×

জাতীয়

এলপিজির বাড়তি দামে নাকাল ভোক্তা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৩:৪০ পিএম

এলপিজির বাড়তি দামে নাকাল ভোক্তা

ফাইল ছবি

 সরকার নির্ধারিত দাম বাজারে নেই বাজারে এক ধরনের ব্লেমগেম চলে : ভোক্তা ডিজি

এলপি গ্যাসের তাপে পুড়ছে ভোক্তার পকেট। রান্না ও গাড়ির জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলপিজির দাম আদালতের আদেশ অনুযায়ী প্রতিমাসে নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। সে হিসেবে গত ৭ সেপ্টেম্বর গ্রাহক পর্যায়ে ১২ কেজি তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম এক হাজার ২৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু দেশের কোথাও সরকার নির্ধারিত দামে মিলছে না গ্যাস। বরং প্রতি সিলিন্ডারে ২০০ থেকে আড়াইশ টাকা গুণতে হচ্ছে ভোক্তাকে। এমন অভিযোগের ভিত্তিতে বাজারে অভিযান চালিয়ে সেটার প্রমাণও পেয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

সংস্থাটির মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, যখনই কোন অভিযান পরিচালনা করা হয়, তখনই বাজারে এক ধরনের ব্লেম গেম চলতে থাকে। সেই ব্লেমগেম থেকে আমরা বের গতে চাই। প্রকৃত তথ্য উদঘাটন করতে চাই। গত কয়েকদিন রাজধানীতে প্রতি সিলিন্ডার গ্যাস কিনতে ভোক্তার বাড়তি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা খোয়া গেছে। বছরে ৮ কোটি সিলিন্ডার বিক্রি হলে তাতে ভোক্তার স্বার্থ বিশালভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। সেজন্য এ অপরাধ মেনে নেয়া হবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এলপিজি গ্যাসের মূল্য বিষয়ে এর উৎপাদনকারী, বাজারজাতকারী ও ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণে গতকাল মঙ্গলবার এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় ভোক্তা আধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সভাকক্ষে এ সভায় সভাপতিত্ব করেন অধিদপ্তরের ডিজি এ এই্চ এম শফিকুজ্জামান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে এক দশকের বেশি সময় ধরে গৃহস্থালিতে গ্যাস-সংযোগ বন্ধ। এ সময় বেড়েছে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয়। বেড়েছে জীবনযাত্রার মান। তাতে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি হিসেবে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দিকে ঝুঁকছেন মানুষ। গ্রামেগঞ্জে এখন রান্নায় মাটির চুলার বদলে জায়গা করে নিয়েছে এলপিজি। কিন্তু চাহিদা বাড়লেও দাম নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের মধ্যেই আছে অসন্তুষ্টি। এদিকে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার অজুহাতে অন্যান্য নিত্যপণ্যের মতো এলপিজির দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। সিলিন্ডার প্রতি দাম বাড়ানো হয়েছে ১৫০ থেকে ২৩০ টাকা পর্যন্ত। সাড়ে ১২ কেজির সিলিন্ডার এখন বিক্রি হচ্ছে ১৪৫০ থেকে ১৫০০ টাকায়। যদিও সরকার সেপ্টেম্বর মাসের জন্য দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সর্বোচ্চ ১২৩৫ টাকা। মূল্য নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকায় এ খাতে চলছে ‘নৈরাজ্য’। বেসরকারি কোম্পানিগুলো এবং খুচরা পর্যায়ের বিক্রেতারা গ্রাহকের কাছ থেকে এলপিজির দাম আদায় করছে ইচ্ছেমতো। বাড়তি মূল্যে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেশ কয়েক বছর ধরে আবাসিক গ্রাহকদের নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ রেখেছে সরকার। ফলে এলপিজির সিলিন্ডারের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এলপিজির মূল্য নির্ধারণ না করায় নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে এ খাত। প্রতি মাসে সরকার এলপিজির দাম নির্ধারণ করে দিলেও দেড়শ থেকে ২০০ টাকা বেশি দামে বিক্রি করছেন বিক্রেতারা। ফলে এলপিজি ব্যবহারে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে সাধারণ ভোক্তাদের। অতিরিক্ত মুনাফা লুটছে কোম্পানি, ডিলার ও বিক্রেতারা। বেশি দামে বিক্রির কথা স্বীকার করছে এলপিজি সিলিন্ডারের ডিলার, উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের দাবি, জ্বালানি তেল ও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। বার বার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাকে বলার পরও তারা দাম সমন্বয় করছে না।

দেশে এলপিজি সরবরাহকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এখন বছরে চাহিদা ১০ লাখ মেট্রিক টনের মতো। আর বিপিসি সরবরাহ করে মাত্র ১৬ হাজার মেট্রিক টন। সরকারি এলপিজি কোম্পানির দুটি কারখানার বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা মাত্র ১৫ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। এরমধ্যে চট্টগ্রামের এলপিজি কারখানার ১০ হাজার আর কৈলাসটিলা প্ল্যান্টের ৫ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। অর্থাৎ চাহিদার সিংহভাগই জোগান দেয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। বাজারে বিভিন্ন কোম্পানি এলপিজি সিলিন্ডারের ব্যবসা করছে। এর মধ্যে রয়েছে- বসুন্ধরা, ওমেরা, বেক্সিমকো, পেট্রোম্যাক্স, টোটাল, বিএম এলপি গ্যাস, এনার্জিপ্যাকের জি গ্যাস, লাফ্স গ্যাস, ইউরোগ্যাস, ইউনিভার্সাল, যমুনা ও সেনা এলপিজি।

