×

মুক্তচিন্তা

কর রেয়াত সুবিধার পুনর্বিবেচনা প্রসঙ্গ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০১:৪৫ এএম

কর রেয়াত সুবিধার পুনর্বিবেচনা প্রসঙ্গ
কোনো দেশের অর্থনীতিকে দ্রুত উন্নয়নের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য শিল্প খাতের বিকাশে নানা ধরনের প্রণোদনা দেয়া হয়ে থাকে। বিশ্বের অনেক দেশেই এটা করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ দেশের শিল্প খাত খুবই ভঙ্গুর অবস্থায় ছিল। তাই এই খাতকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য নানাভাবে আর্থিক প্রণোদনা দেয়া হয়েছিল। তারই একটি প্রক্রিয়া ছিল ট্যাক্স হলিডে বা শুল্ক ছাড় প্রদান। নতুন শিল্প স্থাপন এবং বিভিন্ন অনুন্নত অঞ্চলে শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের শুল্ক ছাড় দেয়া হয়। অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে সাধারণত এ ধরনের প্রণোদনামূলক সুবিধা দেয়া হয়। বিগত কয়েক বছরে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পে জাতীয় গুরুত্ব বিবেচনায় বড় দাগে কর রেয়াত দেয়ার কথা শোনা যায়। এসব বড় ছাড়ের উদ্দেশ্য, বিধেয় ও প্রক্রিয়া পদ্ধতি নিয়ে পর্যালোচনার অবকাশ এমনিতেই উঠে আসে। কেননা প্রতীয়মান হচ্ছে ট্যাক্স জিডিপি রেশিও বাড়ানোর পথে এই পথ বা পন্থা একটি অন্তরায় হিসেবে এবং অর্থ পাচার ও আয় বৈষম্য বৃদ্ধিও অনুঘটক হিসেবে দেখানো হতে পারে। বাংলাদেশ বর্তমানে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে মধ্য আয়ের উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হয়েছে। দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাগ্রসরমান কর রেয়াত বা শুল্ক ছাড় প্রদানের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার অবকাশ রয়েছে। কর রেয়াত প্রদানের ক্ষেত্রে শিল্পগুলোর মধ্যে আন্তঃপ্রতিযোগিতার প্রশ্ন এসে যায়। আর একটি প্রশ্নও এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, তা হলো উন্নয়ন ব্যয়ের হিসাবের স্বচ্ছতার বিষয়টি। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে যে কর আহরণ তার উদ্দেশ্য যদিও রেভিনিউ কালেকশন কিন্তু এর আর একটি অন্তর্নিহিত লক্ষ্য থাকে। যেমন উৎপাদন উন্নয়ন ব্যয়ের যথাযথ হিসাবায়ন, রিফ্লেকশন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ইত্যাদি। যেমন, কম্পিউটার আমদানির ওপর যদি কোনো ধরনের ট্যাক্স আরোপিত না থাকে তাহলে কী হবে? যে বাক্সে করে কম্পিউটার আনা হচ্ছে তার ওপরে লেখা থাকবে কম্পিউটার। শুল্ক সংগ্রহের বন্দরে যারা দায়িত্ব পালন করবেন তারা সেই বাক্স খুলবেন না। যেহেতু কম্পিউটার আমদানিতে কোনো ধরনের ট্যাক্স আরোপিত নেই তাই কাস্টমসের লোকজন সেটা খুলবে না। কিন্তু হয়তো কম্পিউটার আমদানির নামে মিথ্যা ডিক্লারেশন দিয়ে অন্য কোনো মালামাল আনা হচ্ছে, আন্ডার অথবা ওভার ইনভয়েসিং যাচাইয়ের সুযোগ থাকছে না। এই প্রতারণা ধরার জন্য কম্পিউটারে যদি সামান্যতম ট্যাক্স আরোপিত থাকত, তাহলে প্যাকেট খুলে দেখার প্রয়োজন হতো। এই ব্যবস্থা নেয়া হলে হয়তো ৪-৫ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হবে, শ্রম ঘণ্টা ব্যয় হবে। এটা কোনো বিষয় নয়। কিন্তু কর ফাঁকি দেয়ার যে প্রবণতা তা রোধ করা যেত। কয়েক বছর আগে প্রচলিত একটি ব্যবস্থাপনার উদাহরণ। বলা হলো, সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশে যাওয়ার সময় ভ্রমণ কর দিতে হবে না। কারণ এই টাকা তো সরকারই পরিশোধ করবে। কিন্তু দেখা যায়, বহু লোক ভুয়া জিও জারি করে এই সুযোগ গ্রহণ করছে। এ ধরনের অনেক ঘটনা উদঘাটিত হলো। তখন দেখা গেল, আসলে এই সুযোগের অপব্যবহার হচ্ছে। তখন বলা হলো, যেসব