×

মুক্তচিন্তা

রানির প্রস্থান, রাজার আগমন এবং আধুনিক ব্রিটেন

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১২:৩৫ এএম

ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুতে ১০ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক প্রকাশ করেছে রাষ্ট্র। পৃথিবীর ক্ষমতাধর রাষ্ট্র আমেরিকা কিংবা অন্য অনেক রাষ্ট্রপ্রধানের পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও তার শেষকৃত্যে অংশ নিচ্ছেন। দেশটার মুকুটপরা রানি ছিলেন দ্বিতীয় এলিজাবেথ, কিন্তু ক্ষমতায় ছিলেন তিনি মুকুটহীন। অর্থাৎ ব্রিটেনের বর্তমান রাজতন্ত্র এ রকমই। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে না থাকলেও তিনি রানিই ছিলেন, ছিল তার প্রাসাদ- দেশটার বিভিন্ন জায়গায় এবং অর্থ-বৈভবের পুরো তথ্য না আসলেও কিংবা রানির সম্পত্তি নিয়ে নানা কথা প্রচলিত থাকলেও বিখ্যাত ‘ফরচুন’ ম্যাগাজিনের প্রতিবেদন অনুযায়ী রানির ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিমাণ ৫০০ মিলিয়ন ডলার। ৭০ বছরের বেশি সময় সিংহাসনে থাকাকালীন সময়েই এই পরিমাণ সম্পত্তি অর্জন করেছেন তিনি। এছাড়া ব্রিটিশ রাজপরিবারের ২৮ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা রয়েছে, যাকে রয়্যাল ফার্ম বলা হয়। রাজা ষষ্ঠ জর্জ ও প্রিন্স ফিলিপ এটিকে পারিবারিক ব্যবসাও বলে থাকেন। শৈশব-কৈশোর-যৌবনে শোনা কিংবা পড়া রাজা-রানির মতো প্রতাপ না থাকলেও রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল সেই কিসসা কাহিনীর মতোই। দীর্ঘ ৭০ বছরের শাসনামলের পর তার মৃত্যুতে তিনি সারা পৃথিবীতেই এক অনন্য রানি হিসেবে সমাহিত হচ্ছেন। আর সেজন্য ঐতিহ্য আর আভিজাত্য ধারণ করেই ব্রিটেন নামক দেশটিরও এতে ভার বহন করতে হচ্ছে কয়েক মিলিয়ন পাউন্ডের। সমাহিত হওয়ার আগেই রানির স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন তার ছেলে চার্লস। স্বাভাবিকভাবেই সবকিছুই এখন তার হাতে। কিন্তু একজন রানির প্রস্থানে এবং অন্য রাজার আগমনে ব্রিটেন কি কোনো ধাক্কা খেয়েছে নাকি সামান্য সময়ের জন্যও কেঁপে উঠেছে এই মসনদ। গণমাধ্যম আহাজারি করছে ব্রিটেনে, এমনকি বাংলাদেশের মিডিয়াও রানিকে নিয়েই মেতে আছে। দেশের অধিকাংশ মানুষই হয়তো শোকাহত। কিন্তু রানির কফিনের পাশাপাশি আছে যেমন শত-সহস্র শোকাহত উৎসুক মানুষ, এ রকম হাজার হাজার মানুষ না হলেও অসংখ্য মানুষ তার কফিন গণমাধ্যমের সামনে রেখেই করছে প্রতিবাদ। একটা সময় ছিল, যখন রাজতন্ত্রকে ধর্মেরই আরেক রূপ হিসেবে বিবেচনা করা হত। গণতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতার কালে ধর্মকে চাইলে মানুষ অস্বীকার করতে পারে, কিন্তু নিখাদ রাজতন্ত্রের কালে রাজার বিপরীতে কথা বলার সাহস কি দেখাতে পারে কেউ, কিংবা এর থেকে কি পরিত্রাণ পাচ্ছে মানুষ? রাজতন্ত্রের জাঁতাকলে এখনো পিষ্ট হয়ে আছে মানুষ। মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্র আর ধর্ম যেন মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। ব্রিটেন এপিঠ-ওপিঠ না হলেও ঐতিহ্যকে ধারণ করেই চলছে তাদের পথচলা, বাড়ছে রাজপরিবারের বৈভব-ঐশ্বর্য। কিন্তু নতুন রাজার আগমন ব্রিটেন কিছুটা হলেও ধাক্কা খাবে। কিছুটা হলেও হয়তো পরিবর্তনের দিকেই এগোতে হবে তাকে। অশীতিপর রানির প্রতি মানুষের একটা সম্মান-শ্রদ্ধা থাকলেও মাঝে মাঝে যে প্রতিবাদ ওঠেনি তা নয়, এমনকি আজকের ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসও একসময় রাজতন্ত্রের ঘোর বিরোধী ছিলেন। বক্তৃতায়-বিবৃতিতে তিনি রাজতন্ত্রের পতনই চেয়েছিলেন, যখন তিনি লিবারেল ডেমোক্র্যাটের রাজনীতি করতেন। কিন্তু তিনিও মাত্র ক’দিন আগে দেশটির ক্ষমতা নিতে রানির শেষ বাসস্থান স্কটল্যান্ডের বালমোরালে গিয়ে আশীর্বাদ-অনুমোদন নিয়ে এসেছেন। রাজা হিসেবে চার্লসের আগমনে প্রতিবাদী মানুষ দেশটার বিভিন্ন জায়গায়ই প্রতিবাদ করতে চাইছে, করছেও। দু-একজন আটকও হয়েছেন। প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ‘নট মাই কিং’ প্ল্যাকার্ড দেখিয়েছে। এ রকম প্রতিবাদে বিভিন্ন জায়গায় সরকারের পক্ষ থেকে কড়াকড়ি আরোপ করা হলে এখন এই মানুষগুলো প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে নিয়েছে একটা ভিন্ন ধরনের প্ল্যাকার্ড- একটা আঁক-জোখহীন কাগজ, যেখানে কিচ্ছু লেখা নেই। প্রতিবাদের আরেক ভাষা ‘ব্লাংক প্ল্যাকার্ড’। যারা নাগরিকদের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করেন, তাদের একজন কোয়ান গুয়েন। তিনি বলেছেন, ‘আমি রানির বিরুদ্ধে নই, তবে বাস্তবতার এই সময়টাই আমাদের প্রশ্নের মুখোমুখি করছে, আমাদের এখনো একই ধরনের রাজতন্ত্রের প্রয়োজন আছে কি, বর্তমান জীবনযাত্রার সংকটকালে তাদের ব্যয় সম্পর্কে, জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে প্রশ্ন করার নাগরিক অধিকার আমাদের আছে।’ প্রতিবাদী মানুষগুলো এ প্রতিবাদের জন্য অনুমতি চাইছে, সেজন্য তারা আদালত পর্যন্ত দৌড়াচ্ছে। গণতন্ত্রের এই দেশে রাজতন্ত্র এখন আর ধর্মের আরেক রূপ নয়। এখানে মানুষ তর্ক জুড়ে দেয়। সেজন্যই প্রশ্নের মুখোমুখি করছে রাজপরিবারকে। রানির কফিনের পেছনে হাঁটা রাজপরিবারের আরেক সন্তান প্রিন্স এন্ড্রুকে তুলছে জাতির কাঠগড়ায়। মানুষ চিৎকার করে জানিয়ে দিচ্ছে এই সেই এন্ড্রু যার বন্ধুত্ব হলো চিহ্নিত শিশু যৌন অপরাধী (পিডোফাইল) জেফরি এপস্টেইনের সঙ্গে। তাদের ভাষায় রানির শান্তির যাত্রাকে রাজপরিবারই অপবিত্র করে তুলছে। রানির মৃত্যুতে রাজতন্ত্র কিংবা রাজপরিবার যেন নতুন আরেক প্রশ্নের মুখোমুখি হলো। গণমাধ্যমগুলো কিংবা সরকার ঢালাওভাবে রানির জীবনাবসানে শোকবিহ্বলতার ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে যদিও, তবে বদলে যাচ্ছে পরিবেশ। একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর মাঝে এ নিয়ে খুব একটা উৎসাহ-উৎসুক-উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নেই। একটা দিন ব্যাংক হলিডে অর্থাৎ ছুটির দিনের প্রত্যাশায় ছিল নাগরিক, তা তারা পেয়েছেও। সোমবারের এই হলিডে নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। বিশেষত বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সঙ্গে রোগীর ওইদিন নির্ধারিত সাক্ষাৎ করা হচ্ছে না কিংবা এ দিনে হাজার হাজার রোগীর অস্ত্রোপচার (অপারেশন) হবে না। কারণ নির্ধারিত ওই দিনের অপারেশন কিংবা ডাক্তারদের সঙ্গে সাক্ষাৎ অতি সহজে যে পরবর্তীতে পাওয়া যাবে না, তা তারা জানে। এমনিতেই দেশটির জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা (এনএইচএস) নিয়ে আছে মানুষের সমালোচনা। রোগীদের অপারেশনের দিন পেতে দেরি হচ্ছে, কনসালট্যান্টদের সঙ্গে সাক্ষাৎ পেতে লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হয় নাগরিকদের। আর