যাবে, তা পুরোটাই নির্ভর করছে দেশের নীতিনির্ধারকদের ওপর। রেজাউল করিম খোকন : সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App