সরকারি কর্মকর্তা বিদেশে যাবেন তিনি ভ্রমণ কর বাবদ টাকা পরিশোধ করবেন। তিনি সেই টাকা প্রদানের রসিদ অফিসে জমা দিলে তিনি ব্যয়িত অর্থ পুনর্ভরণ পাবেন। এতে কাজ একটু বাড়বে ঠিকই কিন্তু বিষয়টি স্বচ্ছতার ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে। কেউ আর চাইলেই ফাঁকি দিতে পারবে না। একইভাবে আমাদের দেশের অর্থনীতি যখন এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা যখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হচ্ছি তখন ট্যাক্স হলিডে কিংবা ঢালাও রেয়াত থাকা উচিত কিনা তা পর্যালোচনা দরকার। একইভাবে কোনো কোনো পণ্যের ক্ষেত্রে বন্ড ওয়্যার হাউস সুবিধা দিচ্ছি, অন্য পণ্যের ক্ষেত্রে এই সুবিধা দিচ্ছি না। এতে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। যারা বন্ডেড ওয়্যার হাউস সুবিধা ব্যবহার করে বিদেশ থেকে শুল্কমুক্তভাবে কাঁচামাল আমদানি করছে তার শর্ত ছিল এই কাঁচামাল দিয়ে পণ্য উৎপাদন করে তা বিদেশে রপ্তানি করবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এই সুবিধা ব্যবহার করে বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করে তা দিয়ে পণ্য উৎপাদন করে সেই পণ্য সরাসরি বিদেশে রপ্তানি না করে স্থানীয় বাজারে ছেড়ে দিচ্ছে। এতে স্থানীয় উৎপাদনকারী, যারা বন্ডেড ওয়্যার হাউস সুবিধা পাচ্ছে না তারা অসম প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হচ্ছে। এক সময় বন্ডেড ওয়্যার হাউস সুবিধা ভোগ করে উৎপাদিত পণ্যের মোড়কের গায়ে লিখে দেয়ার ব্যবস্থা করা হলো, এই পণ্যটি ‘স্থানীয় বাজারে বিক্রির জন্য নহে’, কিন্তু দেখা গেল কেউ সেই লেখা পড়ছে না। কিন্তু যিনি পণ্যটি কিনবেন তিনি সস্তায় পাচ্ছেন বলে এই পণ্যটিই কিনছেন। কর রেয়াতের ক্ষেত্রে এই যে সমস্যা, এটা সহজে রোধ করা যাচ্ছে না। প্রদত্ত সুবিধা ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার যে সমস্যা তা রোধ হওয়া প্রয়োজন। বিদ্যমান বাস্তবতায় এই সুবিধার অপব্যবহার রোধ করা সম্ভব না হলে এই সুবিধা অব্যাহত রাখা হবে কিনা তা ভেবে দেখতে হবে। অন্যদিকে স্বচ্ছতার বিষয়টিও যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সেটাও বিবেচনায় আনা আবশ্যক। উৎপাদন উন্নয়নে প্রদেয় করের হিসাব যেহেতু কর দেয়া হচ্ছে না বলে তা প্রাইসিং, ইন্টারনাল রেট অব রিটার্নের হিসাবায়নে তা ধরা না হলে উৎপাদন উন্নয়নের ওপর করের কোনো প্রভাব প্রতিফলিত হয় না। উৎপাদক নিজে কর না দিয়েও ভোক্তাদের কাছ থেকে বাড়তি মূল্য আদায় করছে। এতে ব্যবসায়ী লাভবান হলেও ভোক্তা ও সরকারি রাজস্ব ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখানে স্বচ্ছতার অভাব দেখা দিচ্ছে। এই লাভের টাকা সে অন্য দিকে সরানোর চেষ্টা করতে পারে। কারণ সে যদি ওই টাকা দেখাতে যায় তাহলে কর ফাঁকি দেয়ার বিষয়টি ধরা পড়ে যাবে। কর অবকাশের সুযোগ নিয়ে সে লভ্যাংশ পাচার করার সুযোগ পাচ্ছে। যদি তাকে কর প্রদান করতে হতো তাহলে সেই খরচের বিষয়টি ব্যয়ের ভেতর দেখাতে হতো। ফলে তার আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার সৃষ্টি হতো। উৎপাদনে ব্যবসায়ের স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে কর রেয়াত যেন একটি সমস্যা সৃষ্টি করে চলেছে, উন্নয়ন ব্যয় বেহাত হওয়াতেও ট্যাক্স জিডিপি হিসাবায়নে ধোঁয়াশা তৈরি হচ্ছে। দেখা যায় একটি সেক্টর, যারা পণ্য আমদানি করে তারা বসে যাচ্ছিল। তাদের সহায়তা করার জন্য এনবিআরের কাছে আবেদন করা হয়েছিল ভ্যাট মওকুফের। এনবিআর ভ্যাট মওকুফ করার দাবি মেনে নিয়েছে। কিন্তু তারা এমন কিছু শর্ত দিয়েছে, যে শর্ত পালন করা খুবই কঠিন। এই শর্ত মানা সম্ভব নয়। আর মানা হলেও এতে তারা উদ্বুদ্ধ হবে না। এমনকি শর্ত পরিপালন হচ্ছে কিনা তা দেখার পথটিও স্বচ্ছ নয়। কাজেই অর্থনীতিকে যদি প্রতিযোগিতামূলক করতে হয়, স্বচ্ছতা আনতে হয় তাহলে এ ধরনের কর রেয়াত সুবিধার পথ পন্থায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। আর কোনো বিষয়ে কর রেয়াতের মতো সুবিধা অনন্তকাল ধরে চলতে পারে না। সাময়িক সময়ের জন্য এ ধরনের সুবিধা প্রদান করা যেতে পারে। কিন্তু যুগের পর যুগ এটা চলতে থাকবে তা হতে পারে না। একজন উৎপাদক তার প্রকৃত ব্যয়ের পরিমাণ স্বচ্ছভাবে দেখাক। কর যা নির্ধারণ করা হয় পণ্য বা দ্রব্যের প্রকৃত মূল্যের ওপর, তাই যদি কর রেয়াত দেয়া হয় তাহলে একজন উৎপাদক তার পণ্যের প্রকৃত উৎপাদন ব্যয় দেখাবে না। শুধু কোনো খাত বা ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ প্রণোদিত করার নামে কর রেয়াত দেয়া হলে অর্থনীতিতে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা আসতে বিলম্ব ঘটবে। উৎপাদক নিয়ম মাফিক কর প্রদান করবে। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে অংশগ্রহণ করবে। যদি দেখা যায় কর প্রদান করে ব্যবসা করতে গিয়ে তিনি অসুবিধায় পড়ছেন। তাহলে তাকে প্রয়োজনে ভর্তুকি প্রদান করা যেতে পারে। দরকার হলে তাকে হ্রাসকৃত হারে ঋণ সুবিধা দেয়া যেতে পারে। এটা করা হলে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত হবে। কারণ সাবসিডি চাইতে গেলে তাকে তো প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র বা ডকুমেন্ট দেখাতে হবে। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে তার প্রদত্ত করের টাকা সাবসিডাইজড লোন আকারে প্রদান করা যেতে পারে। অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা পার্টির কাছ থেকে ভ্যাট-ট্যাক্স আগেই নিচ্ছে তারপর মালামাল সাপ্লাই করছে। কিন্তু সরকারকে ভ্যাট দেয়ার সময় তারা সঠিকভাবে তা দিচ্ছে না। ফলে জনগণ সঠিকভাবে ট্যাক্স-ভ্যাট দিলেও সরকার তা পাচ্ছে না। কিন্তু ব্যবসায়ীরা লাভবান হচ্ছে। তারা তাদের প্রতিষ্ঠানকে লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রদর্শন করছে। কিন্তু তার এই লাভ তো সরকারি কর ফাঁকি দেয়ার মাধ্যমে। একে প্রকৃত লাভ বলা যাবে না। তার এ ধরনের আচরণের কারণে জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে এনবিআরের বিরাট অঙ্কের টাকা পাওনা রয়েছে ট্যাক্স বা ভ্যাট হিসেবে। এসব প্রতিষ্ঠান ঠিকই জনগণের কাছ থেকে ট্যাক্স এবং ভ্যাটের টাকা আদায় করে নিচ্ছে। কিন্তু সেই আদায়কৃত টাকা সরকারের কাছে জমা দিচ্ছে না। এই সমস্যা সমাধানের জন্য একপর্যায়ে ডিউটি ড্র ব্যাক পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে। এর অর্থ হচ্ছে তুমি প্রয়োজনীয় শুল্ক প্রদান করবে। শুল্ক প্রদানের সেই কাগজপত্র নিয়ে এলে সমপরিমাণ টাকা ফেরত পাবে। কিন্তু সেখানেও সমস্যা দেখা দেয়। দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ভ্যাট-ট্যাক্স আদায় করছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দপ্তরে তা জমা না দিয়ে প্রত্যর্পণ চাচ্ছে। এটা এক বিরাট সমস্যা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য কর রেয়াত প্রদান বা কর অবকাশ প্রদানের বিষয়গুলো ভালোভাবে ঢেলে সাজাতে হবে। যাতে কেউ এসব সুবিধার অপব্যবহার করতে না পারে। সব সময় এটা বলবৎ থাকুক যে নিয়ম মোতাবেক সকলে কর প্রদান করবে। তারপর যদি কোনো ধরনের সমস্যা থাকে তার বিবেচনাও করতে হবে দ্রুততার সঙ্গে। কিন্তু সবাইকে সব ক্ষেত্রে কর দিতে হবে সবার স্বার্থে, সুশাসন ও জবাবদিহির স্বার্থে। ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ : কলাম লেখক ও উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App