×

জাতীয়

সাফ জয়ীদের লাগেজ ভাঙল কে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৯:০১ এএম

** দায় এড়ানোর চেষ্টা বিমান, শাহজালাল কর্তৃপক্ষ ও বাফুফের ** তদন্ত করছে পুলিশ-ডিবি-র‌্যাব **

সাফ জয়ী নারী ফুটবলারদের লাগেজের তালা ভেঙে ডলার, কাপড়চোপড় ও অন্য আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র চুরি হওয়ার ঘটনায় সারা দেশের মানুষ হতবাক। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে বুধবার নেপাল থেকে দেশে ফেরে বিজয়ী দলের মেয়েরা। ছাদখোলা বাসে চড়িয়ে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় বাফুফে দপ্তরে। হাতে পতাকা ও ব্যানার নিয়ে স্লোগানে স্লোগানে শিরোপা জয়ী মেয়েদের স্বাগত জানায় হাজারো মানুষ। পরদিন সকালে এই চুরির খবরে তোলপাড় শুরু হয় দেশজুড়ে। কে বা কারা কখন লাগেজের তালা ভেঙে অর্থ ও জিনিসপত্র চুরি করেছে সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

এর মধ্যে বিমানবন্দরে নারী ফুটবলারদের লাগেজের তালা ভেঙে চুরির অভিযোগের ‘সত্যতা মেলেনি’ বলে জানিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ওই অভিযোগ নিয়ে তোলপাড় চলার পর বিকালে আলাদা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানানো হয়। এখন প্রশ্ন হলো- নারী ফুটবলারদের অর্থ ও জিনিসপত্র তাহলে কে চুরি করল?

এই চুরির রহস্য উদ্ঘাটনে তদন্ত শুরু করেছে মতিঝিল ও বিমানবন্দর থানা পুলিশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), ডিবি ও র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) একাধিক টিম।

পুলিশ ও র‌্যাবের কর্মকর্তারা বলছেন, চুরি যাওয়া অর্থ ও মালামাল উদ্ধারে সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এজন্য যদি সংশ্লিষ্ট কাউকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হয় তাও করা হবে। এদিকে, ডিএমপির বিমানবন্দর ও মতিঝিল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বাফুফে। পাশাপাশি খোয়া যাওয়া সমপরিমাণ অর্থ বাফুফের পক্ষ থেকে ওই নারী খেলোয়াড়দের ফিরিয়ে দেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। তবে, চুরির ঘটনা সাফ জয়ের আনন্দকে ম্লান করেছে উল্লেখ করে এ ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত, কোথায় ঘটলো, কীভাবে ঘটলো তা তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি রাখে বলে জানিয়েছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও নারী উইংয়ের চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ বলেছেন, সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জয়ের ইতিহাস গড়ে চ্যাম্পিয়নরা দেশে ফেরেন বুধবার দুপুরে। নারী ফুটবল দলের আগমনে বিমানবন্দরে দেশের মানুষ যখন উচ্ছ্বাসে ব্যস্ত, সেই মুহূর্তে নারী ফুটবলাররা পান দুঃখজনক খবর। বাংলাদেশ নারী দলের দুই ফুটবলার কৃষ্ণা রানি সরকার ও শামসুন্নাহারের লাগেজ থেকে খোয়া যায় এক হাজার ৩০০ ডলার। এর মধ্যে কৃষ্ণা রানি সরকারের ছিল ৯০০ ডলার। এছাড়া তার ৫০ হাজার টাকা খোয়া গেছে। আরেকজন খেলোয়াড় শামসুন্নাহার সিনিয়রের ছিল ৪০০ ডলার। এছাড়া মার্জিয়ার কিছু নেপালি রুপি ও সাবান চুরি হয়েছে। দলের ফিজিওর বেশ কিছু জিনিসপত্র খোয়া গেছে। আমরা যখনই জানতে পারলাম তাদের এই টাকা ও জিনিসপত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, আমরা সঙ্গে সঙ্গে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ ও সিভিল এভিয়েশন অথরিটিকে জানাই। তারা অনুসন্ধান করছে। তিনি আরো বলেন, আমরা যেহেতু নেপাল থেকে এসেছি, এটা এখনই বলা মুশকিল আসলে ঘটনাটা কোথায় ঘটেছে। তারা বিষয়টা চেক করে তারপর জানাবে। টাকা না পাওয়া গেলে বাফুফে কোনো পদক্ষেপ নেবে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে মাহফুজা কিরণ বলেন, এই টাকাটা যদি কোনোভাবে না পাওয়া যায়, তবে বাফুফের পক্ষ থেকে অবশ্যই পদক্ষেপ নেয়া হবে। বাফুফের সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগ জানান, এই চুরির ঘটনায় মতিঝিল ও বিমানবন্দর থানায় জিডি করা হয়েছে।

বুধবার রাতে বাফুফে ভবনে ফেরার পর নারী ফুটবলাররা দেখতে পান তাদের কয়েকজনের লাগেজের তালা ভাঙা এবং ওই সময় অর্থ ও জিনিসপত্র চুরির ঘটনা তাদের কাছে স্পষ্ট হয়। এতে শামসুন্নাহার-কৃষ্ণাসহ অন্যদের মন বেশ খারাপ হয়।