এলপিজি তৈরির মূল উপাদান প্রোপেন ও বিউটেন বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। প্রতি মাসে এলপিজির এ দুই উপাদানের মূল্য প্রকাশ করে সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠান আরামকো। এটি সৌদি কার্গো মূল্য (সিপি) নামে পরিচিত। এ সৌদি সিপিকে ভিত্তিমূল্য ধরে দেশে এলপিজির দাম সমন্বয় করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)। গত বছরের ১২ এপ্রিল দেশে প্রথমবারের মতো এলপিজির দাম নির্ধারণ করে এই সংস্থা। এর পর থেকে প্রতি মাসে দাম সমন্বয় করা হচ্ছে।

দাম বেড়ে যাওয়ার সমস্ত দায় সরকারের কাঁধে চাপিয়ে এলপিজি আমদানিকারকরা বলছেন, ব্যবসায়িক কোনো যুক্তি না মেনে দাম ঠিক করে দিয়ে গ্যাসের বাজারকে মগের মুল্লুকে পরিণত করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। গতকাল ভোক্তা অধিদপ্তরে আয়োজিত বৈঠকে আমদানিকারকরা জানান, বিশ্ববাজারে এলপিজির দাম, ডলারের দাম, আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় এবং জ্বালানি তেলের কারণে পরিবহন খরচ বাড়ার পরও সেসব বিষয় আমলে না নিয়ে বিইআরসি গ্যাসের দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে। যা প্রকৃত দামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

এর প্রতিউত্তরে ভোক্তা অধিদপ্তরের ডিজি সফিকুজ্জামান বলেন, তারপরও যখন সরকার দাম নির্ধারণ করে, সেটা মানতে হবে। ভোক্তারা নির্ধারিত দামে না পেলে সেটা প্রতারণা হবে। আপনাদের সমস্যাগুলো দাম নির্ধারণের পূর্বে কর্তৃপক্ষকে বোঝাতে হবে। সেটা আপনারা করতে পারছেন না এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তিনি বলেন, আমি বিইআরসির চেয়ারম্যানের সঙ্গে বসবো। তিনিই আমাকে এর আগে দাম নিয়ন্ত্রণে অভিযানের কথা বলেছিলেন। এখন সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করে ডেভলপ করতে পারবো।

এসময় বেক্সিমকো গ্যাসের চিফ কমার্শিয়াল অফিসার মুনতাছির আলম বলেন, বারবার অনুরোধ করে বিইআরসি’র দাম নির্ধারণের সভায় জায়গা নিতে হয়েছে আমাদের। গত মাসে দাম নির্ধারণে আমরা আগ্রহী ছিলাম না। কারণ মিটিংয়ে আমাদের সঙ্গে আলাপ না করে এলসি নিষ্পত্তির রেট ১০২ টাকা ধরা হয়েছিল। যেখানে সে সময় ডলার রেট আরও অনেক বেশি ছিল। তিনি বলেন, এছাড়া আমাদের গ্যাস সংরক্ষণ ও বোতলজাতকরণের জন্য রেট ধরা হয় ১৮৬ টাকা। কিন্তু আমরা হিসাব দিয়েছি এ খরচ ২৪৫ টাকা। তারপরও মানা হয় না। অন্যদিকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পরও সে পুরনো ৬৫ টাকা প্রতি লিটারের দাম ধরে অভ্যন্তরীণ পরিবহন খরচ হিসাব করা হচ্ছে। অপারেটরের কোনো মার্জিনও রাখা হয়নি দাম নির্ধারণের হিসাবে। ফলে যে দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে সেটা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

জিএমআই কোম্পানির চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এ এলপিজি খাতে ৩২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ। আমিও জীবনের শেষ সময়ে বড় বিনিয়োগ করে বসেছি এ খাতে। সরকার যেমন প্রয়োজনে রাতারাতি একদিনে ৪৮ টাকা জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে, আমরা সেটা করতে পারি না। শুধু লোকসান করি।

তিনি বলেন, আমরা পরিপূর্ণ ব্যবসায়ী, সিস্টেমেটিক ব্যবসায়ী, আমাদের ইথিকস আছে। সেজন্য আমরা লোকসান দিয়েও চালিয়ে যাচ্ছি। লোকসানের কারণে এখন আমরা ব্যাংক ঋণও পাচ্ছি না। আগে ঋণ দেয়ার জন্য ব্যাংকগুলো পেছনে পেছনে ঘুরতো।

অন্যদিকে ডিলার ও বিক্রেতাদের পক্ষ থেকে কয়েকজন বৈঠকে বলেন, অপারেটর কোম্পানিগুলো তাদের মুনাফা কমিয়ে দিচ্ছে। এমনও হয়েছে, কোম্পানি এক মাসে তিন দফা মুনাফা কমিয়েছে। সেজন্য তাদের লাভ থাকছে না। তারা বারবার সরকারের বিভিন্ন সংস্থার অভিযানে জরিমানার স্বীকার হচ্ছেন। যদিও দাম বাড়ানোর পেছনে অপারেটররা দায়ী।

বৈঠকে বিইআরসি’র প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত উপপরিচালক ফিরোজ উজ জামান বলেন, দাম নির্ধারণে কিছু দুর্বলতার কথা এসেছে। সেগুলো আমি বিইআরসি চেয়ারম্যানকে জানাবো।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App