×

জাতীয়

প্রশ্নপত্র ফাঁসের নয়াধরনে ‘স্তম্ভিত’ শিক্ষা প্রশাসন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৮:৫৬ এএম

প্রশ্নপত্র ফাঁসের নয়াধরনে ‘স্তম্ভিত’ শিক্ষা প্রশাসন

ছবি: সংগৃহীত

** দিনাজপুর বোর্ডে ৪ বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত ** কেন্দ্রসচিবসহ ৩ শিক্ষক পুলিশের হাতে আটক ** নীতিহীন মানবসম্পদ তৈরির ইঙ্গিত **

অদ্ভুত এক পদ্ধতিতে চলমান এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় দিনাজপুর বোর্ডের অধীনে কুড়িগ্রাম জেলার একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ৬টি বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁসের জেরে ‘অস্বস্তিতে’ পড়েছে শিক্ষা প্রশাসন। এরই মধ্যে প্রশ্নফাঁসে সরাসরি যুক্ত থাকার অভিযোগে কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও কেন্দ্রসচিবসহ তিন শিক্ষকের গ্রেপ্তার হওয়ার খবর কার্যত ‘বজ্রপাতের’ মতো নেমে এসে স্তম্ভিত করেছে শিক্ষামহলকে।

শিক্ষকদের এই চৌর্যবৃত্তির কারণে দেশের উত্তরাঞ্চলে অর্থাৎ দিনাজপুর বোর্ডে গণিত, পদার্থ, রসায়ন ও কৃষি শিক্ষা বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। নতুন করে প্রশ্ন ছাপিয়ে নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর জীববিজ্ঞান ও ১ অক্টোবর উচ্চতর গণিতের পরীক্ষা নেয়া হবে। এরআগে যশোর বোর্ডে একটি পরীক্ষায় পরের দিনের প্রশ্ন আগের দিন বিলি করায় বহু নির্বাচনী অংশের পরীক্ষা স্থগিত করেছে শিক্ষা প্রশাসন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় টেকনোলজির সাহায্যে এরআগেও নানা কায়দায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল। কিন্তু এবারের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ধরন পাল্টে গিয়ে বহু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ন্যক্কারজনক এই অপরাধে সরাসরি শিক্ষক অভিযুক্ত হওয়ায় দেশে ভবিষ্যতে কী ধরনের মানবসম্পদ তৈরি হবে তা নিয়ে এখনই প্রশ্ন উঠেছে। এর জেরে দেশের এবং বিদেশের শিক্ষা মহলে কী বার্তা যাবে তা নিয়েও শঙ্কিত সংশ্লিষ্টরা। শিক্ষকদের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ায় শিক্ষার ঐতিহ্য কলঙ্কিত হয়েছে বলেও মন্তব্য তাদের। তবে কী কারণে শিক্ষকদের মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে তা জানতে দিনাজপুর বোর্ড একটি তদন্ত কমিটি করেছে। পাশাপাশি পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগও বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।

জানতে চাইলে আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের সমন্বয়ক ও ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, কঠোর নিরাপত্তার মধ্যেও প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ায় ঘটনা আমাদের নতুন করে ভাবাচ্ছে। পাশাপাশি এই ঘটনা পড়াশোনায় বড় ধরনের বিপর্যয় তৈরি করেছে। কেন এটা হলো, এর পেছনে অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য না রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে তা দিনাজপুর বোর্ডের তদন্ত প্রতিবেদন এবং পুলিশের রিপোর্ট না পেলে পরিষ্কার হবে না।