জাতীয় দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন বলেন, ওদের ডলার ও অর্থ চুরির বিষয়টি জানা গেছে। এটা বেশ দুঃখজনক ঘটনা। কৃষ্ণার বাবা বাসুদেব সরকার বলেন, বৃহস্পতিবার সকালে মেয়ে আমাকে ফোন করেছিল। ওর ভীষণ মন খারাপ। আরেকটি সূত্রে জানা গেছে, বিমানবন্দরের লাগেজ বেল্টের এক পাশে অনেক সময় ধরে পড়েছিল সাবিনা-কৃষ্ণাদের লাগেজগুলো। সেখানে থাকা কয়েকজন কর্মকর্তা একসময় উচ্চস্বরে বলছিলেন, ‘এই লাগেজগুলো কাদের? কেউ নিচ্ছে না কেন?’ এরপর বাফুফের পক্ষ থেকে মেয়েদের লাগেজগুলো সংগ্রহ করা হয়। বাফুফেতে লাগেজগুলো পৌঁছানোর পরেও চুরির ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে ধারণা করছে পুলিশ।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নারী ফুটবল দলের সদস্যদের লাগেজ কেটে চুরির যে অভিযোগ উঠেছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। নারী ফুটবল দলের এই অর্জন গোটা জাতির অর্জন। সবাই আনন্দিত। লাগেজ কেটে চুরির ঘটনা সেই আনন্দ ম্লান করে দিয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলো, বিশেষ করে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এরকম লাগেজ চুরি, লাগেজ কেটে চুরি, অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়মিতভাবে হয়ে আসছে। এর আগেও বহুবার এমন ঘটনা ঘটছে। ঘটনা সত্য হলে বিমানবন্দরের অব্যবস্থাপনার বিষয়টি আবারো প্রমাণিত হবে। চুরির ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পেরেছে বলে মনে হয় না। তবে, নারী ফুটবলারদের লাগেজ কেটে চুরির ঘটনা অবশ্যই খতিয়ে দেখা দরকার।

এদিকে নারী ফুটবলারদের লাগেজ থেকে ডলার চুরির অভিযোগ পেয়ে তদন্ত শুরু করে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। তদন্তে চুরির সত্যতা মেলেনি জানিয়ে বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মো. কামরুল ইসলাম বলেন, বাফুফের প্রটোকল প্রতিনিধি ইমরান এবং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফুটবল দলের দুই নারী সদস্যের ব্যাগ থেকে অর্থ (ডলার এবং টাকা) চুরির অভিযোগ পাওয়া যায়। এই অভিযোগের ভিত্তিতে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ সিসিটিভি ফুটেজ পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে ঘটনার সত্যতা পায়নি।

তিনি আরো বলেন, সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল বুধবার দুপুর ১টা ৪২ মিনিটে বিজি-৩৭২ ফ্লাইটে কাঠমান্ডু থেকে ঢাকায় অবতরণ করে। ১টা ৫৮ মিনিটে ব্যাগেজ মেকআপ এরিয়ায় ট্রলি আসে। ১টা ৫৯ মিনিটে ব্যাগেজ মেকআপ এরিয়ায় প্রথম লাগেজ ড্রপ হয়। দুপুর ২টায় কনভেয়ার বেল্ট-০৮-এ প্রথম লাগেজ ড্রপ হয়। দুপুর ২টা ৮ মিনিটে মেকআপ এরিয়ায় শেষ ব্যাগেজ ড্রপ হয়। পরে বাফুফে প্রটোকল প্রতিনিধি ও দুজন টিম সদস্য অক্ষত এবং তালাবদ্ধ অবস্থায় লাগেজগুলো বুঝে নিয়ে বিমানবন্দর ত্যাগ করেন বলে দাবি করেন তিনি। কিন্তু পরে রাতে বাফুফে ভবনে গিয়ে খেলোয়াড়দের কয়েকজন নিজেদের লাগেজের তালা ভাঙা পান।

বিমানবন্দর সূত্র জানায়, বিমানবন্দরে লাগেজ হ্যান্ডেলিংয়ের দায়িত্বও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ওপর। এই চুরির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানের জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক তাহেরা খন্দকার বলেন, আমরা আমাদের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে বলেছি খতিয়ে দেখতে যে অভিযোগটা ফরমালি এসেছে কিনা।

এদিকে, এ ঘটনায় চোর ধরতে মাঠে নেমেছে বিমানবন্দরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এপিবিএন, বিমানবন্দর ও মতিঝিল থানা পুলিশ, ডিবি ও র‌্যাবের একাধিক টিম। এ বিষয়ে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে যে বা যারাই জড়িত তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে এরই মধ্যে র‌্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করেছে। ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম বলেন, চুরির ঘটনায় বিমানবন্দর এলাকার একাধিক সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে থানা পুলিশের একাধিক টিম কাজ শুরু করেছে। ডিবি উত্তরা বিভাগের ডিসি মো. আকরামুল হোসেন বলেন, ডিবি কাজ শুরু করেছে। কোনো অগ্রগতি থাকলে জানিয়ে দেয়া হবে।

মতিঝিল বিভাগের ডিসি হাইয়াতুল ইসলাম খান বলেন, চুরির ঘটনা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হবে। যদি কাউকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজন হয়, সেটিও করা হবে। বিমানবন্দর এপিবিএনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জিয়াউল হক বলেন, আমরা সংবাদ পাওয়ার পর স্বপ্রণোদিত হয়ে তদন্ত শুরু করেছি।

প্রসঙ্গত, কৃষ্ণা রানি সরকার তার মায়ের জন্য গহনা কিনতে এই ডলার জমিয়েছিল বলে গত রাতে এক সাক্ষাৎকারে গণমাধ্যমকে জানায়। সে তার মাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল। হঠাৎ করে এই চুরির ঘটনায় সে হতবাক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App