×

খেলা

বৈষম্যের দেয়াল পেরিয়ে দক্ষিণ এশিয়া জয়ের গল্প

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৮:৩৭ এএম

বৈষম্যের দেয়াল পেরিয়ে দক্ষিণ এশিয়া জয়ের গল্প

ছবি: সংগৃহীত

সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে নতুন ইতিহাস গড়েছে বাংলাদেশ। নেপালকে ৩-১ গোলে উড়িয়ে দিয়ে সাফ নারী ফুটবলে চ্যাম্পিয়নের মুকুট পরেছে লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। নানা প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে অবিচল লক্ষ্য, অদম্য মনোবল, প্রবল ইচ্ছা আর দৃঢ়সংকল্পকে সঙ্গী করে মেয়েরা পাড়ি দিয়েছে স্বপ্ন পূরণের পথ। তাদের শিরোপা জয়ে দেশবাসী স্বভাবতই আনন্দিত ও উচ্ছ্বসিত। বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে সম্মানিত করা এই মেয়েরা অন্ধকার থেকে উঠে এসেছে আলোর মঞ্চে। তারা এসেছে দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রাম থেকে। এই কিশোরীদের কারো কারো বাবা কৃষক, ছোট ব্যবসায়ী বা সামান্য মাইনের চাকুরে। তৃণমূলের অভাবী পরিবারের কিশোরীরাও যে সুযোগ পেলে জাতীয় মর্যাদা বয়ে আনতে পারে সেটা দেখিয়ে দিয়েছে নারী ফুটবলাররা। তারা শুধু শিরোপাই জেতেননি, টুর্নামেন্টে তারা ছিলেন অপরাজিতও। মেয়েদের ফুটবলের পথ চলা শুরু পনেরো ষোলো বছর আগে মূলত ফিফার বাধ্যবাধকতা মানতেই। দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া অনেকের হয়তো জানা নেই, শুরুর দিনগুলোতে কেমন তীব্র সামাজিক বাধা জয় করতে হয়েছে বাংলাদেশের মেয়েদের। মেয়েরা শর্টস পরে ফুটবল খেলবে এটা মেনে নিতেই সমস্যা হচ্ছিল সমাজের রক্ষণশীল একটা অংশের। সেই আপত্তি কখনো প্রকাশিত হয়েছে মিছিলে, কখনোবা হামলা চালিয়ে ম্যাচ পণ্ড করে দেয়ার মাধ্যমেও। সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে বাংলাদেশের মেয়েরা আজ দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট জয় করেছে। শিরোপা জয়ী দলে ময়মনসিংহের ‘কলসিন্দুর’-এ বেড়ে ওঠা আটজন আছেন এই দলে। মারিয়া মান্দা, সানজিদা আক্তার, শিউলি আজিম, তহুরা খাতুন, শামসুন্নহার সিনিয়র, শামসুন্নাহার জুনিয়র, সাজেদা খাতুন, মার্জিয়া আক্তারের বাড়ি কলসিন্দুরে। ৪ গোল করা সিরাত জাহান স্বপ্নার বাড়ি রংপুরে। আঁখির সিরাজগঞ্জ, সাবিনা ও মাসুরা সাতক্ষীরা, কৃষ্ণা টাঙ্গাইল, মণিকা, রুপনা ও ঋতুপর্ণা রাঙ্গামাটির। যারা ফুটবলে জাতিকে আনন্দে ভাসিয়েছেন তারা পারিশ্রমিকে বৈষ্যমের শিকার।

ফুটবলারদের আয়ের বড় উৎস হয় ক্লাব ফুটবল। ক্লাব ফুটবলে একজন শীর্ষ পুরুষ ফুটবলার ৫০-৬০ লাখ টাকা পান। সেই অঙ্কটা জাতীয় দলের ফুটবলারের জন্য কোটির কাছাকাছি গিয়েও ঠেকে। নবাগতদের কেউ কেউ ১০-১৫ লাখেও দল পেয়ে যান। আর নারীদের অঙ্কটা ৩-৫ লাখের ভেতরেই ঘোরাফেরা করে। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বাফুফে নারী ফুটবলারদের বেতন কাঠামো করেছে। তিনটি শ্রেণিতে ৩৬ জন নারী ফুটবলার বেতন পাচ্ছেন। শুরুতে ‘এ’ শ্রেণির বেতন মাসে ১০ হাজার, ‘বি’ শ্রেণির ৮ হাজার আর ‘সি’ শ্রেণির ৬ হাজার টাকা বেতন পেয়েছেন। এখন প্রতিটি গ্রেডে দুই হাজার টাকা করে বেতন বেড়েছে। হিসাব অনুযায়ী, সাবিনাদের মাসিক বেতন সাকূল্যে ১২ হাজার টাকা। ফুটবলারদের আয়ের এই বৈষ্যম দীর্ঘদিনের। ফুটবল অনুরাগীদের বিশ্বাস এ বৈষ্যম এখনই দূর করা উচিত। বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দীন বলেছেন, আমরা স্পন্সর থেকে এখন যে অর্থ পাচ্ছি সেটা দিয়ে মেয়েদের ভালোভাবে দেখভাল করছি। সামনে যদি আমরা আরো ভালো স্পন্সরশিপ অ্যামাউন্ট পাই নিশ্চয়ই ওদের বেতন, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হবে।’