দিনাজপুর বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক মো. তোফাজ্জুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় বোর্ডের কলেজ পরিদর্শককে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি স্থগিত হওয়া পরীক্ষার সূচি নতুন করে জানিয়ে দেয়া হবে। তারমতে, আগেও প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে, কিন্তু কোনো কেন্দ্রসচিব এ ঘটনায় জড়াননি। এবার প্রশ্নপত্র ফাঁসে কেন্দ্রসচিব গ্রেপ্তার হয়েছেন। প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই ধরন পাল্টে যাওয়া আমাদের মনে নানা শঙ্কার জন্ম দিচ্ছে।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনাটিকে বাংলাদেশের শঙ্কিত হওয়ার মতো বিষয় জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, যাদের দিয়ে পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে তাদের চরিত্রের এত অবনমন ঘটলে সামনে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দেবে। অভিযুক্ত এসব শিক্ষকের হাতেই শিশুদের ভবিষ্যৎ গড়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা স্পষ্ট এদের হাতে ভালো মানবসম্পদ তৈরি হতে পারবে না। তার মতে, আগে টেকনোলজি দ্বারা প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। এবার শিক্ষকদের মাধ্যমে হচ্ছে। এতে প্রমাণ হয়, শিক্ষকদের একটি অংশ অনৈতিক কাজে জড়িত।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণেই দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের এসএসসির চার পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে বলে জানিয়ে শিক্ষাসচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক বলেন, প্রশ্ন ফাঁস আগে যেভাবে হয়েছে, এবারের ধরনটা একটু ভিন্ন। প্রশ্ন ফাঁস হলেও ফেসবুক বা গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে নাই উল্লেখ করে তিনি বলেন, কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে যে প্রশ্ন ফাঁস হলো, তা থানার লকার থেকে আনার সময় হয়েছে। মূলত সেখানকার কেন্দ্রসচিব এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। তিনি বিজ্ঞান বিভাগের বাড়তি কিছু প্রশ্ন নিয়ে নেন, যা পরে আমাদের নজরে আসে। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে, নাকি ব্যক্তিগত কারো সহায়তার উদ্দেশে নেয়া হয়েছে, তা তদন্তে জানা যাবে।

প্রধান শিক্ষকের কক্ষে ছয় বিষয়ের প্রশ্ন : চলমান এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযুক্ত কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী নেহাল উদ্দিন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও কেন্দ্র সচিব মো. লুৎফর রহমানের কক্ষ থেকে ছয়টি বিষয়ের পরীক্ষার প্রশ্নের প্যাকেট জব্দ করা হয়েছে। যেগুলোর একটি প্যাকেট ছাড়া সব প্যাকেটের মুখ খোলা ছিল। গত সোমবার পুলিশ সে প্রশ্নগুলো জব্দ করে। বুধবার ভূরুঙ্গামারী থানায় দায়ের করা মামলায় এসব অভিযোগ করেন কেন্দ্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আদম মালিক চৌধুরী।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভূরুঙ্গামারী উপজেলার নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও ওই কেন্দ্রের সচিব লুৎফর রহমান ভূরুঙ্গামারী থানায় প্রশ্নপত্র বাছাই করার দিন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুর রহমানের উপস্থিতিতে বাংলা ১ম পত্রের প্যাকেটের ভিতর বাংলা ২য় পত্র, ইংরেজি ১ম ও ২য় পত্রের প্রশ্নসহ একটি করে খাম ঢুকিয়ে নেন। এসব প্যাকেট উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা স্বাক্ষর করে সীলগালা করেন। বাংলা ১ম পত্রের পরীক্ষার দিন থানা থেকে বাংলা ১ম পত্রের প্যাকেট এনে তা খুলে বাংলা ২য় পত্র, ইংরেজি ১ম ও ২য় পত্রের খামটি সংশ্লিষ্টরা নিজেদের হেফাজতে নেন। এ সময় কেন্দ্রে দায়িত্বরত ট্যাগ অফিসার বোর্ডের দেয়া তালিকা অনুযায়ী পাঠানো প্রশ্নপত্রের খাম গণনা করার কথা থাকলেও তারা তা করেননি। পরে প্রধান শিক্ষক কয়েকজন শিক্ষকের সহায়তায় ফাঁস করা প্রশ্নপত্রের উত্তরমালা তৈরি করে ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় বিতরণ করেন। প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনাটি স্থানীয় সাংবাদিকদের নজরে এলে বিষয়টি জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে জানানো হয়। এরই মধ্যে ইংরেজি ২য় পত্র পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ায় নড়েচড়ে বসে পুলিশ ও প্রশাসন। গত মঙ্গলবার ইংরেজি ২য় পত্র পরীক্ষার দিন উপজেলা নির্বাহী অফিসার দীপক কুমার দেব শর্মা, ভূরুঙ্গামারী সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার মোরশেদুল হাসান, ওসি আলমগীর হোসেনের নেতৃত্বে একটি দল প্রধান শিক্ষকের কক্ষে অভিযান চালালে ওই কক্ষ থেকে গণিত, কৃষি বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়নের প্রশ্নপত্র উদ্ধার হয়। উদ্ধারকৃত প্রশ্নের পরীক্ষা তখনও অনুষ্ঠিত হয়নি। এরপরে পরীক্ষাগুলো স্থগিত করা হয়।

উপজেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রশ্ন বাছাইয়ের (সর্টিং) সময়ে কোনো একটি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের প্যাকেটের মধ্যে অন্য পরীক্ষাগুলোর প্রশ্নপত্রও ঢুকিয়ে দেয়া হয়। কেন্দ্রের দায়িত্বরত ট্যাগ অফিসার বোর্ডের দেয়া তালিকা অনুযায়ী পাঠানো প্রশ্নেপত্রের খাম গণনা করে থাকেন। প্যাকেট সিলগালা করে তার ওপর স্বাক্ষর করেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রহমান। থানা থেকে কেন্দ্রে প্রশ্নপত্রের প্যাকেট আনার পর কৌশলে অন্য প্রশ্নগুলো সরিয়ে ফেলা হয়। হতে পারে, এখানে কোথাও হয়তো দায়িত্বে অবহেলা হয়েছে। কিন্তু সেটি তদন্ত না করে বলা যাচ্ছে না।

স্থানীয় কয়েকজন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর অভিযোগ, অনেক অভিভাবককে ইংরেজি প্রথম ও দ্বিতীয়পত্রের প্রশ্নের জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে দেখা গেছে। ভূরুঙ্গামারী নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের এক পরীক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমি এই কেন্দ্র থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছি। হল রুমে অনেক শিক্ষার্থী আলোচনা করে তারা প্রশ্নের উত্তরপত্র পেয়েছে। আমাকেও নিতে বলেছে। আমি সত্য-মিথ্যা জানি না। তবে এটা হলে তো খুব ক্ষতি।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুলিশের গোয়েন্দারা নিশ্চিত হন ইংরেজি ১ম পত্রের পরীক্ষার প্যাকেটে এই প্রশ্নগুলো ঢুকানোর পর প্রশ্নগুলো প্রধান শিক্ষকের কক্ষেই রয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর তারা অভিযান চালান। এরপর বিকালে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রহমান ও প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমানকে থানায় নিয়ে আসেন। কিন্তু রহস্যজনকভাবে প্রধান শিক্ষককে রাতে আটক করা হলেও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। পরবর্তীতে ইংরেজি শিক্ষক আমিনুর রহমান রাসেল ও চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক জোবায়ের হোসাইনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া বুধবার ভোরে হামিদুল ইসলাম, সোহেল আল মামুনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নেয়া হয়। মামলার অন্য এজাহারভুক্ত আসামি ক্লার্ক আবু হানিফ এখনো পলাতক রয়েছে। প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম, পুলিশ সুপার আল আসাদ মো. মাহফুজুল ইসলাম, দিনাজপুর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম ভূরুঙ্গামারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার দীপক কুমার দেব শর্মার কক্ষে প্রায় তিন ঘণ্টা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন।

জানতে চাইলে সহকারী পুলিশ সুপার মোর্শেদুল হাসান জানান, প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ও ট্যাগ অফিসার আদম মালিক চৌধুরী বাদী হয়ে অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। ভূরুঙ্গামারী থানার অফিসার ইনচার্জ আলমগীর হোসেন বলেন, আসামি তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরো একজনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বিষয়টি গভীরভাবে অনুসন্ধান করা হচ্ছে, অন্য কারো সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে তাদেরও গ্রেপ্তার করা হবে।

এদিকে গতকাল বুধবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামরুল ইমলাম বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের পরামর্শে মামলা হয়েছে। কুড়িগ্রামের পুলিশ সুপার আল আসাদ মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, পরীক্ষার এ কার্যক্রমে পুলিশের নিরাপত্তা দেয়া ছাড়া অন্য কাজ নেই। আমরা সেটি নিশ্চিত করেছি। প্রশ্নপত্র ফাঁস কিংবা জালিয়াতির ঘটনা ঘটালে তার দায় পরীক্ষা ব্যবস্থাপনার সংশ্লিষ্টদের।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App