সেজন্য এই ভুক্তভোগী মানুষগুলো এ বিষয়টাকে সহজভাবে মেনে নিচ্ছে না। বরং রানির প্রতি শোক জানাতে গিয়ে তারা নিজেরাই কিছুটা উদ্বেগের মাঝে পড়ে যাচ্ছে। বর্তমান রাজা চার্লস তার মায়ের মতো জনপ্রিয় নন, এ জনপ্রিয়তার কাছাকাছি পৌঁছতে হলে তাকে ছাড় দিতে হবে হয়তো অনেক। কারণ ব্রিটেনের রাজতন্ত্র হলো গণতন্ত্রের দ্বারা আবৃত। এখানে জনগণের ভাষা কিংবা ধ্বনি প্রতিদিন তাদের কানে প্রতিধ্বনি হিসেবেই বাজতে থাকবে। এখানে মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্রের মতো দমন-নিপীড়নের বালাইও নেই। এমনকি সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করারও কোনো সুযোগ নেই। যদিও পার্লামেন্টের দ্বারা পাস হওয়া কোনো বিল মুকুটের ক্ষমতাবলে রানির অনুমোদন সাপেক্ষেই হতো। রানি হিসেবে দ্বিতীয় এলিজাবেথের সাফল্য ছিল, ক্ষমতার অনুশীলনের মধ্য দিয়েই তিনি তার ক্ষমতাকালীন সময়ে যা-ই করেছেন, তা জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে যায়নি। আর সেজন্যই তাকে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়নি খুব একটা। অর্থাৎ পার্লামেন্টের সিদ্ধান্ত তথা জনসাধারণের মতামতকেই তিনি তার মতামত হিসেবে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে সব কিছুতেই অনুমোদন দিয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে অপসারিত প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সংসদ স্থগিত করতে রানিকে ব্যবহার করতে চাইলে তা-ও হাইকোর্টের রায়ে শেষ পর্যন্ত কল্কে পায়নি। এখন চার্লস ক্ষমতায়। স্বাভাবিকভাবেই রাজা চার্লস তার মায়ের মতো রাষ্ট্রের বিভিন্ন ইস্যুতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে প্রভাব প্রয়োগ করার ক্ষমতায় থাকবে। প্রভাবশালী পত্রিকা গার্ডিয়ান তার এক সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করেছে, রাজকীয় সংস্কারের ব্যাপারে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ব্যাপক সংস্কারের ব্যাপারটা বিবেচনায় নেয়া উচিত। যদিও প্রয়াত রানি ৯০-এর দশকে স্বপ্রণোদিত হয়ে কিছু আয়কর দিয়েছিলেন, তার ছেলে উত্তরাধিকার কর প্রদান করেননি- এবং ডাচি অব ল্যাঙ্কাস্টারের ৬৫০ মিলিয়ন পাউন্ডের ব্যক্তিগত সম্পত্তিও রাজা চার্লসের কাছে আয়কর ছাড়াই চলে যায়। ক্রাউন এস্টেট থেকে লাভের এক-চতুর্থাংশ অনুদান আকারে শাসক রাজাকে দেয়া হয়। গত বছর এটি প্রায় ৮৫ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের ছিল। গার্ডিয়ান লিখেছে, সেই চুক্তিও পর্যালোচনা করা দরকার। রাষ্ট্রের প্রধান কে তা গুরুত্বপূর্ণ। পার্লামেন্ট হলো সিদ্ধান্ত নেয়ার জায়গা, পার্লামেন্টই চালায় দেশ। এদেশে আরো শীতল রাজতন্ত্র দরকার না তার আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে। জনগণতন্ত্রের রাজনীতির যুগে মাঠের ওপরে দাঁড়ানো কেউ একজনের অধিকার হয়তো সংবিধানই দিয়েছে, কিন্তু উত্তরাধিকার ও পদমর্যাদার কাছে এমপিদের হাঁটু বাঁকানো উচিত নয়। গার্ডিয়ান এ ব্যাপারটা আবারো তাদের এই সম্পাদকীয়কে নতুন করে মনে করিয়ে দিয়েছে রাজা পরিবর্তনের এই সময়ে। রাজা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আধুনিক ব্রিটেনে কি এই ধারণাটা ক্রমেই জোরালো হয়ে জনমনে দেখা দেবে?

ফারুক যোশী : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App