শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাপ্তাহিক ছুটি প্রসঙ্গে
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১২:১৪ এএম
সম্প্রতি বিদ্যুৎ ব্যবহার সাশ্রয়ের জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এর অন্যতম পদক্ষেপ হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সপ্তাহে দুদিন বন্ধ থাকবে। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং এর অধীন দপ্তর যথা শিক্ষা অধিদপ্তর ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বেশ মাথা ঘামাচ্ছে। আসলে এটি কোনো ব্যাপারই নয়। বহু বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সপ্তাহে দুদিন ছুটি দিয়ে আসছে। বিশ্ব চলছে পাঁচ কর্মদিবসে। সমস্যাটা সময়ের নয়, কর্মনিষ্ঠা, সময়ানুবর্তিতা এবং আন্তরিকতা এবং দায়িত্ববোধ। এসব ঠিক থাকলে পাঁচ দিনই যথেষ্ট। এবারে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের সংবিধানে রয়েছে একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার কথা। তাকে উপেক্ষা করে এখন বহুমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চলছে দেশে। খোদ সরকারি বিদ্যালয়ে ইংরেজি ভার্সন চালু করা হয়েছে। পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষা চালু করা হলো।
পরীক্ষার সৃজনশীল পদ্ধতি প্রচলন করা হলো। ছাত্ররা তো দূরের কথা, শিক্ষকরা বোঝেন না সৃজনশীল কী পদার্থ। ফলে ঢাউস সাইজের গাইড বই বের হলো। সরকারের একটি মহৎ উদ্যোগ প্রতি বছর স্কুলে বিনামূল্যে বই বিতরণ। কিন্তু গাইড বই কিনতে যে অর্থ ব্যয় হয়, তাতে অভিভাবকদের কতটুকু সাশ্রয় হয়েছে এই বিনামূল্যে বই প্রাপ্তিতে, তা হিসাব করা দরকার। তবুও সরকারের এই উদ্যোগকে ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নেই, পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ ৫ এবং গোল্ডেন জিপিএর জন্য অভিভাবকদের ভেতর শুরু হয় অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতা। দেশব্যাপী ব্যাপকভাবে কোচিং শিক্ষা গড়ে ওঠে। মায়েরা শিশুদের নিয়ে ভোরে নাস্তা সঙ্গে করে কোচিং স্টোরে যান এবং সেখান থেকে বিদ্যালয়ে। আবার ৫ম শ্রেণিতে উঠলে স্কুলের ছুটির পরে কোচিং ক্লাস। শিশুদের চিত্তের বিকাশের সব পথ বন্ধ। লেখাপড়ার সঙ্গে খেলাধুলার যে যোগসূত্র ছিল তা বন্ধ হয়ে গেল। অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে বছরে একবার বার্ষিক ক্রীড়ানুষ্ঠান হয়। শোনা যাচ্ছে যে এই পাবলিক পরীক্ষা দুটো উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তা যদি হয়ে থাকে, তাহলে সেটি হবে একটি মহৎ কাজ। এক ধরনের শিশু নির্যাতন বন্ধ হবে।
কোচিংয়ের বিষয়টি নতুন নয়, আগে সাধারণত যে দুয়েকটি বিষয়ে কোনো ছাত্র একটু বেশি দুর্বল থাকত, সে কিছুদিনের জন্য সেই বিষয়ের কোচিং সাহায্য নিয়ে থাকত। কিন্তু পাবলিক পরীক্ষা চালু হওয়ায় কোচিং মহামারি আকারে রূপ নিয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় আরো একটি মহৎ পদক্ষেপ নিয়েছে। আগামীতে নবম শ্রেণিতে বিভাজন অর্থাৎ বিজ্ঞান, বাণিজ্যিক এবং মানবিক এসব বিভাগ থাকবে না। এই বিভাজনে আরো একটি ভয়াবহ দিক ছিল, তা হলো সরকারিসহ বেশকিছু নামকরা স্কুলে মানবিক বিভাগ নেই। বিভাজন না থাকায় ছাত্ররা রেহাই পাবে। বঙ্গবন্ধু একমুখী শিক্ষার কথা ভেবে ড. কুদরত এ খোদার নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন। স্বাধীন এবং মর্যাদাসম্পন্ন দেশের উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য উক্ত কমিশন সুপারিশ করেছিল। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর যে আদর্শের জন্য তিনি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, সেসব কিছু ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। আজ আর একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব নয়। কেননা বিশ্বায়নের অজুহাতে শিক্ষা ব্যবস্থা করপোরেট প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। তবে বাংলার ইতিহাস, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি যেন বিকৃত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
পরিশেষে আবারো বলব যে, দুদিনের ছুটি সমস্যা নয়, সমস্যা হলো আমাদের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাস্তবসম্মত করা। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ নিহিত ছিল ভাষা আন্দোলনের ভেতরে সেটি মনে রাখতে হবে। ভাষার জন্য শহীদদের আত্মত্যাগ স্মরণে রেখে দেশের জন্য কাজ করতে হবে। বিশ্বায়নের যুগে অন্য ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করে যাদের ভালো লাগবে, তারা এই দেশ ছেড়ে ভিনদেশের অভিবাসী হলে কিছু করারও নেই বা বলারও নেই, ক্ষতিও নেই। কিন্তু যারা দেশে থাকবেন, দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন, তারা আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা করবেন, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান
লেখক, ঢাকা।