মেয়েদের বেতনের বাইরে বাফুফে প্রতি মাসে খাওয়া, কোচিং স্টাফদের বেতন, খেলোয়াড়দের সরঞ্জাম, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় যাওয়ার খরচ বহন করে। সবই আসে স্পন্সর প্রতিষ্ঠানের থেকে। সেই অঙ্কটা বছরে ৪ কোটি।

গত কয়েকবছর ধরে আমাদের আনন্দের উৎসটা মূলত ক্রিকেটকে ঘিরেই হয়েছে। এবার মেয়েরা গৌরবময় সাফল্য বয়ে এনছে। দেশবাসীকে আনন্দ ও গৌরব করার মুহূর্ত উপহার দিয়েছে। বিশেষত এবারের নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে দেশবাসীকে একের পর এক আনন্দঘন মুহূর্ত উপহার দিয়েছে মেয়েরা।

২০১০ সাল থেকে পুরুষ ফুটবলের পাশাপাশি নারী সাফও শুরু হয়। বাংলাদেশ বিগত পাঁচ নারী সাফেই অংশ নিয়েছে। পাঁচটির মধ্যে একটিতে ফাইনাল ও তিনটিতে সেমিফাইনালে খেলেছে বাংলাদেশ। তবে শিরোপা অধরাই রয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের। সোমবার সেই অধরা শিরোপা ছুঁয়ে ফেলল বাংলাদেশ। সাবিনাদের এই ট্রফির মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে শিরোপা বাংলাদেশে আসছে আবার ১৯ বছর পর। বাংলাদেশের মেয়েরা দক্ষিণ এশিয়ার সিনিয়র সাফে এই প্রথম শিরোপা জিতলেও জুনিয়রপর্যায়ে কৃষ্ণাদের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে আরো আগেই। সাফ অনূর্ধ্ব- ১৫, ১৬ ও ১৮ তে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। কৃষ্ণা, আঁখিরা জুনিয়রপর্যায়ে সেরা হলেও সিনিয়রপর্যায়ে এতদিন বাংলাদেশ ভারত ও নেপালের বিরুদ্ধে পেরে উঠত না। সেই আক্ষেপও এবার ঘুচিয়েছে বাংলাদেশ, গ্রুপ পর্বেই হারিয়েছিল ভারতকে। ফাইনালে নেপাল-বধও। অথচ অজপাড়াগাঁ কলসিন্দুরের মেয়েদের ফুটবল খেলাকে অনেকে ভালো চোখে দেখেনি। পরিবার থেকেও তেমন একটা সহায়তা পাওয়া যায়নি। বিশেষ করে প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিকে যখন তারা ভর্তি হয়, তখন ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের বাধা আসে। বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েদের মধ্যে শারীরিক নানা পরিবর্তন দেখা দেয়। এ সময় তাদের ফুটবল খেলা পরিবারের সদস্যরা এবং স্থানীয় লোকজন ভালোভাবে নেয়নি।’

ফুটবল খেলতে গিয়ে নানা ধরনের কটূক্তিও শুনতে হয়েছে কলসিন্দুরের মেয়েদের। সাফল্য লাভের প্রত্যাশায় মেয়েরা কঠোর পরিশ্রম করেছে।

সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েরা দিনের পর দিন ঢাকার বাফুফে ভবনে একসঙ্গে থেকেছেন, একসঙ্গে খেয়েছেন, একসঙ্গে অনুশীলন করেছেন, একসঙ্গে দেশ-বিদেশে খেলেছেন। এমন করতে করতে সবাই মিলে হয়ে উঠেছেন একটা পরিবার। ফুটবল ছাড়া কোনো জীবন নেই। ফুটবলটাই যেন জীবন। কঠোর অনুশাসনে শৃঙ্খলাবদ্ধ সেই জীবনকেই হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছেন মেয়েরা। নেবেনই না কেন, এই ফুটবলই যে বদলে দিয়েছে তাদের জীবন। ফুটবল তাদের কাছে দারিদ্র্যপীড়িত জীবন থেকে মুক্তির এক বাহন। অনেকের জন্য পেট ভরে খাওয়ার নিশ্চয়তাও।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App